যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
গত দুইবছরের মতো করোনা বিধিনিষেধ না থাকায় এবার পরিবার-স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা ছেড়েছেন আগের চেয়ে বেশি মানুষ৷ তবে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষের সেই সুযোগ হয়নি৷ ঢাকায় কেমন কেটেছে তাদের ঈদ, জানুন ছবিঘরে৷
‘দেনার নীচে পইড়া গেসি’
ঢাকার মিরপুরে ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রেতা মো. নয়ন বলেন, ‘‘করোনার আগে তো দিন আনসি, দিন খাইসি৷ কিছু টাকাপয়সা হাতেও রাখতে পারসি, ঈদ গেসে কোনোরকম৷ এহন করোনা হওয়ার পর ঈদ-উদ দেখার সুযোগ নাই৷ হাতে জমানো টাকা শেষ হয়া আরো ৪০-৫০ হাজার টাকা দেনার নীচে পইড়া গেসি৷’’
‘বাপ-মারে ঈদে কাপড় দিতে পারি নাই’
ঢাকার আগারগাঁওয়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. সুমন মিয়া দুই ছেলে এক মেয়ের জনক৷ ঈদে গ্রামের বাড়ি বরিশালে যাওয়ার সুযোগ হয়নি এবার৷ তিনি বলেন, ‘‘আগের ঈদ্গুলি আছিল ভালোই, পরিবার, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজনরে কাপড় দিতে পারসি৷ কিন্তু করোনার পর থেকে আর এইগুলি সম্ভব হইতেসে না৷ এইবারের ঈদে খালি ছেলে-মেয়েরে এক সেট কাপড় দিসি, বাপ-মা’রে কিছু দিতে পারি নাই, মনটা ছোট হয়া আছে এইজন্য৷’’
‘আমগো কথা কে ভাবে!’
ঢাকার শ্যামলী এলাকার ময়লা সংগ্রহকর্মী জামাল হোসেন৷ করোনার আগে-পরের ঈদের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমাগো আর ঈদ কী? করোনার আগে যা-ও আছিল, এহন এক্কেরে আমরা শ্যাষ৷ আপনেগো মতো কত সাংবাদিক ছবি তুললো, কই আমরা কিছু পাইছি? কেউ এক পয়সা দিয়া জিগাইছে কিছু? আমগো কথা কে ভাবে? কেউ না৷’’
‘এই ঈদে মার্কেট থিকা কাপড় কিনসি’
ঢাকার পীরেরবাগে মুদি দোকানি মোছা. সীমা আক্তার৷ স্বামীর অন্য আয়ের পাশাপাশি এই ছোট দোকান করছেন তিনি ৩-৪ বছর যাবত৷ সাম্প্রতিক ঈদ কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘গত দুই রোজার ঈদে তিন মেয়েকে ফুটপাথ থেকে কাপড় কিনা দিসি কম দামে৷ কাপড়চোপড় না দিলে কান্নাকাটি করে, নিজেরও খারাপ লাগে৷ এই ঈদে লকডাউন না থাকায় ব্যবসাপাতি কিছুটা ভালো, তাই মার্কেট (শপিং মল) থেকে ওগোরে কাপড় কিনা দিতে পারসি৷’’
‘করোনার ক্ষতি পূরণ করা কঠিন’
ঢাকার শেওড়াপাড়ায় মিথুন হেয়ার ড্রেসারের নরসুন্দর রতন চন্দ্র শীল৷ এই ঈদে তার আয় গত দুই বছরের চেয়ে কিছুটা ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘করোনার লকডাউনে দীর্ঘ সময় দোকানপাট খুলতে পারি নাই৷ বাসা ভাড়া বাকি পড়সে প্রায় ৪০ হাজার টাকা৷ করোনায় আমাদের যে ক্ষতি হইসে, তা পূরণ করতে আমার মনে হয় বছর ৩-৪ লাগবে৷ এছাড়া উপায় নাই৷’’
‘পরিবারকে গ্রামে পাঠায় দিসি’
ঢাকার আগারগাঁওয়ের ফুটপাতে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন রিপন দেবনাথ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ধর্মে তো ঈদ নাই, আমরা পূজা পালন করি৷ সামনের বড় পূজা দূর্গাপূজা এই কোরবানি ঈদের আগেই৷ তবে লকডাউনের কারণে গত দুই বছর কামাই-রোজগার তেমন আছিল না, পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করসি৷ পূজায় ছেলেমেয়েদের তেমন কিছুই দিতে পারি নাই৷ পরিবারকে লকডাউনে বাড়িতে যে পাঠাইসি, এখনো আনার সাহস পাই নাই৷’’
