মায়াবি রাতে সামির দুর্দান্ত বোলিংয়ে ফাইনালে ভারত
১৫ নভেম্বর ২০২৩বিরাট কোহলি করেছেন ঐতিহাসিক ৫০তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। তবে ৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা মোহাম্মদ সামি।
অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেল মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। এখানেই ২০১১ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। সেই ওয়াংখেড়েতেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটেছে দুই বিশ্বকাপে। ১৯৮৭ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড ৩৫ রানে হারিয়েছিল ভারতকে। ২০১৬-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মহেন্দ্র সিং ধোনিদের স্তব্ধ করে দিয়েছিল ওয়েস্টইন্ডিজ।
ওয়াংখেড়ের বাইরে ২০১৫ ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও হেরেছে ভারত। আজ সেই গেরোটা খুললো রোহিত শর্মার দল। টানা দুবার ফাইনাল খেলা নিউজিল্যান্ডকে ওয়াংখেড়েতে হারাল ৭০ রানে।
রান উৎসবের ম্যাচে ৫৭ রানে ৭ উইকেট নিয়ে আবারও মোহাম্মদ সামি চিনিয়েছেন নিজের জাত। প্রথম ভারতীয় ও সব দেশ মিলিয়ে পঞ্চম বোলার হিসাবে বিশ্বকাপে এক ম্যাচে ৭ উইকেট নেওয়ার কীর্তি তাঁর।
খেলা শুরুর অনেক আগেই ওয়াংখেড়ে হয়ে গিয়েছিল নীল সমুদ্র। সেখানেই বিরাট কোহলি ফুটিয়েছেন নীল পদ্মফুল। শচীন টেন্ডুলকারকে পেছনে ফেলে গড়েছেন ওয়ানডেতে ৫০ সেঞ্চুরির রেকর্ড। তাতে বিমোহিত টেন্ডুলকারও। করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাকে। গ্যালারিতে টেন্ডুলকারকে দেখে কুর্নিশ করেছেন কোহলিও।
পুরো স্টেডিয়াম সাক্ষী হলো অনন্য এক মাহেন্দ্রক্ষণের। তিন অংকে পা রাখার পর উচ্ছ্বাসে যখন কোহলি লাফ দিয়েছেন শূন্যে, পুরো গ্যালারি তখন দাঁড়িয়ে অভিনন্দনে সিক্ত করছিল এই কিংবদন্তিকে। ইনিংস শেষে কোহলি বলছিলেন,‘‘গ্যালারিতে শচীন পাজি ছিলেন। আমার জীবনসঙ্গী ছিল। তখন ঠিক কী মনে হচ্ছিল বোঝানো সম্ভব নয়।''
কথা বলে মঞ্চটা ছাড়ার সময়ই এগিয়ে গিয়ে কোহলিকে জড়িয়ে ধরেন টেন্ডুলকার। তৈরি হয় মায়াবি এক মুহুর্ত। ভিভ রিচার্ডস, বীরেন্দর শেবাগরাও ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেন কোহলিকে। সেঞ্চুরির নতুন রাজাকে বরণের এর চেয়ে ভালো উপলক্ষ্য আর কী হতে পারতো?
কোহলি ৫০তম সেঞ্চুরিটি করলেন ২৭৯তম ইনিংসে। টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারে ৪৫২ ইনিংসে সেঞ্চুরি ৪৯টি। টেন্ডুলকার মাঠে থেকেই টুইটারে অভিনন্দন জানান কোহলিকে।
৩৯৭ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে জাসপ্রিত বুমরাহর প্রথম বলটাই পয়েন্ট দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠান ডেভন কনওয়ে। সেই ওভারে আসে ৮ রান। তবে পাওয়ার প্লেতেই দুই ওপেনারকে ফিরিয়ে দেন এ পর্যন্ত স্বপ্নের এক বিশ্বকাপ খেলা মোহাম্মদ সামি। ১৩ রান করা কনওয়ের দূর্দান্ত ক্যাচ বাম দিকে ঝাঁপিয়ে নেন উইকেটরক্ষক লোকেশ রাহুল। বিশ্বকাপে নতুন তারকা হয়ে ওঠা রাচিন রবীন্দ্রও ঠিক ১৩ করোু ক্যাচ দেন রাহুলকে।
৩৯ রানে ওপেনারদের হারিয়েও দমে যায়নি নিউজিল্যান্ড। অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন ও ড্যারিল মিচেল শুরু করেন প্রতিরোধ। ১০ ওভারে ৪৬ করা কিউইদের স্কোরটা তাই ২০ ওভার শেষে পৌঁছে যায় ১২৪-এ।
