1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘মুসলমানদের ভয়ে’ জার্মানি ছেড়ে পালানোর দাবি কি ঠিক?

ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম মূলত রাজনীতি, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, শরণার্থী এবং অভিবাসন সম্পর্কিত ইস্যু কভার করেন৷ পাশাপাশি জার্মানি ও ইউরোপে জীবনযাপনের নানা দিকও তুলে ধরেন তিনি৷
আরাফাতুল ইসলাম
৪ মে ২০২২

জার্মানির মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের মতো মুসলমান৷ কিন্তু তাদের জন্য দেশটির সংখ্যগরিষ্ঠ খ্রিস্টানদের ‘দেশ ছাড়ার মতো’ পরিস্থিতি কি আদৌ তৈরি হয়েছে?

https://p.dw.com/p/4AoYf
Deutschland - Muslimische Frauen
প্রতীকী ছবিছবি: picture-alliance/W. Rothermel

বিবিসির এক ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন' থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনার সূত্রপাত৷ ব্রিটিশ গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্যারাগুয়েতে চলে যাচ্ছেন ‘অনেক' জার্মান৷ আর এই যাওয়ার কারণ মূলত দুটি৷ প্রথমত, করোনা টিকা না নেয়া৷ দ্বিতীয়ত, জার্মানিতে মুসলমান অভিবাসীদের প্রতি তাদের ‘অস্বস্তি'৷

বিবিসির এই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় কারণটি নিয়ে আমার নিজেরই অস্বস্তি তৈরি হয়েছে৷ আমার কাছে মনে হচ্ছে এই কথিত কারণটি জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থি দলগুলোর মুসলমান এবং অভিবাসীবিরোধী প্রচারণার পালে নতুন করে হাওয়া দেবে৷ তাই এক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির সময় যতটা যত্নবান হওয়ার দরকার, বিবিসি ততটা ছিল না৷

Ehemalige Kolonie „Neu-Germania“ von Bernhard Förster in Paraguay
১৮৮৭ সালে ‘নিউ জার্মানি’ নামে প্যারাগুয়েতে একটি জেলা গড়ে তোলা হয়েছিলছবি: Jerzy Dabrowski/picture alliance

জার্মানদের প্যারাগুয়েতে গিয়ে বসবাস করার ঘটনা নতুন নয়৷ গত একশো বছর ধরেই চলছে এই চর্চা৷ আর শুধু প্যারাগুয়ে নয়, বিশ্বের আরো অনেক দেশে গিয়ে জার্মানরা এরকম আবাসন গড়েছে৷ 

অবশ্য, এটা সত্য যে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির পর আগের বছরের তুলনায় গতবছর বেশি সংখ্যক জার্মান নাগরিক নিজ দেশ ছেড়ে প্যারাগুয়ে এবং আরো কয়েকটি দেশে গিয়েছেন৷ প্যারাগুয়েতে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মানির ডয়চে ভেলে, টাগেসশাও, এসভেআর এবং ব্রিটেনের গার্ডিয়ানের মতো সংবাদমাধ্যমগুলো৷ আলাদা প্রতিবেদনগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে মূলত করোনা টিকা নিতে আগ্রহী নন এমন একদল জার্মান এই সময়ে প্যারাগুয়েতে আশ্রয় নিয়েছেন৷

এসব প্রতিবেদনের কোনোটিতে সাম্প্রতিক সময়ে ‘মুসলমানদের কারণে সৃষ্ট অস্বস্তিতে' জার্মানদের প্যারাগুয়ে যাওয়ার কথা উঠে আসেনি৷ এটা কিছুটা বিস্ময়কর৷ যদি মুসলমানদের বিষয়টিও টিকা না নেয়ার পাশাপাশি একটি বড় কারণ হয় তাহলে এসব মূলধারার প্রথমসারির গণমাধ্যমের কেন এটা চোখে পড়লো না তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত৷ 

German anti-vaxxers in Paraguay — hello, goodbye!

