1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাভারত

মিথ্যা মামলার ফাঁদ থেকে পরিত্রাণ নেই

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
২২ নভেম্বর ২০২৪

প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে মিথ্যা মামলার যেন ‘জুড়ি' নেই। ভারতে রাজনীতি থেকে সমাজ সর্বত্রই মিথ্যা মামলার অভিযোগ আছে।

https://p.dw.com/p/4nJd2
নতুন দিল্লি সুপ্রিম কোর্টের সামনে দুইজন আইনজীবী
ভারতে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে গুচ্ছের মামলা করা হয়, সেই সব মামলা চলতেই থাকেছবি: Adnan Abidi/REUTERS

গত ১৯ মার্চ দিল্লির ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক জগমোহন সিং এক নারীর দুই মাস কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। সেই নারীর অপরাধ হলো, তিনি ধর্ষিতা হয়েছেন বলে মিথ্যা মামলা করেছিলেন চারজনের বিরুদ্ধে।

সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারক বলেছিলেন, ধর্ষণের নাম করে মিথ্যা মামলার সংখ্যা সমানে বাড়ছে। তাই ওই নারী মিথ্যা অভিযোগ করেছেন দেখে তিনি দুই মাসের কারাদণ্ডের শাস্তি দিচ্ছেন, যাতে অন্যরা এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকেন।

বিচারক জগমোহন সেই সঙ্গে বলেছিলেন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণ নিয়ে মিথ্যা মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর ফলে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে, তিনি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ছেন, অন্যদিকে যেখানে ধর্ষণ হয়েছে, সেখানে বিচার হতে দেরি হচ্ছে।

তিনি এটাও বলেছিলেন, ‘‘আমাদের দেশে মর্যাদাকে মানুষ এখনো খুব বেশি গুরুত্ব দেয়। একবার তা চলে গেলে, সেটা আর ফিরে আসে না।'' ওই মামলায় অভিযুক্তরা সকলে জামিন পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মিথ্যা মামলার ফলে তারা যে কষ্টের মধ্যে পড়েছেন, তা বলে বোঝানো যায় না। বিচারক এই কথাগুলো ধর্ষণ সংক্রান্ত মিথ্যা মামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কিন্তু যে কোনো ধরনের মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য।

মাদ্রাজ হাইকোর্ট এরকমই একটা কাজ করেছিল। এক তাইকোন্ডো প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে তারই কয়েকজন ছাত্রীকে দিয়ে নারী নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করে মিথ্যা মামলা করিয়েছিল দুই ব্যক্তি। অত্যন্ত কড়া পকসো আইনে তার বিচার শুরু হওয়ার পর মাত্রাজ হাইকোর্ট প্রশিক্ষককে অভিযোগমুক্ত ঘোষণা করে, ওই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পকসো আইনেই মামলা শুরু করার নির্দেশ দেয়। 

আমরা সাধারণত বলে থাকি, একজন যতক্ষণ পর্যন্ত বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত তাকে কোনোভাবেই অপরাধী বলে মানা হয় না। তাকে শুধু অভিযুক্তই বলতে হবে। আবার কেউ এইভাবে অভিযুক্ত হওয়ার পর এটাও বলা হয়, যা রটে, তা কিছুটা তো ঘটেই। দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটতে দেখেছি। কেজরিওয়ালকে যখন প্রথম গ্রেপ্তার করা হলো, তখন অনেকেই মনে করছিলেন, এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। আবার সেই কেজরিওয়াল যখন জামিন পাচ্ছেন না, মাসের পর মাস জেলে থাকছেন, তখন তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পিছনে কিছুটা সত্যতা নিশ্চয়ই আছে, না হলে কি তাকে এইভাবে দিনের পর দিন জেলে বন্দি করে রাখা যায়?

তাই মামলা যে বিষয়েই হোক না কেন, ধর্ষণ, দুর্নীতি থেকে শুরু করে যে কোনো বিষয়েই মিথ্যা মামলা করা হোক না কেন, সেটা সবসময়ই ভয়ংকর। অভিযুক্তদের তার জন্য যে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তা মর্মান্তিক। দিল্লিতে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করার জন্য ওই নারীর না হয় দুই মাস জেল হয়েছে, অন্যত্র মিথ্যা মামলা করার জন্য কারো, বিশেষ করে পুলিশের কোনো জেল হয় কি?