এবারের বিশ্বকাপে ধর্মশালায় ভারতের বিপক্ষে ১৩০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন মিচেল। সেটা ছাড়িয়ে আজ খেলেছেন ক্যারিয়ার-সেরা ১৩৪ রানের ইনিংস। তবে উইলিয়ামসনের সঙ্গে জুটিটা ভাঙার পর খেই হারিয়ে ফেলে কিউইরা। উইলিয়ামসনের সহজ ক্যাচ ফেলা মোহাম্মদ সামিই কিউই তাকে ফিরিয়ে ভাঙেন ১৮১ রানের জুটি। ছক্কা মারতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে সূর্যকুমারকে ক্যাচ দেন ৭৩ বলে ৬৯ করা উইলিয়ামসন।
একই ওভারে টম ল্যাথামকেও এলবিডাব্লিউর ফাঁদে ফেলেন সামি। ৩ বলের ব্যবধানে ২ উইকেট নিয়ে সামিই ভারতকে পুরোপুরি ম্যাচে ফেরান। বিশ্বকাপে ১৭ ইনিংসে দ্রুততম ৫০ উইকেটের মাইলফলকেও পা রাখেন এই পেসার। ১৯ ইনিংসে আগের রেকর্ডটা ছিল মিচেল স্টার্কের।
দ্রুত দুই উইকেট হারানোয় রানের গতি কমে যায়। শেষ ৮ ওভারে কিউইদের দরকার ছিল ১১০ রান। সেই চাপেই জাসপ্রিত বুমরাহকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ওয়াইড লংঅনে রবীন্দ্র জাদেজাকে ক্যাচ দেন গ্লেন ফিলিপস (৩৩ বলে ৪১)।
একটা প্রান্ত আগলে লড়াই করা ড্যারিল মিচেলকে ডিপ মিডউেইকেটে জাদেজার ক্যাচ বানিয়ে ফেরান সামি। এবারের বিশ্বকাপে তিনবার পাঁচ উইকেট নিলেন সামি। মিচেলের পর সামি ফেরান টিম সাউদি ও লকি ফার্গুসনকে। ছয় ম্যাচে তাঁর উইকেট ২৩টি, যা এবারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ। শুরুর দিকে তাকে বেঞ্চে না বসালে কোথায় থামতেন সামি?
ওয়াংখেড়ে মানেই তারার মেলা। আজও অনেক তারকা ছিলেন গ্যালারিতে। তাদের মাঝে আলো ছড়াচ্ছিলেন ইউনিসেফের দূত হয়ে আসা ডেভিড বেকহাম। ইংল্যান্ড ফুটবলের সাবেক এই তারকা শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে মাঠেও নেমে পড়েন খেলা শুরুর আগে।
বেকহামের সঙ্গে কথা বলতে প্যাড পড়েই এগিয়ে যান বিরাট কোহলি। তখন টেন্ডুলকারও পাশে ছিলেন। তখন হয়ত মনে মনে বলছিলেন, ‘‘সেমিফাইনালে আমার ৪৯তম সেঞ্চুরির রেকর্ডটা ভেঙে ফেলো।''
কোহলি শুধু সেঞ্চুরির রেকর্ড নয়, ভেঙেছেন টেন্ডুলকারের আরও দুটি কীর্তি। বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ ৬৭৩ রানের রেকর্ড ছিল শচীন টেন্ডুলকারের। ২০০৩-এ ১১ ইনিংসে করেছিলেন এই রান। আজ তাকে পেছনে ফেললেন কোহলি। এবারের আসরে তাঁর রান ৭১১।
এছাড়া বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ সাতটি করে ৫০ ছাড়ানো ইনিংস ছিল শচীন টেন্ডুলকার ও সাকিব আল হাসানের। আজকের ইনিংসটি নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে কোহলির ৫০ ছাড়ানো ইনিংস হয়ে গেল আটটি।
টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি রোহিত শর্মা। টসের আগেই অবশ্য বিতর্ক হয়েছে পিচ নিয়ে। ভারতীয় দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও ইংল্যান্ডের ডেইলি মেইল দাবি করেছিল, ভারতের চাওয়ায় পিচ বদলে মন্থর করে দেওয়া হয়েছে, উইকেটের ঘাসও নাকি কাটা হয়েছে।
আইসিসি ইভেন্টে স্বাগতিক দল এমন কিছু চাইতে পারে না বলে, প্রশ্নও্ ছুঁড়ে দেয় এই দুটি দৈনিক। তবে কারও দিকে আঙুল না তুলে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন শুধু টসের পর এইটুকু বলেছেন,‘‘এটা ব্যবহৃত পিচ। আমিও আগে ব্যাটিং নিতাম।'' টুর্নামেন্ট চলার সময় ব্যবহৃত পিচে খেলাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে বিবৃতিও দেয় আইসিসি।
হাতের তালুর মতো চেনা এই পিচে দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শুভমান গিল উড়ন্ত সূচনা এনে দেন ভারতকে। গড়েন ৭১ রানের জুটি। প্রথম ৫ ওভারে ভারতের স্কোর ছিল ৪৭ আর ১০ ওভারে ৮৪।
