মামলা করতে পারেনি একরামুলের পরিবার, কথা বলাও নিষেধ
৩০ আগস্ট ২০১৯বিশ্ব গুম দিবসে শুক্রবার টেকনাফের নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে এসব কথা বলেন। গত বছরের ২৬ মে মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের' নামে একরামকে হত্যা করা হয়৷
একরামের দুই মেয়ে তাদের পড়ার ঘরের দেয়ালকে প্রতিবাদের দেয়ালে পরিণত করেছে৷ দেয়ালে তারা লিখে রেখেছে বাবা হারনো ব্যথার কথা, কষ্টের কথা৷ তারা লিখেছে, আমাদের আব্বু কি কোনো বিচার পাবো না? তুমি কি আর জীবনেও আসবে না? নির্দোষ মানুষকে কেন মারে? আব্বু তুমি চলে এসো৷''
এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও একরামের পরিবার কোনো মামলা করতে পারেনি৷ তারা মামলা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে৷ একরামের স্ত্রী বলেন, ‘‘মামলাতো দূরের কথা আমাদের এ নিয়ে কথা বলতেও নিষেধ করা হয়েছে৷ মামলা করলে আমরা টিকতে পারবনা৷’’
একরাম হত্যার পর একটি মোবাইল অডিও প্রকাশ হয়৷ আর তাতে স্পষ্ট হয় একরামকে কারা কিভাবে হত্যা করেছে৷ কিন্তু সেই অডিও ধরে কোনো তদন্ত হয়নি৷ একরামের স্ত্রী বলেন, ‘‘আমার স্বামীকে ডিজিএফআই এর লোকজন নিয়ে র্যাবের হাতে তুলে দেয়৷ কারা তাকে হত্যা করেছেন তা আমি জানতে চাই৷ তারা আমার মোবাইল ফোনটিও বার বার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে৷ এই মোবাইলেই আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার পর কথা হয়েছে৷ মোবাইল ফোনটি না দেয়ায় আমি এখনো চাপে আছি৷’’
ঘটনার পর ওবায়দুল কাদের সাহেব ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ফোন করেছিলেন৷ তারা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একরামের স্ত্রীকে দেখা করিয়ে দেবেন৷ কিন্তু এরপর আর কেউ যোগাযোগ করেননি বলে জানান একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম৷ তিনি কান্নজড়িত কন্ঠে বলেন,‘‘আমার মেয়েরা এখনো কাঁদে৷ সবার বাবা আছে আমার সন্তানদের বাবা নেই৷ ঈদ আসে, কোরবানি আছে কিন্তু বাবা ছাড়াই আমার সন্তানদের কাছে এইসব উৎসবের দিন৷ আমি কি আমার নিরপরাধ স্বামী হত্যার বিচার পাবনা৷’’
তিনি বলেন,‘ আমার স্বামীকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা করা হয়েছে৷ সে তো মাদক ব্যবসায়ী ছিল না৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন একথা৷ একরামকে নিয়ে যাওয়ার পর আমার দেবর এমপি বদি ভাইকে ফোন করেছিলেন৷ তিনি শুধু বলেছেন ও ওখানে কেন গেছে? বদিতো জানতে কারা মাদক ব্যবসায়ী ৷ সে চাইলে আমার স্বামীকে বাঁচাতে পারত৷ কিন্তু তিনি তা করেননি৷’’
এই ঘটনায় র্যাবের পক্ষ থেকে তখন টেকনাফ থানায় একটি মামলা করা হয়৷ টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস জানান,‘‘বন্দুক যুদ্ধে একরাম নিহত হওয়ার মামলাটির তদন্ত চলছে৷ এখানো কোনো নতুন তথ্য পাওয়া যায়নি৷ আর একরামের পরিবারের পক্ষ থেকেও কেউ মামলা করেনি৷'' এ বিষয়ে র্যাবের কারুর বক্তব্য জানা যায়নি৷
বাংলাদেশে গুম বা বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনায় বিচার পাওয়ার নজীর নেই বললেই চলে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসেবে ২০১৪ থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে ৩৪৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন৷ এদের মধ্যে ৪৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে৷ ৬০ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৷ফিরে এসেছেন ৩৫ জন৷ বাকি ২০৫ জন ফিরে আসেনি৷
আসক এক বিবৃতিতে জানায়, এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবী করেছেন যে, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে তাদের তুলে নেয়া হয়েছে৷ অনেক ক্ষেত্রে গুম হওয়ার অনেকদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ক্রসফায়রে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়৷
২০১৩ এভাবেই ঢাকার সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান সুজনকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তার খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি৷ তার ভাই জাহিদ খান জানান,‘‘আমাদের মামলাও নেয়নি পুলিশ৷ অনেক যোগাযোগের পর জিডি নিয়েছে৷ এক বছর পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের বাসায় আসেন৷ তারা বলেন আমার ভাই ফিরে আসবে৷ আমরা যেন সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা না বলি৷ কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি৷'' মাহবুবের স্ত্রী ও দুই সন্তান আজও তার জন্য অপেক্ষায় আছেন৷
আসকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন,‘‘নিখোঁজ হওয়ার পর যারা ফিরে আসেন তারা কথা বলতে চান না৷ আর যারা কথা বলেন তার খুব ভীত থাকেন৷ অসংলগ্ন কথা বলেন৷ আমাদের মনে হয়েছে হয়েছে নিখোঁজ থাকার সময় তারা এমন পরিস্থিতির মধ্যে থাকেন যা তাদের মৃত্যু ভয়ের মধ্যে ফেলে দেয়৷’’