ভারতে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে গুচ্ছের মামলা করা হয়। বিশেষ করে যারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন, মিছিল করেন, জনতার সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ করেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, কর্মরত অবস্থায় সরকারি কর্মীদের গায়ে হাত তোলা, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ-সহ অজস্র অভিযোগ থাকে। সেই সব মামলা চলতেই থাকে। তারা যখন নির্বাচনে দাঁড়ান, তখন সেই খতিয়ান দিতে হয়। সেসময় যখন বলা হয়, এতজন রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে, তখন রাজনীতিকদের জবাব হলো, এটা তো যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে করবেই।

এর ফলে জনমানসে একটা ধারণা তৈরি হয়, রাজনীতিকরা এই সব অপরাধ করেন না, অথচ, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। তাতে অনেক সময় গুরুতর অভিযোগ উঠলেও তারা বেনিফিট অফ ডাউট পেয়ে যান। এই যে ক্ষমতায় এলেই সব দল এই অস্ত্র প্রয়োগ করে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তার ফল তাই সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। মুকুল রায় য়খন তৃণমূল ছাড়লেন, তখন তার বিরুদ্ধে রাশি রাশি মামলা হতে শুরু হলো বলে অভিযোগ উঠেছিল। অর্জুন সিং তৃণমূল থেকে অন্য দলে যাওয়ার পরেও একইভাবে গাদা গাদা মামলা শুরুর অভিযোগ উঠেছে। আবার এর উল্টোটাও সত্যি। বিজেপি-তে কেউ যোগ দিলে তখন তার বিরুদ্ধেও কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি আর সক্রিয় হয় না বলে অভিযোগ ওঠে। মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীদের ক্ষেত্রেও এই অভিযোগ উঠেছে।

গত ৪ অগাস্টের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট বলছে, ২০১৪ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা ২৫ জন বিরোধী রাজনীতিক বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। তার মধ্যে তিনটি মামলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২০টি ক্ষেত্রে তদন্তের কাজ থেমে আছে। বলা হচ্ছে, যদি দরকার হয় তাহলে অ্যাকশন নেয়া হবে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা বন্ধ করা হয়েছে, তার মধ্যে আছেন অজিত পাওয়ার ও প্রফুল্ল প্যাটেল। বিরোধী দলগুলি হামেশাই অভিযোগ করে , বিজেপি হলো ওয়াশিং মেশিন, একবার সেখানে যোগ দিলেই অভিযোগমুক্তি হয়। তবে এটা শুধু বিজেপি-নয়, ভারতে ক্ষমতাসীন সব দলের ক্ষেত্রেই কমবেশি সত্যি।

আবার বলি, এর ফলটা মারাত্মক হচ্ছে। যখন সত্যি কেউ অপরাধ করেন, তখন সেটাকে লঘু করে দেখার প্রবণতা থাকে। তবে শুধু ধর্ষণ নিয়ে বা বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধেই নয়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টার অভিযোগ কমবেশি অনেকের বিরুদ্ধেই ওঠে। তার মধ্যে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিক্ষোভকারী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি সকলেই আছেন।

কলকাতার কাছের একটি জেলার মানুষদের ক্ষেত্রে বলা হয়, তারা হলেন মামলাবাজ। মামলা করাটা তাদের নেশা। তারা ছুতোয়-নাতায় মামলা করেন। এই ধরনের মামলার পিছনে একটাই উদ্দেশ্য থাকে। যার বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে, তাকে বিপাকে ফেলা। সব ধরনের মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে এই বিপদে ফেলার বিষয়টি থাকে। কেউ প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে, কেউ নিজের বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে, কেউ অন্যকে সবক শেখাতে, কেউ ক্ষমতায় থাকতে, কেউ ক্ষমতায় আসতে এই অস্ত্র ব্যবহার করেন।

প্রকৃত অভিযোগ আর মিথ্য়া মামলার মধ্যে তফাৎ কোথায়? মিথ্যা মামলা হলো সেটাই, যেখানে মিথ্যা তথ্যের সাহায্যে, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। পুলিশের এই যুক্তি থাকতেই পারে যে, তারা কোনো অভিযোগ পেয়েছে, তার ভিত্তিতে তদন্তের ভিত্তিতে রিপোর্ট দিয়েছে। অথবা, কোনো ঘটনা ঘটেছে, তাতে পুলিশ দেখে বা তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে অভিযোগ মিথ্যা হলে, পুলিশের রিপোর্টের ভিত্তিতে মামলা হলে পুলিশেরও সাজা পাওয়া দরকার। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষেরও সাজা হওয়া উচিত। নাহলে বিচারক জগমোহনের মতো কয়েকজন কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি দেবেন, বাকি ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলা করেও বাকিরা পার পেয়ে যাবেন, তাহলে তো আর যাই হোক, মিথ্যা মামলা ঠেকানো যাবে না।  

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য