নীল সমুদ্রে পরিণত হওয়া ওয়াংখেড়েতে ‘হিটম্যান'খ্যাত রোহিত ভাঙেন ছক্কার দুটি রেকর্ড।
আজ ৪৭ রানের ইনিংসটি রোহিত সাজান ৪ বাউন্ডারি ও ৪ ছক্কায়। এই বিশ্বকাপে তার ছক্কা ২৮ আর সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে ৫১টি, দুটিই রেকর্ড। টিম সাউদির বলে ছক্কা মারতে গিয়ে মিড অফে কেন উইলিয়ামসনকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন রোহিত।
ওয়ানডে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে বিরাট কোহলি বিবর্ণই ছিলেন এতদিন। ২০১১ সালের সেমিফাইনালে ৯, ২০১৫ বিশ্বকাপে ১ আর ২০১৯-এ আউট হয়েছিলেন ১ রানে। আজ ১১৭ রানের ইনিংস খেলে ব্যর্থতার সেই অতীত থেকেও বেরিয়ে আসেন কিং কোহলি।
শুভমান গিলের সঙ্গে কোহলি দ্বিতীয় উইকেটে গড়েন ৯৩ রানের জুটি। রোহিত ফেরার পর আক্রমণের ধার বাড়িয়েছিলেন গিল। ফিফটি করেন ৪১ বলে, এবারের বিশ্বকাপে সর্বশেষ চার ইনিংসে এটা তার তৃতীয় পঞ্চাশ ছাড়ানো ইনিংস। তবে সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাওয়া গিলকে ক্রিজ ছাড়তে হয় ইনজুরিতে পড়ে। ক্র্যাম্পে মাঠ ছাড়ার আগে ৬৫ বলে ৮ বাউন্ডারি ৩ ছক্কায় ৭৯ করেছিলেন তিনি। পরে ফিরে এসে করেন ১ রান।
গিল ইনজুরিতে মাঠ ছাড়ার পর ভারত ধাক্কাটা সামলায় কোহলি ও শ্রেয়াস আইয়ারের ১৬৩ রানের জুটিতে। এবারের বিশ্বকাপটা স্বপ্নের মতোই কাটছে কোহলির। গ্রুপ পর্বে তার নয়টি ইনিংস ৮৫, ৫৫*, ১৬, ১০৩*, ৯৫, ০, ৮৮, ১০১* ও ৫১ রানের। ওয়াংখেড়েতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগিয়েও আউট হয়েছিলেন ৮৮ রানে। টেন্ডুলকারের সামনে তাই ছোঁয়া হয়নি তার ৪৯ ওয়ানডে সেঞ্চুরির কীর্তি। পরের ম্যাচেই অবশ্য গড়েছিলেন রেকর্ডটা।
সেদিন অভিনন্দন জানিয়ে টেন্ডুলকার প্রত্যাশা করেছিলেন,পরের সেঞ্চুরিটা করে তাকে পেছনে ফেলতে খুব বেশিদিন নেবেন না কোহলি। টেন্ডুলকারের কথাই সত্যি হলো। ইডেনে সেঞ্চুরির এক ম্যাচ পরই ঐতিহাসিক ৫০-এ পা রাখলেন কিং কোহলি। সেঞ্চুরির কিছুক্ষণ পরই শেষ হয় ১১৩ বলে নয়টি বাউন্ডারি দুইটি ছক্কায় ১১৭ রানের ইনিংসটি। সাউদির বলে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন ডেভন কনওয়েকে। মাঠ ছাড়ার সময় আরও একবার গ্যালারি কুর্নিশ করে এই কিংবদন্তিকে।
টানা দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন শ্রেয়াস আইয়ার। তিনি খেলেন ৭০ বলে ১০৫ রানের ইনিংস। চার নম্বর জায়গাটা নিয়ে ভারতের মাথা ব্যথাও কেটে যাওয়ার কথা তাতে। এছাড়া লোকেশ রাহুল অপরাজিত ছিলেন ২০ বলে ৩৯ রান করে। ভারত থামে ৩৯৭ রানে যা বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ও নকআউট পর্বের সর্বোচ্চ। সেমিফাইনালে আগের সেরা ছিল ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ৭ উইকেটে ৩২৮। আর নকআউটে পর্বে ২০১৫ সালের কোয়ার্টার্ ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ড করেছিল ৩৯৩।
এই নিউজিল্যান্ডের কাছে গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হেরে স্বপ্ন ভেঙেছিল ভারতের। এবার গ্রুপ পর্বে কিউইদের হারিয়ে প্রতিশোধ নেয় রোহিতরা। আজকের জয়ে সেটা মধুর হলো আরও।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
ভারত ৫০ ওভারে ৩৯৭/৪ (কোহলি ১১৭, শ্রেয়াস ১০৫, গিল ৮০ ; সাউদি ৩/১০০, বোল্ট ১/৮৬)
নিউজিল্যান্ড ৪৮.৫ ওভারে ৩২৭ (মিচেল ১৩৪, উইলিয়ামসন ৬৯, ফিলিপস ৪১ ; সামি ৭/৫৭, বুমরাহ ১/৬৪)
ফল : ভারত ৭০ রানে জয়ী।
ম্যাচেসেরা : মোহাম্মদ সামি