‘মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হতে হবে’
১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশ বহু জাতির দেশ, ক্ষুদ্র জাতিগুলো হারিয়ে যাওয়ার কারণে এই স্বকীয়তা কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে?
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান: আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতার বছর থেকে দেখি, এখানে জনসংখ্যার মধ্যে যে বহু মাত্রিকতা ছিল, বহু জাতির, বহু জনগোষ্ঠীর যে সম্মীলন ছিল, সেই চরিত্রটা কিন্তু আমরা অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেছি৷ এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে জাতিসত্ত্বা টিকে থাকবে এবং অন্যদের খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার সুযোগ থাকবে না৷ তাহলে অদূর ভবিষ্যতে তারা একদম হারিয়ে যাবে এমনটা কল্পনা করাটা একদমই অবাস্তব হবে বলে মনে হয় না৷
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর জমির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো দলিল নেই৷ ফলে দ্রুতই তাঁদের জমি দখল করা যায়৷ এ কারণেই কি প্রভাবশালীদের আক্রোশের শিকার হচ্ছেন তাঁরা?
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীই যে জমির মালিকানা হারাচ্ছে, শুধু তা কিন্তু নয়৷ ধর্মীয় অর্থে যারা সংখ্যালগিষ্ঠ, তাঁদেরও জমি-জমা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে৷ তাঁদের যে দলিল নেই এ কারণে নয়, অন্য কারণেও তাঁদের জমির মালিকানা হারিয়ে যাচ্ছে৷ আর ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠী যৌথ মালিকানায় বিশ্বাস করে, গোষ্ঠী মালিকানায় বিশ্বাস করে৷ আমরা ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাস করি৷ অনেকের দৃষ্টিতেই, এমনকি আমিও মনে করি, যৌথ মালিকানা অনেক বেশি সভ্য একটি রীতি, ব্যক্তি মালিকানার চাইতে৷ সভ্যতাকে আমরা হটিয়ে দিয়ে সেখানে ব্যক্তি মালিকানার হিংস্রতা বা পাশবিকতাকে লালন করছি৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ যে সম্প্রদায় তাঁরা অন্যের জমি হাতিয়ে নিচ্ছে, এটা বলাই বাহুল্য৷
অধ্যাপক আবুল বারাকাত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন৷ এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ৩০ বছর পর দেশে আর হিন্দু থাকবে না৷ আপনিও কি তা মনে করেন?
আমি নিজেই বছর তিনেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে বলেছিলাম, সংখ্যালঘুদের অবস্থা যে প্রান্তিকতায় পৌঁছেছে এবং যে প্রক্রিয়ায় তাঁরা বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, এই প্রক্রিয়া অব্যহত থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে কোনো হিন্দু বাংলাদেশে থাকবেন বলে মনে হয় না৷ এটি সচারচর সাধারণ প্রক্রিয়ায় আমরা এটা দেখি৷ এই ধরনের ঘটনা যদি ঘটতে থাকে, যেটা নাসিরনগরে ঘটেছে, যেটা মনিরামপুরে ঘটেছে বা সাথিয়াতে ঘটেছে, এই ঘটনা যদি বারংবার ঘটতে থাকে, তাহলে যে ধরনের অনিরাপত্তার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে করে ২০ বছরও লাগবে বলে মনে হয় না৷ এই বিষয়টি রাষ্ট্রকে অতিগুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে৷ এবং আমাদের যে বহুমাত্রিকতা সেটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে রাষ্ট্রকে দৃঢ় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে৷
ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীগুলো কেন দেশ ছেড়ে যাচ্ছে?
ওরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে নানাবিধ কারণে৷ কে মাতৃভুমি ছেড়ে চলে যেতে চায়? আপনি যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাহলে থাকবার যে ইচ্ছেটুকু সেটা কিন্তু থাকে না৷ সবসময় যে রাষ্ট্রীয় মদদে এই কাজটি হচ্ছে সেটা কিন্তু বলা যাবে না৷ আমাদের এখানে কিছু ব্যক্তিকায়েমী স্বার্থ গড়ে উঠেছে৷ অধ্যাপক আবুল বারাকাত যাদের বলছেন, দোষীচক্র৷ এই গ্রুপটি অনেক সময় এত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে যে তারা রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই সমস্ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে৷ মানুষজনের ভূমি হাতিয়ে নিচ্ছেন এবং তাঁদের বাস্তচ্যূত করছেন৷ এখানে সংখ্যালঘুদের অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, তারা সারারাত লাঠিসোঁটা নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে, ভোর ৫টার দিকে যখন ঘুমাতে যাচ্ছে, তখন তাদের বাড়ি ঘরে-মন্দিরে আগুন দেয়া হচ্ছে৷ তাহলে বুঝতে হবে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোন জায়গায় চলে গেছে৷ সেখানে এদের নির্মূল করার জন্য যদি আমরা দৃঢ় ও শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তাহলে এই ধরনের ঘটনা বারংবার ঘটবে৷ এই দোষীচক্রের সংখ্যা কিন্তু বাংলাদেশে বেড়ে যাচ্ছে৷
ভাষাগত সমস্যার কারণে ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা উচ্চশিক্ষায় তাঁদের অংশগ্রহণ কম৷ ফলে তাঁদের একমাত্র পেশা চাষাবাদ বা কৃষি৷ কী করে এর সমাধান হতে পারে?
