মতিউরের প্রথম স্ত্রীর কথা আমলে নিতে চাই না: ফরিদা ইয়াসমিন
৫ জুলাই ২০২৪সাংবাদিকদের আসলেই কি কেনা যায়? কতটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারছেন সাংবাদিকরা? এসব বিষয় নিয়ে ডিডাব্লিউর সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় নারী সংসদ সদস্য ফরিদা ইয়াসমিন৷
ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের স্ত্রী বলেছেন, তিনি বড় বড় সাংবাদিক কিনেই এখানে এসেছেন৷ আসলে সাংবাদিকদের কি কেনা যায়?
ফরিদা ইয়াসমিন : মতিউর রহমানের স্ত্রী কী বলেছেন সেটা আমি আমলে নিতে চাই না৷ উনি এর আগেও সাংবাদিকদের নিয়ে কথা বলেছেন৷ তখন বলেছিলেন, টাকা ছড়ালেই সাংবাদিকদের কেনা যায়৷ সেটাও ভাইরাল হয়েছিল৷ এখন তো মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা হচ্ছে, গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খবর আসছে৷ এই পরিস্থিতিতে তিনি কী বলছেন, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চাই না৷ অনেকেই বলছেন, মতিউরের স্ত্রীর কথার প্রতিবাদ করা উচিত৷ কাকে কিনেছেন? সেই নামগুলো তার কাছ থেকে চাওয়া উচিত৷ আমার মনে হয়, মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি এমন কথা বলতে পারেন৷ এখন কথা হলো, সাংবাদিকদের কেনা যায় কিনা? সেক্ষেত্রে আমাদের আগে শনাক্ত করতে হবে কে সাংবাদিক? এই যে বলা হচ্ছে, কেনা যায়? তাহলে সেই সাংবাদিক কারা? এখন যদি আমি মূলধারার গণমাধ্যমের কথা বলি তাহলে একরকম৷ আবার অন্যদিকে অনলাইন মিডিয়ার কথা বলি, সেটা আরেকরকম৷ সোশ্যাল মিডিয়া একরকম৷ আবার এখন প্রত্যেকেই সাংবাদিক৷ অনেকেই এখন একটা অনলাইন পোর্টাল তৈরি করছে, যেটার কোনো নিবন্ধন নেই৷ সেও কিন্তু নিজেকে সাংবাদিক দাবি করছে৷ ফলে আগে আমাদের দেখতে হবে সাংবাদিক কারা, কাদের সম্পর্কে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে? আমাকে বা আপনাকে কি কেউ টাকা দিয়ে কিনতে পারবে? মূলধারায় যারা কাজ করেন এমন অনেক সাংবাদিক আছেন, যাদের টাকা দিয়ে কেনা যাবে না৷ আবার যারা টাকা নিচ্ছে, তারা আসলেই কি সাংবাদিক? ফলে মতিউরের স্ত্রীর বক্তব্য আমি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চাই না৷
অনেকেই বলেন, সাংবাদিকরা ম্যানেজ হওয়ার কারণে দুর্নীতির রিপোর্ট কম হয়৷ বিষয়টা কি এমন? নাকি সাংবাদিকদের অন্য কোনো সীমাবদ্ধতার কারণে দুর্নীতির রিপোর্ট কম হচ্ছে?
দুর্নীতির এই রিপোর্টগুলো কে করেছে? সাংবাদিকরাই তো করেছে৷ সরকারের কোনো দপ্তর বা বিভাগ কি এটা করেছে? তারা যেখানে চাকরি করেন, সেখান থেকে কি এই অভিযোগগুলো আসছে? আসেনি৷ আমি আবারও যদি মতিউর রহমানের কথা বলি, তাহলে দেখবেন দুদকে তার বিরুদ্ধে চারবার অভিযোগ করা হয়েছে৷ তারা তদন্ত করে মতিউরের অবৈধ কোনো সম্পদ পায়নি৷ তাকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিয়েছে৷ সমস্ত নিউজগুলো কিন্তু মিডিয়া করছে৷ কম হয়, আমি ঠিক মনে করি না৷ সাংবাদিকরা যতটুকু সম্ভব, করছে৷ সাংবাদিকরা লিখছে বলেই মানুষ জানতে পারছে৷ সাংবাদিকরা আগেও এই ধরনের রিপোর্ট করেছেন, সবসময়ই করছেন৷
এখন দুর্নীতির যে ধরনের চিত্র সামনে আসছে, তাতে কি দুর্নীতির রিপোর্ট এতদিন আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল না?
