মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার
৭ আগস্ট ২০১৭কোনো দেশে গেলে সেদেশের পুলিশ দেখার, পারলে তাদের সাথে কথা বলার শখ আছে আমার৷ তাঁরা কেমন মিশুক, কতটা বন্ধুসুলভ আচরণ এবং তাঁদের বেশভূষা-আচরণ দেখে সেদেশের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যায়৷ এটা অবশ্য একেবারেই আমার ব্যক্তিগত মতামত৷
ফলে কয়েক বছর আগে নেপাল গিয়েও রাস্তায় খুঁজছিলাম পুলিশ৷ কিন্তু অবাক কাণ্ড! পুলিশ তো দূরের কথা, রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশও খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷
তবে একদিন আমার সে সৌভাগ্য হলো৷ রাস্তার মোড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে, দেখাই যায় না এমন একটা জায়গায় একজন ট্রাফিক পুলিশকে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছেন৷ এবং তিনি একজন নারী ট্রাফিক পুলিশ৷ অথচ তাঁর দৃশ্যমান উপস্থিতি ছাড়াই ঠিকঠাক লাল বাতি, সবুজ বাতি মেনে চলছেন পথচারী এবং গাড়ি চালকেরা৷
খুব বেশি দেশ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য না হলেও যে কয়টি দেশে গিয়েছি, কোনোটিতেই বাংলাদেশের মতো ভয়াবহ অবস্থা দিনের পর দিন চলতে দেখিনি৷
তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাংলাদেশে আমরা কেন এই চিত্র কল্পনাও করতে পারি না? কারণ হিসেবে অনেকেই বলে ওঠেন, জনসংখ্যা৷ আমি তা সাথে সাথে মেনে নেই এবং পালটা প্রশ্ন করি, তাহলে আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি কীভাবে করছি? কীভাবে আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলাম? নেপাল কি আমাদের চেয়ে উন্নত দেশ?
দেশের উন্নয়ন মানে কি শুধুই অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিনা তা মনে হয় গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে৷ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ' এখন দেশের সব প্রান্তে জনপ্রিয় একটি স্লোগান৷ সরকারের উদ্যোগের ফলে সত্যিকার অর্থেই এখন অনলাইনে এবং মোবাইলে ব্যাংকিং থেকে শুরু করে নানা ধরনের সেবা গ্রাম থেকেও পাওয়া যায়৷
কিন্তু একবার মিলিয়ে দেখুন তো, অনলাইনে অর্ডার দিলে খাবারদাবার, এমনকি জামা-জুতোও যখন আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, তখন দেশের রাস্তাঘাটের অবস্থাটা কী!
দেশের সবকিছু যখন ডিজিটাল হচ্ছে, বা অন্তত ডিজিটাল করার কথা বলা হচ্ছে, তখন অটোমেটিক ট্রাফিক সিগন্যাল তো দূরের কথা, ট্রাফিক পুলিশকেও রাস্তার মাঝখানে হাত-পা ছড়িয়েও গাড়ি থামাতে বেগ পেতে হচ্ছে৷ ঢাকার তুলনায় মানুষ কম হলেও অন্যান্য শহরেও কমবেশি এই চিত্রই দেখা যায়৷
দুই দিক থেকে এই দুরবস্থার কারণ চিহ্নিত করতে হবে৷ প্রথমত পরিকল্পনার অভাব, যাচ্ছেতাইভাবে নগরায়ণের নামে নিজের কবর নিজেই খনন, দ্বিতীয়ত মনেমনে ইউরোপ-অ্যামেরিকার জীবনমান প্রত্যাশা করলেও, রাস্তায় নেমে যতভাবে পারা যায় আইন ভঙ্গ করা৷
সংবাদকর্মী হিসেবে অভিজ্ঞতা এবং কিছু তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দু'দিক থেকেই সমস্যাটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি৷
- বুয়েট-এর এক গবেষণা বলছে, ১৯৫৯ সালের মাস্টারপ্ল্যানের ভিত্তিতে এ শহর গড়ে উঠলেও সঠিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তা মানা হয়নি৷ বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা এই নগরীর ৭৩ শতাংশই অপরিকল্পিত বলে তথ্য দেয়া হয়েছে এই গবেষণায়৷ এর প্রভাব স্বভাবতই পড়ছে নাগরিক সেবার ওপর, যানচলাচল যার মধ্যে অন্যতম৷
- শহরবাসী নির্বিঘ্ন যাতায়াতের জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন৷ কিন্তু রাজধানীতে রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ সড়ক৷ অকল্পনীয়, তাই না?
