মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙছে
২ জানুয়ারি ২০১৭সিরাজগঞ্জের ফুলকুচা গ্রামের ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মাত্র পাঁচ বছর আগেও কিন্তু চিত্রটা ছিল একেবারে বিপরীত৷ মাসিকের সময় মেয়েরা স্কুলে আসতো না৷ তারা ভয় পেত, পেত লজ্জা৷ ব্যবহার করতো পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া৷ এখন অবশ্য তারা শুধু স্যানিটারি প্যাডই ব্যবহার করে না, তাদের জন্য সার্বক্ষণিক পানি এবং আলাদা ওয়াশ রুমের ব্যবস্থাও করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি কয়েকজন প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষক রয়েছেন তাদের সহায়তা করার জন্য, কথা শোনার জন্য৷
মেয়েদের মাসিকের ব্যাপারে সচেতন করতে, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে উৎসাহী করতে ঐ এলকায় ২০১১ সালে ‘ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অফ দ্য রুরাল পুওর' বা ডিওআরপি নামে একটি এনজিও ‘অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম' শুরু করে৷ ডিওআরপি বা সংক্ষেপে ডর্প-এর প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর আমির খসরু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা শুধু স্কুলের শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটি নয়, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকে সঙ্গে নিই৷ এরপর আমরা স্কুলের ছাত্রী এবং তাদের অভিভাকদের বোঝাতে সক্ষম হই যে, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড কেন প্রয়োজন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘শুরুতে সমস্যা ছিল স্যানিটারি প্যাডের দাম৷ বাজারে প্রচলিত স্যানিটারি প্যাডের দাম অনেক৷ আমরা তাই কম দামে স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড উৎপাদন করে তা সরবরাহ করি৷''
তিনি জানান, ‘‘আমরা এ পর্যন্ত ৪০টি স্কুলে এই কর্মসূচি চালু করেছি৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এই কাজের সহায়ক নীতিমালা তৈরি করেছে৷''
ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরোজ উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আমার স্কুলে এখন ছাত্রীদের উপস্থিতি বেশি৷ তারা আর মাসিকের কারণে স্কুলে আসা বন্ধ করে না৷ ভয় বা লজ্জাও পায় না৷ তারা জানে যে, এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়৷''
২০১৩ সালে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ওয়াটার এইড-এর সহায়তায় ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিস রিসার্চ, বাংলাদেশ' বা আইসিডিডিআরবি-এর জরিপে দেখা যায় যে, দেশের শতকরা ৮৬ ভাগ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে না৷ তাঁরা পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন৷
বাংলাদেশের সব জেলা থেকে ২,৫০০ পরিবারের ২,১০৭ জন বয়স্ক নারী ও ৩৭৭ জন কিশোরীর তথ্য নেয়া হয়৷ এর বাইরে ৭০০ স্কুলের ২,৩৩২ জন ছাত্রীরও সাক্ষাৎকার নেয়া হয়৷ ছাত্রীদের ৬৮ শতাংশ বলে যে, প্রথমবার মাসিক হওয়ার আগে তারা এ বিষয়ে জানত না৷ আর প্রায় ৮২ শতাংশ জানায়, তারা মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে৷ দেখা যায়, বাংলাদেশের মাত্র ১ শতাংশ স্কুলে ব্যবহার করা প্যাড ফেলার ব্যবস্থা আছে৷
ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরোজ উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে এখন আর এই সমস্যা নেই৷ প্রতিমাসে দায়িত্বরত নারী শিক্ষকরা ছাত্রীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন৷ স্কুলেই তাদের জন্য স্যানিটারি প্যাড সংরক্ষণ করা থাকে৷''
ডর্প-এর আমির খসরু বলেন, ‘‘পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে৷ তাই অনেক প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজ করছে৷ কিন্তু এখনো সবখানে মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে সময় লাগবে৷''
ঐ জরিপে ৪০ শতাংশ ছাত্রী জানায় যে, মাসিকের কারণে গড়ে মাসে তারা তিন দিন স্কুলে যেতে পারে না৷ এছাড়া ৩৮ শতাংশ কিশোরী এবং ৪৮ শতাংশ বয়স্ক নারীকে মাসিকের সময় ধর্মীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়৷ বিষয়টি লুকিয়ে রাখা হয় এবং লজ্জার বিষয় মনে করা হয়৷ আর সেই কারণেই তারা পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন৷