এটা হয়ত আমরা মনে করতে পারি, এখন রিপোর্টগুলো হচ্ছে, আগে কেন হয়নি? আগেও কিন্তু হয়েছে৷ আর দুর্নীতির রিপোর্ট তো পেতে হবে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় যেটা সম্ভব যে, শুনলাম আর লিখে দিলাম৷ কিন্তু পত্রিকায় ছাপাতে গেলে অনেক কাজ করতে হয়৷ একজন রিপোর্টারকে নানাভাবে এটা প্রমাণ করতে হয়৷ কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হয়৷ কয়েকটা ধাপে কাজ করার পর এই রিপোর্টগুলো বের হয়৷ একটা দুর্নীতির রিপোর্ট করতে হলে অনেক বেশি খাটতে হয়৷ অনেক তথ্য প্রমাণ জোগাড় করতে হয়৷ শুধু অভিযোগ পেলেই লেখা যায় না৷ সঙ্গে সাপোর্টিং পেপার সংগ্রহ করতে হয়৷ সাংবাদিকদের জন্য কিন্তু কেউ ডকুমেন্ট নিয়ে বসে থাকেন না৷ তাদের কষ্ট করে এগুলো সংগ্রহ করতে হয়৷ তারপর সাংবাদিকরাই এই রিপোর্ট করবে, সে ব্যাপারে তো জনগণের প্রত্যাশা থাকেই৷ জনগণ মনে করেন, সাংবাদিকরাই এটা তুলে ধরবেন৷ সে অনুযায়ী হয়ত আরও দুর্নীতির রিপোর্ট তারা প্রত্যাশা করতেই পারেন৷
এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের টাকার প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে৷ এই প্রবণতা কতদিন হলো শুরু হয়েছে?
এই টাকা আসলে কারা দিচ্ছে? কোন প্রতিষ্ঠান, কোন সংগঠন? আবার নিচ্ছে কারা? আমার মনে হয়, ইত্তেফাকের কোনো সাংবাদিক এই ধরনের সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে টাকা নেবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে৷ এছাড়া মূলধারার যারা সাংবাদিকতা করছেন তারা কি নেবেন? নেবেন না৷ আমি প্রথমেই বলছিলাম, কাদের আমরা সাংবাদিক বলব? এই টাকা কারা নিচ্ছে? হয়ত একটা অনলাইন খুলে বসেছে, সেটার কোনো রেজিষ্ট্রেশন নেই, তারা নিচ্ছে৷ আগে কিন্তু কখনও প্রেস কনফারেন্সে টাকা দেওয়ার কথা আমি শুনিনি৷ কেন টাকা দিতে হবে? এমন হতে পারে যারা দুর্নীতিবাজ তারা হয়ত মনে করছেন এদের টাকা দিলে নিউজটা ছেপে দেবে, শুধু তাদের দিচ্ছে৷ আমি মনে করি না, যারা প্রকৃত সাংবাদিক তারা এই ধরনের টাকা নেন৷
এখন তো মিডিয়ার মালিক হচ্ছে বড় ব্যবসায়িক গ্রুপ৷ যাদের স্বার্থের কারণে সাংবাদিকরা চাইলেই অনেক রিপোর্ট করতে পারেন না৷ এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরাও কি সুবিধা নিয়ে রিপোর্ট করা থেকে বিরত থাকছেন?
এই বিষয়টা কিন্তু নতুন না৷ মালিকদের একটা প্রেশার তো থাকেই৷ তাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয় থাকে৷ রাজনৈতিক কিছু বিষয়ও থাকে৷ সাংবাদিকদের কিন্তু অনেক কিছু মাথায় রেখেই কাজ করতে হয়৷ মালিকরা কোনটা পছন্দ করছেন, কোনটা পছন্দ করছেন না, সেটা তো সাংবাদিকদের মাথায় রাখতেই হয়৷ এখন কর্পোরেট সেক্টর মালিকানায় আসছে, তারা তো তাদের স্বার্থটা দেখবেই৷ রুটি-রুজির কারণে অনেক সময় সাংবাদিকদের এই বিষয়টায় কম্প্রোমাইজ করতে হয়৷ তবে যারা শুধু সংবাদপত্রের ব্যবসা করতে আসেন তারা কিন্তু এই ধরনের কাজ করেন না৷ সেখানে পেশাদার সাংবাদিকরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন৷ সরকারের চাপ, মালিকদের চাপ, পত্রিকার নীতিমালা সবকিছু মিলিয়ে সাংবাদিকরা যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, এমনটা না৷ এটা শুধু আমাদের দেশে না, সব দেশেই৷ পশ্চিমা দেশগুলোতে যদি দেখেন সেখানেও কি সাংবাদিকরা অবাধ স্বাধীনতায় কাজ করতে পারেন? পারেন না৷ নানা ধরনের চাপের মধ্যেই সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়, সেভাবেই করে যাচ্ছেন৷
অনেক গণমাধ্যমে সাংবাদিকদের সঠিকভাবে বেতন হয় না৷ ফলে তারা ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে চলছেন৷ এতে সাংবাদিকতা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
আপনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন, সেখানে যদি নিয়মিত বেতন ভাতা না হয় তাহলে তো সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবেই৷ একজন সাংবাদিক চলবেন কীভাবে? তাকেও তো সংসার চালাতে হয়৷ তিনি তো না খেয়ে থাকতে পারবেন না৷ আমি মনে করি, যারা প্রতিষ্ঠান চালান তাদের এই বিষয়টা ভাবা উচিত৷ একজন লোক তার ওখানে কাজ করছে, তাকেও তো চলতে হবে৷ সাংবাদিকতাকে আমরা বলি, মহান পেশা৷ সবকিছু ঠিক আছে৷ তারপরও তো তাকে বেঁচে থাকতে হবে৷ আগে যেমন ধরেই নেওয়া হতো, সাংবাদিক মানে কষ্টে চলবেন৷ তার কোনো পয়সা থাকবে না৷ এখন কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে৷
প্রেস কাউন্সিল থেকে সাংবাদিকদের যে গ্রাজুয়েট হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি বাস্তবায়নে আপনাদের কোনো আপত্তি আছে কিনা?
