যত ধাপ তত ঘুস
১৬ জানুয়ারি ২০১৮দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি অমিতোষ পাল৷ ঘুস নিয়ে তিনি একাধিক আলোচিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন৷ বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের ঘুস বাণিজ্য নিয়ে তার প্রতিবেদনগুলো আলোচিত৷
‘‘সিটি কর্পোরেশনের যে কোনো কাজে ঠিকাদারকে কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে বিল নেয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে ঘুস দিতে হয়৷ যত ধাপ তত ঘুস৷ এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে৷'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷
‘‘একটি সড়কের কাজের শুরু হয় দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে৷ আর দরপত্র দাখিলের পর থাকে একটি মূল্যায়ণ কমিটি৷ কাজ পেতে হলে শুরুতেই এই কমিটিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুস দিতে হয়৷ কাজটা পাওয়ার পর যাদের কাজ বা যারা টেন্ডার আহ্বান করেছে সেই নির্বাহী প্রকৌশলীকে টাকা দিতে হয়৷ এরপর ফাইলটি উপরে উঠতে যেসব ধাপ পেরোতে হয় তা হলো, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও মেয়র৷ এই ধাপগুলো পেরিয়ে কার্যাদেশ পাওয়া যায়৷ প্রতিটি ধাপেই টাকা দিতে হয়৷ তবে সৎ কর্মকর্তাও আছেন, যারা ঘুস নেন না৷ যারা নেন না তাঁদের টেবিলের জন্য বরাদ্দ অর্থ বেচে যায়৷''
অমিতোষ পাল জানান, ‘‘কাজটি শেষ হওয়ার পর বা মাঝখানে ঠিকাদারকে বিল পেতে আবার একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়৷ তখন ওই ধাপগুলো ছাড়াও ঘুসের তালিকায় আরো একটি বিভাগ যোগ হয়৷ আর তা হল অ্যাকাউন্টস সেকশন৷ সব মিলিয়ে যদি এক কোটি টাকার কাজ হয় তাহলে তার ৩০ ভাগ মানে ৩০ লাখ টাকা ঘুস হিসেবেই দিতে হয় ঠিকাদারকে৷ এরপর ভ্যাট ট্যাক্স মিলিয়ে দিতে হয় আরো প্রায় ২০ ভাগ৷ ঠিকাদার যদি কমপক্ষে ১০ ভাগও ব্যবসা করেন তাহলে এক কোটি টাকার টেন্ডারে কাজ হয় ৪০ লাখ টাকার৷ কিন্তু ঠিকাদারা ২০ থেকে ৩০ ভাগ লাভ করেন৷ তাই শেষ পর্যন্ত এককোটি টাকার কাজ বাস্তবে হয় ২০-৩০ লাখ টাকার৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘এ কারণেই একটি সড়ক যেখানে পাঁচ বছর টেকার কথা সেখানে তা এক বছরের বেশি টেকে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘সিটি করপোরেশনে একটি কাজে ঠিকাদারদের অন্তত ১৬ ধাপে ঘুস দিতে হয়৷ আর এটা স্বীকৃত৷ আমি এক্সপার্টদের সাথে কথা বলে দেখেছি৷ তারা মনে করেন কাজের এই ধাপগুলো কমিয়ে ঘুসের পরিমাণ হয়তো কমিয়ে আনা সম্ভব৷''
বাংলাদেশে এই সময়ে আলোচিত একটি ঘুসের ঘটনা হল এক থানার একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার৷ গত ২৭ ডিসেম্বর নরসিংদীর মনোহরদী থানার ওসি গাজী রুহুল ইমাম ওই এলাকার ব্যবসায়ী আসলাম শেখের কাছে ঘুস হিসেবে ৬৫ ইঞ্চি এলসিডি টিভি দাবি করেন, যার দাম তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা৷
আসলাম শেখ ও তার ভাই মো. সালাম শেখকে ভুয়া ডাকাতির মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ঘুস হিসেবে ওই টিভি দাবি করেন ওসি রুহুল ইমাম৷ দাবি অনুযায়ী টেলিভিশন না দেয়ায় পুলিশ পাঠিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের হেনস্তা করান ওসি৷ এমনকি টেলিভিশন দিলে এলাকাছাড়া করা এবং ডাকাতি মামলায় জেল খাটানোরও হুমকি দেয়া হয়৷
