বিগত কয়েক বছরের সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলে বা অনলাইনে খোঁজাখুঁজি করলে তাই কিছু অভিন্ন শিরোনামই চোখে পড়ে৷ যেমন: ‘রমজানের আগেই বাজার চড়া,' কিংবা ‘রোজার বাজারে আরো অস্বস্তি' অথবা ‘চড়া দামেই শুরু হচ্ছে রমজান, দায় নিচ্ছে না কেউ৷' আর তাই বাজারদর ঘিরে ব্যাপক শোরগোল ও দোষারোপের মধ্য দিয়েই রোজাদাররা ইফতার ও সেহেরি করেন, রমজানের প্রথম দিনগুলো অতিবাহিত করেন৷ সাধারণত প্রথম সপ্তাহ শেষে বাজারদর বেশ খানিকটা থিতিয়ে আসে৷ তবে রমজান শেষে ঈদকে ঘিরে বাজারদর আরেক দফা তাতিয়ে ওঠে রমজানের শেষ সপ্তাহে৷
চড়া বাজারদরে অসহায় লাখ লাখ ক্রেতা-ভোক্তা সরকারকে দোষারোপ করেন জিনিসপত্রের দাম যথেষ্ট কমিয়ে না আনতে পারার জন্য৷ তারা ব্যবসায়ীদেরকেও দুষেণ ও অভিযোগ করেন যে ব্যবসায়ী-বিক্রেতারা জোট বেধে জিনিসের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করেন৷ ব্যবসায়ীরা আবার একে অন্যকে দোষারোপ করেন৷ খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করেন পাইকারদেরকে বেশি দাম রাখার জন্য৷ পাইকরারা দায় ঠেলে দেন আমদানিকারক ও উৎপাদকদের দিকে৷ আমদানিকারকেরা বিশ্ব বাজারের দোহাই পারার সাথে যোগ করেন পণ্য পরিবহনের তথা জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধি, বীমার বাড়তি খরচসহ বিভিন্ন ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি৷ এছাড়া ব্যবসায়ীরা পথেঘাটে চাঁদাবাজির অভিযোগও করেন, যদিও খুব জোরালভাবে নয়৷ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলা ও কর্মকর্তাদের অনেকে আবার বেশ কঠোর ভাষায় চড়া দাম আদায়কারী ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন৷ পাশাপাশি দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে আশ্বাসও দেন৷ বাস্তবে দুটোর কোনোটারই বড় ধরণের প্রতিফলন দেখা যায় না৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কিছু ব্যবসায়ী ও বিক্রেতাকে জরিমানা করা হয় অবশ্য৷ আবার সরকারের কেউ কেউ সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তাদেরকেও চাহিদায় লাগাম টানতে বলেন, ইফতারে খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দেন৷
এতোকিছুর পর তাই যেসব যৌক্তিক প্রশ্ন সামনে আসে সেগুলো হলো: কেন বা কী কী কারণে রমজানে এভাবে জিনিসপত্রের দাম এতো বাড়ে? দাম বাড়ার এই বিষয়টা কি আসলে অর্থনীতির সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? এখানে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে৷ তবে শুরুতে একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে রমজানে মূল্যস্ফীতি শুধু বাংলাদেশেই বরং মুসলিম প্রধান আরো কয়েকটি দেশে তা দৃশ্যমান হয়৷ ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান হলো এরকম দুটি দেশ৷
বাংলাদেশে রমজানে মাসে চড়া বাজারদরের বিষয়টি চোখের সামনে ফুটে উঠলেও ভোক্তা মূল্য সূচকভিত্তিক (সিপিআই) মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় না৷ যেমন, গতবছর বা ২০২৩ সালে রমজান মাস ছিল মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ জুড়ে৷ তখন মানে গত বছরের মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ যা এপ্রিল মাসে সামান্য কমে হয় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ৷ তবে মে মাসে আবার বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ৷ রমজানের মাসের বেশিরভাগ সময়ে ও ঈদের মাসে জাতীয় মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়াটা একটু খটকারই বিষয়৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপাত্ত থেকে আবারে এটাও দেখা যায় যে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের প্রায় পুরোটাই ছিল রমজান৷ তখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ যা মার্চ মাসের ৬ দশমিক ২২ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি৷ আর মে মাসে এক লাফে তা বেড়ে হয় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ৷ সুতরাং, মূল্যস্ফীতির জাতীয় পরিসংখ্যানের ওপর চোখ রাখলে রমজান মাসে চড়া বাজারদর ও সাধারণ মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি বোঝা নাও যেতে পারে৷