আমি মনে করি, এতে কারই আপত্তি থাকার কথা না৷ কারণ একটা কাঠামো তো থাকা উচিত৷ এখন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের যুগ নাই৷ তারা স্কুলে না গিয়েও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল হয়ে গেছেন৷ তারা প্রকৃতি থেকে শিখেছেন৷ তারা জীবন থেকে শিখেছেন৷ এখন যে জীবনধারা তাতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে৷ সাংবাদিকতায় কিন্তু এমএ পাস, বিএ পাস বা পিএইচডি করলেও আসতে পারে না৷ নিজস্ব ক্রিয়েটিভিটি না থাকলে কেউ সাংবাদিকতা করতে পারেন না৷ আমি যদি মনে করি, অনেক শিক্ষিত হলে সাংবাদিকতা ভালো করবে, এটা কিন্তু ঠিক না৷ তবে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা দরকার৷ এটাকে একটা কাঠামোর মধ্যে আনার প্রয়োজন আছে৷ এই সময়ে কেন একজন সাংবাদিক গ্রাজুয়েট হবে না? একাডেমিক শিক্ষারও প্রয়োজন আছে৷
এখন তো পানি ব্যবসায়ী, কাপড় ব্যবসায়ী, আবাসন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ফড়িয়ারা গণমাধ্যমের সম্পাদক হচ্ছেন৷ এর ফলে সম্পাদক নামের যে প্রতিষ্ঠানটি ছিল সেটা কতটা গুরুত্ব হারাচ্ছে?
এর ফলে সম্পাদকদের গুরুত্ব কমছে৷ সাংবাদিকতা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ কিছু টাকার মালিক কীভাবে যেন সম্পাদক হয়ে যাচ্ছেন, পত্রিকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন৷ পত্রিকাও হয়ত ঠিকমতো বের হয় না৷ তিনি জাননেও না কীভাবে পত্রিকা বের করতে হয়৷ এটা খুবই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত৷ আগে যেটা ছিল ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকলে কেউ সম্পাদক হতে পারবেন না৷ এই আইনটা এখন আর নেই৷ শুধু কাগজে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে হবে না, তিনি কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন সেটাও দেখা উচিত৷ মূলধারার প্রতিষ্ঠানে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে৷ এটার প্রয়োজন আছে৷ একটা প্রেসের মালিকও এখন সম্পাদক হয়ে যাচ্ছেন৷ কাট-পেস্ট করে একটা পত্রিকা বের করছেন৷ এটা হতে পারে না৷ সম্পাদকের একটা ন্যূনতম সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে৷ এটা বাস্তবায়নের জন্য আমি আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করব৷
এখনতো সামাজিক মাধ্যম বা অনলাইনের নামে দেশে হাজার হাজার মানুষ নিজেদের সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন, এর ফলে পেশাদার সাংবাদিকরা কী ধরনের বিড়ম্বনায় পড়ছেন? সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে কিনা?
অবশ্যই এর ফলে পেশাদার সাংবাদিকতাক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ সাংবাদিকরাও বিড়ম্বনায় পড়ছেন৷ এদের কারণে সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে৷ শুরুতেই যেটা বলছিলাম, মতিউরের স্ত্রী বলেছেন বড় বড় সাংবাদিক, কারা বড় বড় সাংবাদিক? কাদের তিনি চেনেন? মুখে আসল আর বলে দিলাম, সেটা তো হলো না৷ এখন তো সবাই সাংবাদিক৷ কে আসলে প্রকৃত সাংবাদিক, মূলধারায় কাজ করছেন সেটা নিয়েও মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন৷ এটা পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে দিয়ে দিচ্ছে, একজন প্রকৃত সাংবাদিক তো চাইলেও সেভাবে দিতে পারেন না৷ তাকে কষ্ট করে তথ্য নিশ্চিত করেই গণমাধ্যমে দিতে হয়৷ আবার সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু সাংবাদিকদের উপকারও করছে৷ প্রাথমিক অনেক তথ্য কিন্তু তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় পাচ্ছেন৷ মতিউরের বিষয়টি কিন্তু প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছিল৷ এরপর সাংবাদিকরা খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছেন৷ সোশ্যাল মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রে ক্লু ধরিয়ে দিচ্ছে৷ এতে উপকারও হচ্ছে৷