ঘুস হিসেবে টেলিভিশন দাবির ফোনালাপের রেকর্ড সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর অবশ্য ওই ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ভুক্তভোগী আসলাম শেখ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়ে ওসি'র টার্গেটে পরিণত হই৷ এরপর ৬৫ ইঞ্চি টিভি ঘুস হিসেবে দাবির টেলিফোন রেকর্ড সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলে আমি রক্ষা পাই৷ নয়তো আমাকে মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে ওই টিভি দিতেই হত৷ আর ওসিকে প্রত্যাহারের পর এখন অনেক ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে মনোহরদীর অনেকেই মুখ খুলছেন৷ ওসি'র ঘুস আদায়ের নানা কৌশল ও কাহিনী প্রকাশ পাচ্ছে৷''
থানায় ঘুসের অভিজ্ঞতার কথা ডয়চে ভেলেকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী৷ তিনি একটি মামলার বাদী৷ তিনি বলেন, ‘‘নির্মান কাজে চাঁদা দাবির ব্যাপারে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে আমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ প্রথমে মামলা করতে টাকা লেগেছে৷ এরপর আসে আসামি ধরার পালা৷ সেখানেও টাকা ছাড়া পুলিশ আসামি ধরবে না৷ দিলাম টাকা৷ কিন্তু মূল আসামিদের না ধরে এলাকার কয়েকজন নিরীহ লোককে ধরে আনে পুলিশ৷ এবার আমার উল্টো বিপদ৷ তাদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলে পুলিশ আমার কাছেও টাকা চায়, আটকদের কাছেও টাকা চায়৷ পরে অবশ্য আটকরা পুলিশকে কিছু দিয়ে ছাড়া পায়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি দেখলাম মামলা করে উল্টো আমিই বিপদে৷ পুলিশ ধীরে ধীরে আসামিদের প্রতি সদয় হয়৷ জানতে পারি, তাদের কাছ থেকেও পুলিশ টাকা নিয়েছে৷ মামলার তদন্ত এগোয় না৷ আমি তদবির করতে গেলে পুলিশ উল্টো বিরক্ত হয়৷ আর একদিন পুলিশ আমাকে আসামিদের ‘এলাকার ছেলে পেলে' বলে সমঝোতা করে নেয়ার প্রস্তাব দেয়৷ তারপর আমি মামলাটি নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি৷''
গড়ে ৯৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে সেবা নিতে যান৷ ২০১৬ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশের ১৬টি সেবাখাতে ঘুস নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করে৷ জরিপে দেখা যায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ ১৬টি খাতের সেবা পেতে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয় সেবা প্রার্থীদের৷
জরিপে অংশ নেয়া নাগরিকদের ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সেবা পেতে ঘুস দেয়ার কথা জানিয়েছেন৷ আর ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন৷
জরিপটি হয় ২০১৫ সালে৷ জরিপে বলা হয়, জাতীয় প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ৷ তুলানমূলক চিত্রে বলা হয়, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ১ হাজার ৪৯৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি ঘুস দিতে হয়েছে সেবা খাতে৷ টিআইবি এরপর আর ঘুসের জরিপ করেনি৷ তবে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই৷
ওই জরিপে আরো বলা হয়, ২০১৫ সালে পাসপোর্ট খাতে সেবা নিতে গিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি মানুষ ঘুস বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন৷ ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশকে পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে ঘুস দিতে হয়েছে৷ আর পাসপোর্ট অফিসের ১০০ জনের মধ্যে ৭৬ জনই ঘুস নিয়েছেন৷
