‘মঞ্চের অভাবে কমে গেছে মঞ্চ নাটক'
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ডয়চে ভেলে : বাংলাদেশে মঞ্চ নাটকের বর্তমান অবস্থা কেমন?
রামেন্দু মজুমদার : আমাদের মঞ্চ নাটক বা নাট্য চর্চা বলি, এটা স্বাধীনতার সমবয়সি৷ এ দেশে নাটক হয়েছে দুইশ' বছরের উপরে৷ স্বাধীনতার পরপরই গ্রুপ থিয়েটার চর্চাটা শুরু হয়েছে৷ তখন থেকেই প্রচুর দল হয়েছে৷ সত্তুর বা আশির দশক ছিল আমাদের প্রস্তুতি কাল৷ তখন অনেক নাটক প্রস্তুত হয়েছে৷ অনেক দল এসেছে৷ এখন সেটা একটা স্থিতিশীল জায়গায় এসেছে৷ তবে সমস্যা হলো, প্রয়োজন অনুযায়ী মঞ্চায়নের জায়গা বাড়েনি৷ এ কারণে অভিনয় একটু সীমিত হয়ে গেছে৷ আগে আমাদের দলগুলো মাসে ৬টা পর্যন্ত নাটক মঞ্চস্থ করতে পারতাম৷ এখন সেটা কমতে কমতে দুটো বা তিনটেতে এসে ঠেকেছে৷ এখন মূলত নাটক হয় শিল্পকলার তিনটি মঞ্চে৷ সেখানে অনেক আবেদন পড়ে৷ সবাইকে বণ্টন করতে গিয়ে সবার ভাগেই কম পড়ে৷ আমি মনে করি, এখনো ভালো নাটক হচ্ছে, তবে সেগুলো দর্শকের চোখে পড়ছে কম৷ ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে৷
মঞ্চ নাটক আর আগের মতো জনপ্রিয় নয় কেন?
জনপ্রিয় নয়, এটা আমি বলব না৷ সত্তুর বা আশির দশকে একটা বড় দর্শক গ্রুপ তৈরি হয়েছিল৷ এখন সেই দর্শক কমেছে৷ কমার নানা কারণ আছে৷ এর একটা প্রধান কারণ হলো যানজট৷ দেখেন, কেউ মিরপুর বা উত্তরা থেকে দুই ঘণ্টা করে চার ঘন্টা জার্নি করে এসে দেড় বা দুই ঘণ্টার নাটক দেখবেন, সেটা কল্পনা করা যায় না৷ আর দ্বিতীয় কথা হলো অনেক দল হয়েছে, অনেক নাটক হচ্ছে, সব নাটকই যে মানসম্পন্ন সেটা বলা যাবে না৷ ফলে নানা নাটকের ভিড়ে ভালো নাটক খুঁজে বের করা দর্শকদের জন্য একটু কঠিন৷ সেই সব কারণ মিলিয়ে দর্শক কম হচ্ছে৷
এখন শুধু এই সংশ্লিষ্ট মানুষ মঞ্চ নাটক দেখতে আসেন, সাধারণ মানুষ আসছেন না কেন?
আমরা আসলে তাঁদের আকর্ষণ করতে পারছি না, তাঁদের কাছে ঠিকমতো খবরটা পৌঁছাতে পারছি না যে, ভালো নাটকও হচ্ছে তাঁরা দেখতে আসতে পারেন৷ আরেকটা কারণ পারিপার্শ্বিকতা৷ তবে প্রধান অন্তরায় যানজট৷
টিভি চ্যানেলেও মঞ্চনাটকের জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে বলে বলা হচ্ছে, এর কারণ কী?
আমার মনে হয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় যদি মঞ্চ থাকতো, তাহলে দলগুলো সেখানে গিয়ে নাটক করতে পারত৷ ওই এলাকার দর্শকরা তখন সেই নাটক দেখতে পারত৷ এছাড়া আরো একটা কারণ হতে পারে, আমরা হয়ত দর্শকদের প্রত্যাশা মেটাতে পারছি না৷ সেটার জন্য একটা জরিপ করা প্রয়োজন৷ কারণ, তাঁরা আগে নাটক দেখতেন, এখন কেন দেখছেন না৷ এগুলো করা দরকার বলে আমি মনে করি৷
এখনকার জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কি মঞ্চে সেভাবে আসছেন?
হ্যাঁ, আসছেন৷ তবে সবাই যে আসছেন, তা নয়৷ অনেকে হয়ত সরাসরি টেলিভিশনের নাটকে চলে যাচ্ছেন৷ সেখানে দ্রুত খ্যাতি পাওয়া যায়, অর্থ পাওয়া যায়৷ মঞ্চটা আসলে অভিনেতা তৈরি হওয়ার জায়গা৷ এখানে যে কোনো মাধ্যমে অভিনয় করে টিকে থাকতে হলে মঞ্চে আসতে হবে৷ এটাই প্রকৃত জায়গা নিজেকে প্রস্তুত করার৷
ঢাকা শহরে মঞ্চ নাটকের জন্য কি পর্যাপ্ত জায়গা আছে?
না একেবারেই নেই৷ আগে মহিলা সমিতি ছিল৷ মাঝে অনেকদিন বন্ধ ছিল, এখন সেটা সংস্কারের পর খুলেছে৷ কিন্তু এখনো সেটা ততটা জনপ্রিয় হয়নি৷ যদিও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা ভর্তুকি দিয়ে মহিলা সমিতির ভাড়াটা একটা সহনশীল জায়গায় রেখেছে৷ তারপরও মহিলা সমিতি এখনো আগের মতো দর্শক টানতে পারছে না৷ আর ধরুন, ধানমন্ডি, মিরপুর, উত্তরা বা পুরনো ঢাকার কোথাও মঞ্চ নাটক করার সুযোগ নেই৷
ঢাকা শহরে নাটক করার জন্য কতগুলো মঞ্চ আছে?
