মুক্ত সাংবাদিকতা সূচকে বাংলাদেশের আরো অবনতি
৩ মে ২০২৪তবে বাংলাদেশের তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তাদের এই সূচক প্রশ্নবিদ্ধ। তারা ভুল তথ্য এবং প্যারামিটারের ভিত্তিতে এই সূচক করে। আমরা তাদের ভুল তথ্য এর আগে ধরিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের অবস্থা আগে চেয়ে অনেক ভালো।”
এই সূচকে বিশ্বের গণমাধ্যমের অবস্থা যে ২০টি দেশে সবচেয়ে খারাপ তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে আজারবাইজান, নিকারাগুয়া ও রাশিয়া। আর বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে সৌদি আরব, বেলারুশ ও কিউবা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপ ৫১, ভুটান ৭০, ভারত ১০৫, নেপাল ১১৮, আফগানিস্তান ১৪৯, পাকিস্তান ১৫৯, শ্রীলঙ্কা ১৬২, বাংলাদেশ ১৬৫, মিয়ানমার ১৭০। বাংলাদেশ এখানে শুধুমাত্র মিয়ানমারের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। বিশ্বের মুক্ত গণমাধ্যমের শীর্ষ দেশ হলো নরওয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৫৫। আর জার্মানি আছে ১০ম অবস্থানে।
আরএসএফ পাঁচটি বিষয়েরও ওপর এই সূচক নির্ধারণ করে। সেগুলো হলো, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনি অবকাঠামো, অর্থনেতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং নিরাপত্তা।
২০০৯ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১ তম। সেই বিবেচনায় ১৫ বছরে বাংলাদেশের ৪৪ ধাপ অবনতি হয়েছে। একমাত্র ২০১৬ সাল ছাড়া প্রতিবছরই বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। ২০০২ সাল থেকে আরএনএ্ফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর হিসাবে গত বছর বাংলাদেশে ৩৬৫ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। হত্যার শিকার হয়েছেন দুইজন। এ ছাড়া ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ জন। দেশের ১২টি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং এইচআরএসএসের তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিটের তথ্যের ভিত্তিতে তারা ওই তথ্য প্রকাশ করে।
আর আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ২০২৩ সালে ২৯০ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার এ সাংবাদিকদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৮ সংবাদকর্মী। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির মাধ্যমে লাঞ্চিত ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বাধা প্রদানের শিকার হয়েছেন ২২ সাংবাদিক।
আরএসএফ বলছে, "বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ডিএসএ সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বে সবচেয়ে কঠোর আইনের মধ্যে অন্যতম। এই আইন কোনো পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার বা তল্লাশি এবং যে কোনো কারণে সাংবাদিকের সূত্রের গোপনীয়তা লঙ্ঘন অনুমোদন করে৷”
"এই ধরনের আইনগত পরিবেশে, সম্পাদকরা নিয়মিত নিজেদের সেন্সর করেন,” বলছে আরএসএফ।
আর গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৪৫১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)-তে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯৭ জনকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ড.আলী রীয়াজ ‘দ্য অর্ডিল: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাঁচ বছর' শীর্ষক গবেষণাপত্রে গত মঙ্গলবার এমন তথ্য তুলে ধরেন। তিনি ওয়েবিনারের মাধ্যমে তুলে ধরা এই গবেষণা পত্রে বলেন, "তাদের মধ্যে ২৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের লেখা রিপোর্টের জন্য। আর গ্রেপ্তার হওয়া ৯৭ জন সাংবাদিকের মধ্যে ৫০ জন স্থানীয় সাংবাদিক (জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের)।”
বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার ‘প্রতিপক্ষ'