প্যারাগুয়েতে জার্মান বংশোদ্ভূত অভিবাসীর সংখ্যা জার্মান সরকারের হিসেবে ২৬ হাজারের মতো৷ এরা শুধু গতবছর নয়, গত কয়েকদশকে দেশটিতে গিয়েছেন৷ তাহলে গতবছর ঠিক কতজন জার্মান জার্মানি ছেড়ে প্যারাগুয়েতে স্থায়ী আবাস গড়েছেন?

এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে খুঁজে পাইনি৷ তবে প্রতিবেদনগুলো সংখ্যাটি কয়েকশোর মধ্যে রাখছে, কয়েক হাজার নয়৷

গত কয়েকদিনে একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, তাহচ্ছে বিবিসির প্রতিবেদনটিকে কোট করে উগ্র ডানপন্থি বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্লগ, সংবাদপত্রে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে৷ তাদের এমন চর্চাও নতুন নয়৷ 

তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ২০১৫ সালে সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য জার্মানির দরজা খুলে দিলে মধ্যপ্রাচ্যের ১০ লাখের মতো মানুষ ইউরোপের দেশটিতে প্রবেশ করে৷ এই শরণার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মুসলমান৷

ম্যার্কেলের এই মহানুভবতা জার্মান সমাজের একটি বড় অংশ এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক প্রশংসিত হলেও একটি গোষ্ঠী সেটি থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করে৷ অভিবাসী ও মুসলমানবিরোধী হিসেবে পরিচিত উগ্র ডানপন্থি দল ‘অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড' বা এএফডি প্রচারণা শুরু করে যে জার্মানিতে ইসলামের কোনো স্থান নেই৷ এবং তাদের কারণে জার্মানির নিরাপত্তা নষ্ট হতে পারে৷ জার্মানরা ঝুঁকিতে পড়তে পারেন৷

এএফডির সেই প্রচারণার পালে শুরুতে বেশ হাওয়া লেগেছিল৷ দলটি রাতারাতি জার্মানির তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়৷ তবে মুসলমান শরণার্থীদের নিয়ে যে শঙ্কার কথা দলটি জানিয়েছিল, দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সেই শঙ্কার কোনো বাস্তব প্রমাণ মেলেনি৷ বরং সেই শরণার্থীরা এখন জার্মানির অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখছেন নানা খাতে কর্মীর চাহিদা পূরণ করে৷

এএফডিও গত কয়েকবছরে নিজেদের জনপ্রিয়তা আর বাড়াতে পারেনি৷ সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য উগ্র ডানপন্থিরা করোনা লকডাউন, টিকার বিরোধিতা করে রাজনীতির কিছুটাক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু তাও ধোপে টেকেনি৷ 

Arafatul Islam Kommentarbild App
আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলে

প্যারাগুয়েতে চলে যাওয়া জার্মানদের একটি অংশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিত্যাগ করা নাৎসি৷ সেদেশের জার্মান অভিবাসীদের একাংশের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উগ্র ডানপন্থি মানসিকতার বহিঃপ্রকাশের কথা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে

যদিও প্যারাগুয়েতে ইসলাম ধর্মালম্বীরাও সুখেশান্তিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন, তারপরও সেদেশে যাওয়া দুয়েকজন জার্মান মুসলমানদের প্রতি তাদের ‘অসন্তোষ' থেকে প্যারাগুয়েতে গিয়ে থাকার কথা বলে থাকতে পারেন৷

বিবিসি ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের' নামে শুধু তাদের কথা প্রকাশ করেছে, কিন্তু তারা কোন প্রেক্ষাপটে, কোন আদর্শ থেকে সেকথা বলছেন এবং সেই কথার সঙ্গে জার্মানির বর্তমান পরিস্থিতির কতটা মিল রয়েছে তা আর অনুসন্ধান করেনি৷ এটা এই প্রতিবেদনের ঘাটতি যা উগ্র ডানপন্থিদের হাতে মুসলমানবিরোধী প্রচারণা চালানোর এক অস্ত্র তুলে দিয়েছে৷