- যানজট কমাতে ফ্লাইওভারের মতো দ্বিতল যানচলাচল ব্যবস্থা হাতে নেয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেগুলোতেও রয়েছে নানা পরিকল্পনাহীনতার ছাপ৷ কুড়িল-বিশ্বরোড এবং যাত্রাবাড়ীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার কিছুটা কাজে আসলেও, বাকিগুলো কমানোর বদলে বরং দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে৷
- এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ মহাখালী এবং বিজয় সরণি ফ্লাইওভার৷ একই রাস্তা থেকে উঠে, ট্রাফিক ডাইভার্শন ছাড়াই ঐ রাস্তাতেই নেমে যায়, এমন ফ্লাইওভারের উদাহরণ এখনকার পৃথিবীতে বিরল৷
- ডেনমার্ক-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা কোপেনহেগেন কনসেনসাসের তথ্য অনুযায়ী, বাসের চেয়ে ৩৩ গুণ বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে ঢাকা শহরে৷ অথচ, নগরবাসীর মাত্র ১৩ ভাগ চড়েন নিজের গাড়িতে৷ ৪৯ ভাগকেই যাতায়াতে নির্ভর করতে হয় বাসের ওপর৷
ঢাকায় এখন যান চলাচলের গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার৷ তবে যানবাহনের সংখ্যা এই হারে বাড়তে থাকলে ২০৩৫ সালে এই গতি ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৭ কিলোমিটারে নেমে আসতে পারে বলে আশংকা করা হয়েছে গবেষণায়৷ স্বাভাবিক একজন মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার৷
- বাংলাদেশের ট্রাফিক আইনকে শিথিল বললেও কম বলা হয়৷ মাঝেমাঝে মোড়ে মোড়ে সার্জেন্টকে দেখা গেলেও, তাদের কাজ মূলত লাইসেন্স পরীক্ষা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাস্তার ওপর পার্কিংয়ের জন্য জরিমানা করা হয় ঠিকই৷ কিন্তু উলটো পথে গাড়ি চলাচল, ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা, পথচারীদের যেখানে সেখানে ইউটার্ন নেয়ার মতো বড় ধরনের আইনভঙ্গকেও কঠোর হাতে দমন করার সামর্থ্য আমাদের পুলিশের নেই৷
জনবল এবং যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা, এবং ক্ষমতাধরদের রাস্তায় অবাধ চলাচলকে অধিকার মনে করা ট্রাফিক পুলিশকে করেছে আরো অসহায়৷
- গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের অন্যায় আবদারে মাঝমধ্যেই সরকারকে মাথা নোয়াতে হয়৷ ভাড়া নির্ধারণ থেকে শুরু করে কী হবে দেশের পরিবহন নীতি, সেটাও নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন তারা৷ শীর্ষ কয়েকজন পরিবহন নেতা একই সাথে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায়, সরকারও পড়ে বিপাকে৷
- এবার আসি আমাদের নিজেদের কথায়৷ আমরা দেশটাকে জীবনমানে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর কাতারে দেখতে চাই৷ কিন্তু সেজন্য কি আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত?
সিগন্যাল থাকুক বা নাই থাকুক, রাস্তা পেরোতে হবে, ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস থাকলেও সেগুলোতে কোনোভাবেই চড়া যাবে না, নিজেকে ১ সেকেন্ড হলেও আগে যেতে হবে, তাতে অন্য কেউ মারা পড়লেও সমস্যা নেই৷ গাড়িতে থাকলে দোষ দিবো পথচারীকে, হাঁটার সময় গালমন্দ করবো গাড়ির চালককে৷
এই মানসিকতার কারণেই আমরা পিছিয়ে আছি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাতে৷ পরিকল্পনার অভাব থাকলেও চলাচল এতটা দুর্বিষহ হয়ত হতো না, যদি দেশের প্রচলিত ট্রাফিক আইন আমরা নিজেরা মেনে চলতাম, অন্যকেও উৎসাহিত করতাম৷
ফলে একই সাথে সরকারকে যেমন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি দমনে ও আইন বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে, গবেষকদের এগিয়ে আসতে হবে অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে, তেমনি নাগরিকদেরও সচেতনতার দিক দিয়ে অগ্রসর ভূমিকা রাখতে হবে৷
যানজট, শব্দ দূষণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ৷ বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান তলানিতে৷ বাকি শহরগুলোর অবস্থাও যে ক্রমাগত সেদিকে যাবে না, তারও নেই নিশ্চয়তা৷
ফলে শুধু জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে নিজের অক্ষমতা ঢাকার সময় কি এখনও আছে? তাহলে তো ‘মানুষ সৃষ্টি সেরা জীব', ছোটবেলায় পড়া এই প্রবাদটিও লিখতে হয় নতুন করে৷ তাই নয় কি?
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