২০২০ সালের এপ্রিলে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে সেই সময়ের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভিনের নির্দেশে মাদক দিয়ে আটক করে নির্যাতন ও ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে শাস্তি দেয়া হয়। তার ‘অপরাধ' ছিল জেলা প্রশাসক সরকারি টাকায় সরকারি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে ‘সুলতানা সরোবর' নাম দিয়েছেন- এমন একটি প্রতিবেদন করা। আরিফুলকে সাজা দেয়ার খবরে তখন সারাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে আরিফুল জেলা প্রশাসক সুলতানাসহ প্রশাসনের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। আরিফুল জানান, "আমি যে মামলা করেছি তার এখন পর্যন্ত তদন্তই শেষ হয়নি। তারা ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়ার পরও কখনোই আদালতে হাজির হননি এবং জামিন নেননি। উল্টো তাদের সবার পদোন্নতি হয়েছে। তারা প্রশাসনে এখনো চাকরি করছেন।”
তার মতে," দেশের জেলা ও থানা পর্যায়ে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে প্রধান বাধা পুলিশ ও প্রশাসন। নানা আইনে মামলা করে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়। মালিক পক্ষও সাংবাদিকদের পক্ষে দুই-একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া অবস্থান নেন না। আর সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো রাজনৈকিভাবেক বিভক্ত হয়ে তাদের ব্যক্তি স্বার্থে কাজ করে, সাংবাদিকদের জন্য নয়।”
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-র সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল মনে করেন," যারা তথ্য গোপন করতে চায়, তারাই স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে প্রধান বাধা। তারা সরকার হতে পারে, রাজনৈতিক দল হতে পারে, কর্পোরেট হাউজ হতে পারে, সরকারি কর্মকর্তা হতে পারে। আরেকটি হলো তার চাকরির নিরাপত্তা। তৃতীয়ত হলে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলেই স্পষ্ট হবে কারা স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা।”
বিএফইউজের মহাসচিব দীপ আজাদ বলেন, "কোনো সরকার, সেটা যে-কোনো দেশেই হোক তারা যে সাংবাদিকবান্ধব হবে তা আমি মনে করি না। আর সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে দুঃস্থ সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা করেও সাংবাদিকবান্ধব হওয়া যায় না। সুস্থ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সরকার কী করছে সেটাই সরকার স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে কিনা তার মাপকাঠি।”
তার কথা," সাংবাদিকদের ইউনিয়গুলো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হওয়ার কারণে সাংবাদিকরাই আবার অনেক তথ্য প্রকাশ করে না। যে কথা বলা দরকার তা বলে না। আর যারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ তারাও এর সুযোগ নেয়।”
মনবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফসাল বলেন," বাংলাদেশে এখন মুক্ত গণমাধ্যমের পথে প্রধান অন্তরায় সরকার। তারপরে সরকারে প্রনয়ণ করা নানা ধরনের আইন। তৃতীয় হলো সংবাদমাধ্যমের কর্পোারেট মালিকানা। ”
তার কথা, " সাংবাদিকরা এখন ভীতার সাংস্কৃতির শিকার। এই কারণে তারা ভয়ে অনেক কিছু প্রকাশ করেন না। আবার এখন দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা সাংবাদিকও আছেন। তারা স্বাধীন সাংবাদিকতার বিপক্ষে কাজ করেন। আবার সংবাদমাধ্যমের মালিকরা সাংবাদিকদের ঠিকমতো বেতন দেন না । ফলে কোনো সাংবাদিক অর্থনৈতিক অসততায় জড়িয়ে পড়েন। এটাও স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষতি করে।”
তবে আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান মনে করেন," বাংলাদেশে যে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, তা কিন্তু মনে হয় না। তবে এখানে এক ধরনের সেল্ফ সেন্সরশিপ কাজ করছে। আরপরও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। কিন্তু তারা যে প্যারামিটারের ভিত্তিতে এটা করে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।”