২০১৫ সালে ভূমি প্রশাসন খাতে প্রায় ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ১ হাজার ৭০২ কোটি , বিদ্যুৎ খাতে ১ হাজার ৬১৩ কোটি, বিচারিক সেবা খাতে ৮০৮ কোটি টাকা ঘুস লেনদেন হয়৷ পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ ঘুসের কবলে পড়লেও এ খাতে ঘুসের পরিমাণগত অবস্থান সপ্তম৷ এ খাতে ঘুস লেনদেন হয়েছে ২৯৫ কোটি টাকা৷ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে হয়েছে ১৯২ কোটি টাকা৷
গড় হিসেবে গ্যাস সংযোগ নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুস দিতে হয়েছে৷ প্রতিটি খানায় যার গড় পরিমাণ ২৭,১৬৬ টাকা৷ এছাড়া বিমা খাতে ১৩,৪৬৫ টাকা, বিচারিক সেবায় ৯,৬৮৬ টাকা এবং ভূমি প্রশাসনে ৯,২৫৭ টাকা দিতে হয়েছে৷
দেশে সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা ও ঘুসের পরিমাণ উভয়ই বাড়ছে৷ ঘুস দিতে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ৷ ঘুসের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ৷ পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি ঘুসের শিকার হন৷ আর শহরের চেয়ে গ্রামে ঘুসের শিকার মানুষের সংখ্যা বেশি৷
টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জরিপে এটাও উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের ৬৭.৮ শতাংশ মানুষ ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন৷ এর মানে হল এখানে ঘুস না দিলে কাজ হয় না৷ সেবা পাওয়া যায় না৷ এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ঘুস বাংলাদেশের অন্যতম সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এরকম হওয়ার অন্যতম কারণ হল ঘুস খেলে বা দিলে যে শাস্তি পেতে হয়, বিচারের মুখোমুখি হতে হয়, এটা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘুস খেয়ে পার পাওয়া যায়৷ সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাড়ানোর সময় আশা করা হয়েছিল ঘুসের প্রবণতা কমবে৷ কিন্তু কমেনি৷ আর ঘুস খাওয়ায় সাথে অর্থনৈথিক দুরাবস্থার সম্পর্কও এখানে প্রমাণিত নয়৷ কারণ যে যত বড় পদে থাকেন তিনি তত বেশি ঘুস খান৷''
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘দুর্নীতির ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগসাজশ থাকে৷ এখানে যিনি ঘুস দেন আর নেন উভয়েরর অসৎ স্বার্থ থাকে৷ আর নানা খাতে অর্থ লোপাটের ঘটনা থাকে৷ দুর্নীতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা মূল ভূমিকা পালন করে৷ কিন্তু ঘুসের ক্ষেত্রে সেটা নাও হতে পারে৷ তবে সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশে ঘুস এখন আর সামাজিকভাবে নিন্দিত নয়৷ এটা অনেক সময় বাহবাও পায়৷ যা ভযাবহ৷''
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঘুস বিরোধী মনোভাব বেশ প্রবল বলেই মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান৷ ‘‘টিআই-এর এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ নিরাপত্তা ও ভরসা পেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়৷''
বিশ্লেষকরা অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশে ঘুস সংস্কৃতি কমে আসার একটি শুভ লক্ষণও দেখা গেছে৷ তা হল যে খাত যতটা বেশি ডিজিটালাইজড হচ্ছে সেই খাতে ঘুস তত কমছে৷ বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টারগুলো থেকে মানুষকে সেবা পেতে তেমন ঘুস দিতে হয় না৷ তাই ঘুস বন্ধে বিভিন্ন সেবা খাততে দ্রুত জিজিটাল করার পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক৷
আপনি কি কখনো ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন? মন্তব্য করুন নিচের ঘরে৷