মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কী?
১৮ এপ্রিল ২০২৪ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট এমনিতেই ঘনিভূতহচ্ছিল৷ সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে সম্প্রতি ইসরায়েলে ইরানের ড্রোন এবং রকেট হামলায় পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে৷
এ নিয়ে বাংলাদেশেও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে অর্থনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং জ্বালানি তেল নিয়ে সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট সব খাতকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলেছেন৷ সংঘাত দীর্ঘ হলে জ্বালানি তেলসহ যেসব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে সেই সব খাতকে তিনি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন৷ বাণিজ্যমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ডয়চে ভেলেকে জানান, জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তারা বিকল্প অনুসন্ধান শুরু করেছেন৷
যেসব ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে
বাংলাদেশে জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল৷ এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসও আসে এই অঞ্চল থেকে৷ যুদ্ধ বিস্তৃত হলে খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে৷ এতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালনি খাতে সমস্যা দেখা দেবে, শিল্প উৎপাদন ও পরিবহণ খাত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে৷ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রম বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা৷ সেইসঙ্গে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরো কমে যেতে পারে৷
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সারাবিশ্বে যে জাহাজগুলো জ্বালানি তেল বহন করে তারা চার ভাগের একভাগ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। আর আমাদের জ্বালানির জন্য আমরা মধ্যপ্রাচ্য নির্ভর৷ সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, দুবাই থেকে জ্বা লানি তেল আসে৷ কাতার থেকে আসে এলএনজি৷ এগুলো পরিবহণের জন্য রয়েছে দুইটি পথ হরমুজ প্রণালি ও লোহিত সাগর (রেড সি)৷ লোহিত সাগর শুধুমাত্র সৌদি আরবের জন্য কিছুটা সহজ৷ কিন্তু অন্যদের জন্য হরমুজ প্রণালি৷ এখন লোহিত সাগরে হুতিদের হামলা আর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যাবে৷ ফলে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল ও এলএনজির সংকটে পড়বে৷ এটা সারাবিশ্বের জন্য সংকট হবে৷''
তিনি জানান, দুবাই থেকে বাংলাদেশে নির্মাণ কাজের জন্য বিটুমিন ও পাথর আসে৷ অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশ থেকে ভোগ্য পণ্য, শাবসবজি রপ্তানি হয়৷ সমুদ্রপথে সমস্যা হলে তাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের রিফাইনারিতে সর্বোচ্চ এক মাসের চাহিদা পূরণের তেল রাখা সম্ভব৷ ফলে বেশি আমদানি করে রাখাও সম্ভব নয়৷ আর এই তেল-গ্যাসের উপর বিদ্যুৎ, শিল্প কারাখানা নির্ভরশীল৷''
পোশাক খাতে উদ্বেগ
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে। প্রথমত জ্বালানি সংকট তৈরি হলে উৎপাদন কমে যাবে৷ আবার রপ্তানির পথ ঝুঁকিপূর্ণ হলে লিড টাইম বা গন্তব্য দেশে তা পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে৷ এর ফলে পোশাকের খরচ বাড়বে৷ সেই সঙ্গে চাহিদাও কমে যেতে পারে৷ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা জানান, লোহিত সাগরে জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷ পোশাক সরবরাহের লিড টাইম কোথাও কোথাও বেড়েছে৷ এখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে৷
বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘‘আমাদের পোশাক খাতের অবস্থা খারাপ হচ্ছে৷ অ্যামেরিকার বাজারে পোশাক রপ্তানি ২৪ শতাংশ কমে গেছে৷ ইউরোপের বাজারেও পোশাক রপ্তানি কমছে৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এক দশমিক ২৪ শতাংশ কমেছে৷ এখন যুদ্ধ বিস্তৃত হলে এটা আরো কমবে৷ বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা তৈরি হলে পোশাক কেনা তারা কমিয়ে দেবে৷
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাঁচামাল আমদানি কঠিন হয়ে পড়বে৷ দাম বেড়ে যাবে৷ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্প উৎপাদনে৷''
অপ্রচলিত বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়ছে৷ কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেখানেও নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করেন তিনি৷
মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে৷ পোশাক রপ্তানির শীর্ষ ১০ নতুন বাজারের দুটি হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও সৌদি আরব৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ইউএই ও সৌদি আরবে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রমে ৩৭ ও ৪৭ শতাংশ৷ তবে যুদ্ধ বিস্তৃত হলে এই বাজার কতটা টিকবে তা নিয়ে আশঙ্কা আছে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের৷
দুশ্চিন্তায় শিল্প উৎপাদন থেকে বিনিয়োগ
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ'-এর চেয়াম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘‘মধ্যপ্রাচ্যে যে সংকট চলছে তার প্রভাব বাংলাদেশে কতটা হবে তা নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর৷ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যদি যুদ্ধ লেগে যায়, এটা যদি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হয় এবং এই যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে আমাদের অর্থনীতিতে সরাসরি দুইটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ প্রথমত, আমাদের মূল জ্বালানি হলো তেল৷ আর এরজন্য আমরাসহ বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল৷ রাশিয়া ছিলো৷ কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেটা কাজে লাগানো যাচ্ছে না৷ এছাড়া আমরা এলএনজি আনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে৷ এখন এই পরিস্থিতিতে ওই বাজার অস্থির হয়ে যাবে৷ দাম বেড়ে যাবে৷ ফলে আমাদের এখানে পণ্য উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন, পরিবহণ সবখানে খরচ ও দাম বেড়ে যাবে৷ এটা রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷''
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ যেসব শিল্প উৎপাদন গ্যাস বিদ্যুৎ নির্ভর সেখানে সমস্যা হবে৷ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমবাজারেও প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
তিনি জানান, ‘‘সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী৷ সৌদি আরব প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশে৷ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এই বিনিয়োগ আমরা নাও পেতে পারি৷''
সিপিডির গবষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘জ্বালানি তেল নিয়ে আমরা এরইধ্যে চাপে আছি৷ এখন যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি চলতে থাকে ইরান ইসরায়েলের এই অবস্থায় তৎপরতা আরো বাড়ে তাহলে জ্বা লানি তেল নিয়ে আমরা আরো চাপে পড়ব, এলএনজি নিয়েও চাপে পড়বো৷ তার প্রভাব অমাদের অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই পড়বে৷''
এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা করেন তিনি৷
সংকট কতটা সামাল দেয়া যাবে?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘আসলে আমাদের অভ্যন্তরীণ নির্ভরতা বাড়াতে হবে৷ কৃষিতে যেরকম আমরা অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে অনেক এগিয়ে তেমনি অন্য খাতেও প্রয়োজন৷ কিন্তু জ্বালানি খাতে তো আমরা আমদানি নির্ভর৷ শিল্পের কাঁচামালের জন্যও আমাদের নিজস্ব উৎপাদনে যেতে হবে৷ আর সরকারি ও বেসরকারি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কমাতে হতে পারে৷''
ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘‘আমাদের জ্বালানির জন্য বিকল্প সোর্সের দিকে যেতে হবে৷ সিংগাপুর, অষ্ট্রেলিয়ার কথা ভাবা যেতে পারে৷ আগাম জ্বালানি কিনে রাখা যায়৷ যদি বিকল্প পথে জ্বালানি আনতে হয় তার খরচ এখনই হিসাব করা দরকার৷ তবে এসব করে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া গেলেও সংকট হবেই৷''
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ডয়চে ভেলেকে জানান, সরকার এরইমধ্যে ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি বিকল্প উপায়ে কীভাবে আনা যায় তার পরিকল্পনা করছে৷ সমুদ্রপথে সংকট দেখা দিলে উড়োজাহাজের রপ্তানি পণ্য পাঠানোর চিন্তা করছে সরকার৷ বলেন," আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আকাশ পথ ব্যবহার শুরু করেছি৷ আমরা এজন্য কার্গো উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা করছি৷ প্রয়োজনে এয়ার শিপমেন্ট বাড়িয়ে দিব৷''
ভোগ্যপণ্যের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা এবং আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগে করা হচ্ছে বলে জানান৷
জ্বালানি তেলের ব্যাপারে প্রয়োজনে রাশিয়ার আগের প্রস্তাবগুলো পরীক্ষা করে দেখা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বিকল্প সোর্স তো লাগবে৷ আর এখন অভ্যন্তরীণভাবে কিছু জ্বালানি তেল আমরা পাচ্ছি৷ আরো বিকল্প দেশের কথা ভাবা হচ্ছে৷''
তিনি বলেন," পরিস্থিতির ওপর সরকার নজর রাখছে৷ আমরা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি৷''