‘পুলিশ খালি দৌড়ানি দিতো’
ঢাকার মিরপুরের কাঁচা সবজি বিক্রেতা মো. নাসির উদ্দিন৷ বাড়তি খরচ করে ঈদে বাড়ি যাননি তিনিও৷ নাসির বলেন, ‘‘লকডাউনে যে চাইরটা ঈদ গেসে, টেরই পাই নাই৷ লকডাউনের সময় পুলিশ রাস্তায় খাড়াইতেই দেয় নাই, যদিও নিত্য প্রয়োজনীয় কাঁচাবাজারের অনুমতি আছিল বইলা শুনসিলাম৷ কিভাবে যে দিনগুলা পার করাইসে আল্লাহ, বইলা বুঝাইতে পারবো না৷’’
‘মানুষের দুয়ারে ভিক্ষা করার অবস্থা হইসিলো’
আগারগাঁওয়ের ৬০ ফুট সড়কে একটি দোকানে রংয়ের কাজ করছিলেন রংমিস্ত্রী আবুল হোসেন৷ ঈদের তৃতীয় দিনেই কাজে লেগে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘পারলে তো আমরা ঈদের দিনেও কাম করি৷ প্যাটে ভাত না থাকলে ঈদ কী আর আনন্দ কী৷ কাজ কাম যে এখন পাইতেসি টুকটাক এইটাই বেশি৷ করোনার সময় জমানো টাকা-পয়সা সব শেষ হয়া ধার কর্জ করসি মানুষের কাছে৷ মানুষের দুয়ারে ভিক্ষা করার দশা হইসিলো আমাগো মতো গরীব মানুষের৷’’
‘সংসার চালাইতে রিক্সাও টানসি’
করোনার সময় আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায় মো. আবদুল জলিলের৷ সম্প্রতি তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চাকরি পেয়েছেন৷ ঈদে তাই মেলেনি ছুটি৷ জলিল বলেন, ‘‘সংসার চালাইতে এই বয়সে রিক্সা পর্যন্ত টানসি৷ এখন আল্লাহ মুখ তুইলা একটু চাইসে৷ দুই মাস হইসে এই চাকরি পাইসি, তা-ও ঈদে ছুটি পাই নাই৷ খাইয়া-পইরা কোনোরকম এখন আছি মন্দের ভালো৷’’
‘প্যাটে ভাত না থাকলে আবার ঈদ কী’
দৈনিক মজুরিতে হোটেলে কাজ করেন ছবির এই ব্যক্তি৷ লকডাউনে সব বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন তার আয় ছিল না৷ এবার ঈদে তারও বাড়িতে পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি৷ ঈদ উদযাপনের কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, ‘‘পেটে যদি ভাত না থাকে, তাইলে ঈদ আইলেই কী আর গেলেই কী৷’’
‘কাম না করলে খাওন নাই’
ঢাকার চিড়িয়াখানা-কমলাপুর রুটে চলাচলকারী আয়াত পরিবহণের চালকের সহকারি মো. রুবেল মিয়া৷ বাড়িতে না গিয়ে ঈদের মধ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন তিনি৷ রুবেল মিয়া বলেন, ‘‘করোনায় অনেকদিন পরিবহণ বন্ধ আছিল৷ যা-ও চালু আছিল, প্যাসেঞ্জার আছিল না, কারণ, অফিস আদালত, স্কুল কলেজ বন্ধ আছিল৷ আমরা যে কেমনে সংসার চালাইসি, কইতে পারি না৷ খায়া না খায়া দিন কাটসে৷ আমগো কাম না করলে খাওন নাই৷’’
বিপরীত চিত্র
করোনার সময় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরি হারান মিল্টন শেখ৷ পরে শুরু করেন খাবার ও পণ্য ডেলিভারির কাজ৷ আয়-রোজগার করে গত বছরের ঈদে বাড়িতে টাকাও পাঠিয়েছেন৷ কিন্তু এবার সেই তুলনায় আয় ভালো হয়নি বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘গত তিন-চার মাসে কাজের চাপ তুলনামূলক কম৷’’ ঈদের মধ্যে বাড়ি না গিয়ে ঢাকায় বাড়িতে বাড়িতে খাবার ও পণ্য সরবরাহের কাজ করে গেছেন মিল্টন৷