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, "এই সময়ের কথা বললে যে স্বাধীনতা আছে তা সংবাদমাধ্যমের মালিকদেরই স্বাধীনতা। এখন মালিকরা মনে করেন, আমি কিছু সাংবাদিক নিয়োগ করবো এবং তারা আমার ভাষায় কথা বলবেন। আগে সরকার বলেন, ক্ষমতাধর বলেন, তারা পেশাদার সাংবাদিকদের সাথেই সব বিষয়ে কথা বলতেন। এখন মালিকদের সঙ্গেই যোগাযোগ করে। আগে পেশাদার সম্পাদক ছিলেন। মালিক বিনিয়োগ করতেন। এখন মালিকরা যেমন সম্পাদক হন, তেমনি সম্পাদকরাও মালিকানার অংশীদার। ফলে মালিক সম্পাদক এক হয়ে গেছেন। সাংবাদিকের স্বাধীনতা নাই।”
দীপ আজাদ বলেন," এখন মালিকরা সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করেন তার আর ১০টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ছাতা হিসেবে। তারা গণমাধ্যমকে আলাদা পেশাদার ব্যবসা হিসাবে দেখেন না। ফলে তারা তাদের স্বার্থে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করেন।” "শুধু যে সরকারের চাপ তা নয়, যারা নিউজ ম্যানেজার তাদের এখন নানা ধরনের যোগাযোগ থাকে, স্বার্থ থাকে। ফলে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
আর ফারুক ফয়সাল বলেন,"এখানে যা পরিস্থিতি, তাতে এখন আর সাংবাদিকের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। যা আছে তা হলো মালিকের স্বাধীনতা, প্রকাশকের স্বাধীনতা এবং সরকার ও সরকারি দলের স্বাধীনতা।”
অধ্যাপক গেলাম রহমান মনে করেন," স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে যে বাধা-বিপত্তি, তার চেয়ে সংবাদমাধ্যমের ম্যানেজার, পরিচালক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিকদের মনোভাবের কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়।”
সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মনে করেন," নানা কমতি , ঘাটতি, আইন০কানুনের কিছু অপব্যবহার, অপপ্রয়োগের পরেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম কাজ চলার মতো স্বাধীনতা ভোগ করছে।” তার কথা, "যদি স্বাধীন গণমাধ্যম যে-কোনো ধরনের আক্রমণের মুখে পড়ে, সেটা রাষ্ট্রের দিক থেকে হোক, আইনের দিক থেকে হোক, কার্পোরেট গ্রুপের দিক থেকে হোক, তার আমি অবসান চাই। তবে গণমাধ্যমের সূচক যারা প্রকাশ করে, তাদের স্বচ্ছতা ও যথার্থতা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। আমি তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে দেখেছি তারা একপেশে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।'' তিনি মনে করেন, "বাংলাদেশে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা বিষয়ে সংবাদমাধ্যম তথ্য প্রকাশ করে, করতে পারে। তবে কর্পোরেট পুঁজির সংবাদপত্র মালিকরাই তাদের স্বার্থে সাংবাদিকদের তথ্য প্রকাশ করতে দেন না। তাদের মালিকরা ঠিকমতো বেতন না দেয়ায় কিছু সাংবাদিকের নৈতিক বিচ্যুতি ঘটে।”
আর তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ডয়চে ভেলেকে বলেন,"ওরা যে সূচক তৈরি করে, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। ওরা ভুল তথ্য ও ম্যাথোডলজি দিয়ে সূচক তৈরি করে। তারা যে ভুল তথ্য দেয়, তার প্রমাণ আমরা দিয়েছি। গত বছর ওরা বলেছে বাংলাদেশে ছয়জন আটক হয়েছে তা ভুল ছিল। আমরা তথ্য দেয়ার পর তারা সেই তথ্য সরিয়ে ফেলে। এবারের প্রতিবেদনেও ভুল আছে আমরা তা জানাবো।”
তার কথা, "আগের তুলনায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবস্থা অনেক ভালো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে মুক্ত করে রেখেছেন। যে কারণে বাংলাদেশে এত গণমাধ্যম। গণতন্ত্রের সূচকে মরিশাশ কিন্তু অনেক উপরে। কিন্তু সেখানে একটি সরকারি গণমাধ্যম ছাড়া আর কোনো গণমাধ্যমই নেই। ভুটানেও তিনটি গণমাধ্যম। অথচ এখানে অনেক প্রাইভেট গণমাধ্যম। সরকারের নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা থাকলে তো এত গণমাধ্যমের অনুমতি দিতো না।”
তিনি বলেন, "এখানে একটা সিন্ডিকেট আছে। যারা ভুল ও মিথ্যা তথ্য পাঠায়, তার ভিত্তিতে ওরা প্রতিবেদন তৈরি করে।”