পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে জগদীপ ধনখড় দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০১৯-এর ৩০ জুলাই। তারপর থেকে সম্ভবত এমন দিন খুব কম গেছে যখন রাজ্যপাল বা মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের মন্ত্রীরা একে অপরের বিরুদ্ধে তোপ দাগেননি। উচিত-অনুচিত, শোভন-অশোভন, সংবিধানের মর্যাদার মতো প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ দূরে সরিয়ে রেখে, এটুকুই বলা যায়, রাজ্যের মানুষ এখন এই বিরোধে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। এই বিরোধে এমন সব অভাবিত চমক এপর্যন্ত দেখা গেছে, তারপর বিরোধ শেষপর্যন্ত কোন জায়গায় গিয়ে থামবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। সেরকমই একটি চমক এবার দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পদাধিকার বলে রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হলেন রাজ্যপাল। রাজভবনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ১৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তিনি। বিশ্বভারতী বাদে কেন্দ্রীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন রাষ্ট্রপতি। শুধু বিশ্বভারতীর উপাচার্য হলেন প্রধানমন্ত্রী। জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছায় ও তার সময় থেকেই এব্যবস্থা চালু আছে। মমতা এবার সেই ব্যবস্থা বদল করতে চাইছেন। রাজ্য মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়ে গেছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, সর্বসম্মতিতে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যপালের জায়গায় মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হবেন। তবে এরপর রাজ্য সরকারকে বিধানসভায় বিল পাস করতে হবে, তারপর পাস করা বিল সইয়ের জন্য রাজ্যপালের কাছে পাঠাতে হবে। তিনি সই করলে তবে তা আইনে পরিণত হবে এবং রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হতে পারবেন।
বিধানসভায় বিল পাস করানো কঠিন বিষয় নয়। সেখানে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে সরকার চাইলেই বিল পাস হয়ে যাবে। কঠিন বিষয়টি হলো, রাজ্যপালের সম্মতি বা সই পাওয়া। তাকে সব রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ থেকে সরানোর জন্য বিল পাস হবে এবং ধনখড় সানন্দে সই করে দেবেন, এই ভাবনাটা গত আড়াই বছরের ঘটনাবলির দিকে তাকিয়ে বলা যাচ্ছে কি? অরণ্যের প্রচীন প্রবাদ হলো, নিয়ম থাকলে তার ফাঁকও থাকে। রাজ্যপালকে কতদিনের মধ্যে সই করতে হবে, তা বলা নেই। ঠিক এই যুক্তি দেখিয়ে ধনখড়ের পূর্বসূরি কেশরীনাথ ত্রিপাঠী যখন উত্তরপ্রদেশের স্পিকার ছিলেন, তখন তিনি দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রয়োগ করে বিধায়কদের সদস্যপদ খারিজ করার আর্জি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।
মমতার এই সিদ্ধান্ত বেনজিরও নয়। এর আগে জয়ললিতার আমলে তামিলনাড়ু সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারপর তা রাজ্যপালের কাছে গিয়ে সইয়ের জন্য পড়েছিল। এম কে স্টালিনের আমলে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আইন করে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করা হয়েছে। বলা যেতে পারে, মমতা এখানে তামিলনাড়ুর পথে হেঁটেছেন।
কিন্তু কীএমন ঘটল, যার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে এই চরম রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে? মূল প্রশ্ন এটাই। আর এই প্রশ্ন যখন উঠবে, তখন শোভন-অশোভনের প্রশ্ন উঠবে। উচিত-অনুচিতের প্রশ্নও উঠবে। কিছুদিন আগের ঘটনা। আচার্য হিসাবে ধনখড় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বৈঠকে ডেকেছিলেন রাজভবনে। একজন বাদে আর কোনো উপাচার্য সেই বৈঠকে যাননি। কেন যাননি? হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে, সরল বাংলায় তার অর্থ, সমঝদারদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। নিশ্চয়ই এমন কোনো জায়গা থেকে ইশারা এসেছিল, যা অমান্য করা উপাচার্যদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানকে অপমান করার পথে তারা হেঁটেছিলেন বা হাঁটতে পেরেছিলেন। মনে রাখতে হবে, রাজ্যপালের পদটি সাংবিধানিক। সেখানে বসে থাকা মানুষকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ বা অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু তাকে অপমান করতে পারেন না।
অতীতে ধনখড় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ২০২০ সালে ধনখড় কোচবিহারের পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে শোকজ করেছিলেন। কারণ, সমাবর্তনের কথাটা তিনি আচার্যকে জানাননি। এই সব ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে এই অস্বস্তির মুখে যাতে আর পড়তে না হয়, সেজন্য কি আচার্যের পদ থেকে রাজ্যপালকে ছেঁটে ফেলে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সেই জায়গায় বসতে চাইছেন?
রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীযদি আচার্য হন, তাহলে অসুবিধা কোথায়? প্রেসিডেন্সি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত রূপায়িত হলে শিক্ষার রাজনীতিকরণ সম্পূর্ণ হবে। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় ধাক্কা লাগবে। তিনি উপাচার্যকে যা খুশি নির্দেশ দেবেন। সেটা তারা মানতে বাধ্য থাকবেন। তবে এই কাজটা আচার্য না হয়েও করা যায়। বার্তা পৌঁছে দেয়ার নানান পন্থা আছে। বার্তা পেলে তা কার্যকর না করার সাহস কজন উপাচার্যের আছে বা থাকবে?
বরং মনে হচ্ছে, সমস্যাটা আরো গভীরে। রাজ্যপালের পদে থেকে ধনখড় যেভাবে পদে পদে রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করে যাচ্ছেন, তার ফলে মুখ্যমন্ত্রী অস্বস্তিতে পড়ছেন, মাঝে মধ্যে তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে চাইছেন মমতা। রাজ্যপাল মুখ খোলা বা টুইট করা মানে অধিকাংশ সময়ে তা প্রচার পায়। আলোচনা হয়। শিক্ষাক্ষেত্র নিয়ে এমনিতেই মমতা চাপে আছেন। রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান কমতে কমতে তলানিতে। পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ছাত্রছাত্রীরা দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বই, পুনে সহ বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্র দাদাগিরির দাপটে ধুঁকছে। সেই শিক্ষাক্ষেত্রের, শিক্ষাসংস্থার পরিস্থিতি ও পরিবেশ ঠিক না করে, মান বাড়ানোর প্রয়াস না করে, শুধু আচার্য হয়ে বসে কতটা লাভ হবে?
পাশাপাশি, এই কথাটাও বলা দরকার, এমন প্রো-অ্যাকটিভ রাজ্যপাল বহুদিন পরে দেখছে পশ্চিমবঙ্গ। টুইট করে, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে, মন্ত্রী-সচিবদের ডেকে পাঠিয়ে নিত্যদিনই বিতর্কের ঝড় তোলেন ধনখড়। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দল সংবিধানের সীমালঙ্ঘন করার অভিযোগ তোলে। সমানে মুখ্যমন্ত্রী বনাম রাজ্যপাল বিরোধের খবর শিরোনামে আসে। আচার্যের বিষয়টি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বিরোধটাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছেন।
সংবিধানকাররা যখন রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতার সীমানা বেঁধে দিয়েছিলেন, তখন বোধহয় ভাবেননি, একদিন এরকম সময়ও আসবে, যখন রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রীর সংঘাত এরকমভাবে তুঙ্গে উঠবে। আর এই ঘটনা যত তীব্র হয়, ততই মনে হতে থাকে, এ বড় সুখের সময় নয়।