ব্র্যাক-এর সিনিয়র সাপোর্ট স্পেশালিস্ট বিথী রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাসিক নিয়ে যে ট্যাবু আছে, সেটা ভাঙতে হবে৷ ভাইকে বুঝতে হবে বোনের প্রয়োজন৷ স্বামীকে বুঝতে হবে স্ত্রীর প্রয়োজন৷ মাসিক বিষয়টি শুধু নারী বুঝলেই হবে না৷ পরিবারের সদস্য এবং সমাজকেও এটা বুঝতে হবে৷ এটাকে একটি স্বাভাবিক শারীরিক বিষয় হিসেকে জানতে হবে, মানতে হবে৷ তাহলে আর ভয় বা লজ্জা থাকবে না৷''
বিষয়টিকে সামনে রেখেই ব্র্যাক তাদের কর্মীদের কর্মস্থল ও কর্ম এলকায় সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে৷ পুরুষ সহকর্মীও যাতে নারী সহকর্মীকে বুঝতে পারেন, ঘরের মানুষ যেন ঘরের নারী সদস্যের প্রয়োজনটা উপলব্ধি করে, সেই টার্গেটকে সামনে রেখেই ব্র্যাক-এর এই ক্যাম্পেইন৷ তারা এ জন্য একটি ফেসবুক গ্রুপও পরিচালনা করছে৷
বিথী রায় একজন সাইক্লিস্টও৷ তাই তাঁর পরিকল্পনা আছে, সামনে এক হাজার নারী সাইক্লিস্ট নিয়ে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে ক্যাম্পেইন করার৷ তবে এটা শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলে-মেয়ে উভয়ের সচেতনতায় কাজ করতে চান তাঁরা৷ তাঁর কথায়,‘‘বাবা যেন মেয়ের জন্য স্যানিটারি প্যাড কিনে আনেন৷ ভাই যেন বোনের জন্য কেনেন৷ সবাই যেন বুঝতে পারেন যে ময়লা কাপড় বা পুরনো ন্যাকড়া ব্যবহার কতটা ক্ষতিকর৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড যে অপরিহার্য, সেটা যে বুঝাতে হবে৷''
নারী ও শিশু বিষয়ক চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করা অনুচিত৷ এর ফলে নারী ও কিশোরীরা নানা ধরনের সংক্রমণের শিকার হতে পারে৷ আর সংক্রমণ দীর্ঘদিনের হলে প্রজনন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা থেকে দেখা দিতে পারে বন্ধ্যাত্ব৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এর ফলে সাদাস্রাব বা লিকোরিয়া নামের একটা রোগ হতে পারে, যা নারীর মনোবল ভেঙে দেয়, তাকে হতাশ করে৷''
‘ডোনেট এ প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ' বা ডিএপিএফএইচবি-র শাকির ইব্রাহিম মাটি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্যানিটারি প্যাডের দাম বাংলাদেশে একটি প্রধান সমস্যা৷ বাজারে এক প্যাকেট প্যাডের ডাম ১২০ টাকা৷ আমরা এটা ৩০ টাকার মধ্যে নিয়ে এসেছি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করছি৷ গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে আমরা এর পাশাপাশি স্কুল পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালিয়ে আসছি৷''
বাংলাদেশের স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের সাধারণত ক্লাস সিক্স থেকে মাসিক শুরু হয়৷ প্রথম মাসিক হওয়ার বিষয়টি বোঝা জরুরি৷ তাই এটার ব্যবস্থাপনা এবং এটা সম্পর্কে প্রচলিত ট্যাবু ভাঙতেও কাজ করছেন তারা৷ শাকির ইব্রাহিম বলেন, ‘‘প্যাঁচি নামে আমাদের একটি কমিক ক্যারেক্টার আছে৷ এর মাধ্যমে আমরা স্কুলগুলোতে সভা করে ছাত্রী-শিক্ষকদের সচেতন করে তুলি৷ আমাদের কিছু সেলিব্রেটি রয়েছেন৷ যেমন শম্পা রেজা, সারা জাকের, ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনী – এঁরা সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে অংশ নেন৷''
তবে তিনি এটাও জানান যে কাজটা শুরুতে এত সহজ ছিল না৷ বলেন, ‘‘আমি ছেলে হয়ে মেয়েদের এই বিষয় নিয়ে কেন কথা বলছি, এজন্য আমাকে নানা হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে৷ কিন্তু এখন সময় বদলাচ্ছে৷ সবাই বুঝতে শুরু করেছেন, ট্যাবু ভাঙছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের ‘টার্গেট গ্রুপ' স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী৷ কারণ তারাই ভবিষ্যতে পরিবর্তন আনবে৷''
নোয়খালীর জমিদার হাট বিএন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ইসমাইল হোসেন ডয়চে ভেলকে এ বিষয়ে বলেন, ‘‘পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো৷ আমার স্কুলের মেয়েরা এখন তাদের ম্যাডামদের সঙ্গে সহজভাবেই তাদের শারীরিক এই পরিবর্তন নিয়ে কথা বলে৷ স্কুলে রাখা স্যানিটারি প্যাড চেয়ে নেয়, ব্যবহার করে৷ তারা এটাকে এখন আর লজ্জার বিষয় মনে করে না৷ আর আমরাও মনে করি, এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়৷ এরা আমাদের সন্তান৷ এদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা তো আমাদেরই কর্তব্য৷''