রাষ্ট্রকে মানবিক হতে হয়৷ মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হয়৷ রাষ্ট্রকে মনে করতে হয় সব ভাষাভাষী মানুষই আমার নাগরিক৷ তাঁদের অধিকার যেন তাঁরা ভোগ করতে পারে৷ রাষ্ট্র এই ধরনের চিন্তা নিয়ে এগোলে আপনার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়৷ রাষ্ট্র তখন উপযাচক হয়ে শিক্ষার অধিকারটি সুরক্ষিত রাখবে৷ পুঁজিবাদের মধ্যে আমরা আমাদের এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছি, সেখানে শোষণ হচ্ছে নিত্যকার সত্য ও স্বাভাবিক ঘটনা৷ আমরা তো চাই তারা ভৃত্য হয়ে সারাজীবন কাটাক৷ আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায়ই মালিক ও ভৃত্য সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখছি৷ যতক্ষণ অসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন না হচ্ছে, ততক্ষণ এটা চলতেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক৷
আমরা দেখি, তাঁদের উপর যে নির্যাতন হয়েছে, এই নির্যাতনের মামলাগুলোরও বিচার শেষ হচ্ছে না৷ তাঁদের দাবির পক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বর না থাকার কারণেই কি তাঁরা বিচার পাচ্ছে না?
দেখুন, ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য আমাকে দাবি করতে হবে কেন? যে সমাজে আইনের শাসন রয়েছে সেখানে আইন আইনের গতিতেই চলবে৷ আপনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে৷ কিন্তু আমাদের এখানে বিচারহীনতাই এখন সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বিচারহীনতা যেখানে নিত্যকার ঘটনা হয়, সেখানে আপনাকে বিচার পাওয়ার জন্য দাবি তুলতে হয় এবং সেখানে আপনি যদি দাবি না করেন বা আপনার শক্তি না থাকে, তাহলে আপনি বিচারকেও প্রভাবিত করতে পারেন না, যার জন্য আপনি ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন৷ এ রকম যে অহরহই ঘটছে, যাঁরা ভোগান্তির শিকার, তাঁরা সবাই জানেন৷ অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ কিন্তু রাষ্ট্রীয় যে বিচার ব্যবস্থা সেই আদালতপাড়া থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই অধিক আগ্রহ বোধ করেন৷ অনেকে কিন্তু ন্যায্য অধিকার ছেড়ে দিচ্ছেন৷ কিন্তু আদালত পাড়ায় যাওয়া-আসার জন্য যে হেনস্থা সেটার চাইতে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলাটা তাঁরা গ্রহণযোগ্য হিসেবে মনে করছেন৷
আদিবাসী ফোরামের এক জরিপে দেখা গেছে, ১০ বছর আগে পটুয়াখালির কুয়াকাটায় তিন লাখ রাখাইন ছিল৷ সম্প্রতি এখন সেই সংখ্যা আড়াই হাজার৷ এই যে বিপুল সংখ্যক মানুষ সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছে, সেটার কারণ কী মনে হয় আপনার কাছে?
রাখাইনদের বিষয়টা একটু আলাদা৷ তাঁরা কিন্তু উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে৷ জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বারংবার যে ঝড় বা সাইক্লোনের যে ধাক্কা, সেটা আগে যেমন আবহাওয়ার একটা পূর্বাভাস পাওয়া যেত, এখন কিন্তু সেই পূর্বাভাষ পাওয়া যায় না৷ যখন-তখন আঘাত হানছে৷ তাতে আপনি সর্বহারা হচ্ছেন এবং বাস্তুচ্যুত হয়ে যাচ্ছেন৷ এই কারণে কিন্তু অনেকে সেখান থেকে সরে যাচ্ছেন৷ তাঁরা যে কোথায় চলে গেছেন, আমাদের দেশে যেহেতু কোনো ডেটা সেভাবে সংরক্ষণ করা হয় না, ফলে এটা জানা যাচ্ছে না৷ তাঁদের যে জমিজমায় থাবা মারা হচ্ছে, দখল করা হচ্ছে, এটাও কিন্তু সত্য৷ নানাবিধ কারণে তাঁদের সংখ্যা এভাবে কমে যাচ্ছে৷
এই পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় কী? আর এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে বাংলাদেশের মৌলিকত্ব কি এক সময় হারিয়ে যাবে না?
আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিতে সব সময় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খিষ্ট্রান, বাঙালি, অবাঙালি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী একসঙ্গে বসবাস করেছি৷ এই যে বহুমাত্রিকতা এটাই কিন্তু বাংলাদেশের সৌন্দর্য৷ এই সৌন্দর্য যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের যে বাংলাদেশ, ৭২-এর সংবিধানের যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ সেই বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে এই সমস্যাগুলো আপনা-আপনি সামাধান হয়ে যাবে৷ নাহলে আমরা একমাতৃক জাতির দিকে ধাবিত হব৷ আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা বা জাতিগত যে বৈচিত্র্যতা সেটা হারিয়ে যাবে৷ আপনার আশঙ্কাটি কিন্তু উড়িয়ে দেবার মতো আশঙ্কা নয়৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