অর্থনীতির সাধারণ সূত্র বলে, সরবরাহের বিপরীতে চাহিদা অতিমাত্রায় বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি ঘটায়৷ রমজানের মূল্যস্ফীতি প্রধানত এই চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি তা বোঝা যায়৷ এই সময়ে একদিকে বিভিন্ন ধরণের খাদ্যের চাহিদা বাড়ে৷ এই তালিকায় আছে ডাল, চিনি, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, ছোলা, খেজুর, দুধ ইত্যাদি৷ ফলে এসব পণ্যের দাম কিছুটা বাড়া অস্বাভাবিক নয়৷ দাম যাই হোক বিত্তবান ও সামর্থবানরা তাতে বিচলিত হন না, কিনে ফেলেন নিজেদের প্রয়োজন ও পছন্দমতো৷ সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ (২০২২) থেকে জানা যায় যে বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ উপার্জকারী মানুষের হাতে এখন প্রায় ৪১ শতাংশ সম্পদ পুঞ্জিভূত যা ২০১৬ সালে ছিল ৩৮ শতাংশ৷ অন্যভাবে বললে, দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষের হাতে দেশের পাঁচ ভাগের দুইভাগ অর্থ-সম্পদ রয়েছে৷ আর এই দেড় কোটি মানুষই একটা বিশাল বাজার তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ অতি ক্রেতা-ভোক্তাদের কাছে নিত্যপণ্যের বাজার দর চড়া হলেও তেমন কিছু এসে যায় না৷ বরং তারা চড়া দরেই স্বাচ্ছন্দ্যে প্রয়োজনমতোতো বটেই, প্রয়োজনের অতিরিক্তও কিনতে পারেন৷ আবার এদের ছোট একাংশ অস্বচ্ছল ও অভাবীদের ইফতার করানোর জন্য খাদ্যসামগ্রী বিতরণও করেন বিভিন্নভাবে৷ সেজন্য তাদেরকেও বাজার থেকে পণ্য কিনতে হয় এবং তা চড়া দরেই৷ ফলে, এই উচ্চ ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেতা-ভোক্তারা রমজান মাসের উচচ মূল্যস্ফীতিতে একটা ভূমিকা রাখেন৷
বস্তুত বাজারে টাকার সরবরাহ বেশি থাকলে সেটাও মূল্যস্ফীতি ঘটায়৷ তখন অনেক টাকা কম পণ্যের পেছনে ছোটে যা পণ্যর চাহিদা ও দাম বাড়ায়৷ চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে সবসময় সরবাহের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয় নয়৷
রমজান মাসে একাধিক কারণে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ে৷ সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবীরা বেতনের পাশাপাশি ঈদ বোনাস পেয়ে থাকেন৷ প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পরিবার-পরিজনের জন্য একটু বাড়তি টাকা পাঠানোর চেষ্টা করেন৷ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাদেরকে ঈদের জন্য ঋণ নিতে উৎসাহিত করে৷ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অনেকেই যাকাত আদায় করেন এই মাসে৷ তাই যাকাতের অর্থও বাজারে আসে৷ সব মিলিয়ে মোট টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে গত বছর এপ্রিল মাসে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ (এম-২) মার্চ মাসের চেয়ে প্রায় দুই শতাংশ বা ৩৩ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছিল ১৮ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি৷ আর মে মাসে তা দশমিক চার শতাংশ বা সাত হাজার ৭৮২ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৮ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা৷ একইভাবে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে মুদ্রা সরবরাহ আগের মাসের চেয়ে দুই দশমিক ১০ শতাংশ বা প্রায় ৩৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বেড়েছিল৷ আর মে মাসে কমে গিয়েছিল এক হাজার কোটি টাকা৷
এছাড়া রমজান মাসে সারা বছর তেমন চাহিদা থাকে না এমন কিছু পণ্যেরও চাহিদা বেড়ে যায়৷ তেমন একটি পণ্য হলো বেগুন৷ ইফতারে বেগুনি বানানোর জন্য এর চাহিদা যেমন হঠাৎ বেড়ে যায়, তেমনি দামও লাফিয়ে বাড়ে৷
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রমজানে নিত্যপণ্যের চড়া দামের নেপথ্যে অর্থনীতির সূত্রও কাজ করে৷ আর তা হলো মুদ্রা সরবরাহ ও চাহিদা বৃদ্ধি যা মূল্যস্তরকে বাড়িয়ে দেয় ও মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়, হাটে-ঘাটে অবৈধ চাঁদাবাজি যা সবারই জানা তবু কেউই জানেন না৷ ফলে, ভোক্তারা বিশেষত মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ বেসামাল হয়ে পড়েন৷ তাদেরকে বেশকিছু কাটছাট করতে হয় নিত্যপণ্যের বাজার খরচ মেটাতে৷ পাশাপাশি নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষকেও ভুগতে হয় এই সময়টাতে যদিও দান-সদকাহ ও যাকাতের মাধ্যমে পাওয়া খাদ্য ও অর্থ তাদের অনেককেই কিছুটা স্বস্তি দেয়৷