এখন তো হল দুটো৷ একটা শিল্পকলা একাডেমির তিনটি মঞ্চ এবং মহিলা সমিতির একটি মঞ্চ৷ এর বাইরে আর তো কোথাও নাটক করার জায়গা নেই৷
মঞ্চ নাটক কি শিল্পীর অভাবে ভুগছে? নাকি আর্থিক সংকটও কি এ অবস্থা হওয়ার একটা কারণ?
আর্থিক সংকট তো সব সময়ই আছে৷ টিকিট বিক্রি করে তো ওই দিনের খরচ উঠানোটাই কঠিন হয়ে যায়৷ খুব কম দলই সেভাবে লাভ করতে পারে৷ এসব মেনে নিয়েই আমরা ভর্তুকিটা দেয়ার ব্যবস্থা করি৷ নাটকটা হলো আমাদের ভালোবাসা, আমাদের সত্বা৷ এটার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের ভাবনা প্রকাশ করতে চাই৷ শিল্পীর সংকট আছে বলে আমি মনে করি না৷ অনেক তরুণ শিল্পী এই মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে চান৷ পুরনোরাও অনেকেই করেন৷
আগে তো মঞ্চ নাটক তৈরি হয়েছে সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, এখনকার নাটকগুলোও কি সেভাবেই তৈরি হচ্ছে?
আগে যেমন সিংহভাগ নাটক সামাজিক বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত হতো, এখন বিষয় বদলে গেছে৷ মানুষে মানুষে সম্পর্ক, পুরানের নাট্যায়ন নিয়ে অনেক নাটক হচ্ছে৷ এগুলো হয়ত সাধারণ দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না৷ সুতারাং এটাও একটা কারণ৷ এসব কারণে হয়ত দর্শকদের পুরোপুরি প্রত্যাশা আমরা পুরণ করতে পারছি না৷ যেখানে সহজে মানুষ আসতে পারে, এমন সব জায়গায় নাটকগুলো করা দরকার৷
এখন অনেক শিল্পী অল্প দিনের মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছেন৷ মঞ্চ নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকার কারণেই কি এমন হচ্ছে?
আমি তো মনে করি, অভিনয় ক্ষমতা না থাকলে শুধু চেহারা দিয়ে বা হঠাৎ একটা সুযোগ পেয়ে অভিনয় করে টিকে থাকা মুশকিল৷ প্রথমত, নিজের মধ্যে ক্ষমতা থাকতে হবে এবং তারপর নিজেকে তৈরি করতে হবে৷ মঞ্চে অভিনয় করলে নিজেকে তৈরি করার সেই সুযোগটা আসে৷
সমাজে প্রভাব ফেলে কোন নাটক, মঞ্চ নাটক, নাকি শ্যুটিংয়ের নাটক?
আমি মনে করি, অবশ্যই প্রভাব ফেলে মঞ্চ নাটক৷ কিন্তু মঞ্চ নাটকের সীমাবদ্ধতা আছে৷ বেশি মানুষের কাছে এটা পৌঁছতে পারে না৷ কিন্তু টিভির নাটক দেখে বহু মানুষ৷ সেখানে নাটকগুলো এমন সব বিষয় নিয়ে নির্মিত হয়, যেগুলো ঠিক সমাজের কথা বলে না৷ সে কারণে সেগুলোর প্রভাব সমাজের কাছে আছে বলে আমার মনে হয় না৷
মঞ্চ নাটকে অভিনয় করা কি টিভি নাটকের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন?
নিশ্চয়ই৷ অনেকদিন ধরে মহড়া করতে হয়৷
মঞ্চ নাটককে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে গেলে কী করা প্রয়োজন?
আমার মনে হয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চ নির্মাণ করা প্রয়োজন, যাতে করে সেখানে নিয়মিত নাটক হতে পারে৷ ওই এলাকার দর্শকরা সেগুলো দেখতে পারেন৷ আর মঞ্চ নাটকের প্রচারে বিভিন্ন মাধ্যম খুঁজে বের করা দরকার৷ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সহায়তা চাই, যাতে করে মঞ্চ নাটকের খবরটা ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে৷ সরকারী একটা প্রণোদনাও প্রয়োজন৷ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনুদান হিসেবে ১০-২০ হাজার টাকা না দিয়ে এবার হয় দুই লাখ টাকা করে ২৫টি দলকে দিলো, পরের বছর আবার ২৫টি দলকে দিলো বা ৫০টা দলকে দিলো৷ এভাবে করলে আমার মনে হয় ভালো নাটক তৈরি হবে৷
ঢাকায় এখন কতগুলো দল আছে?
নিয়মিত কাজ করে এমন দল একশ'র উপরে হবে৷
গ্রামে এখন মঞ্চ নাটক কিভাবে হচ্ছে? বা আদৌ কিহচ্ছে?
না, সেভাবে হচ্ছে না৷ অনেক জেলা সদর আছে, সেখানে নিয়মিত কোনো নাটকই হয় না৷ ঢাকার পর বড় শহর চট্টগ্রাম৷ যদি সেখানকার কথাই বলেন, সেখানে প্রতিদিন নাটক হয় না৷ এটার জন্য স্থানীয় নাট্যকর্মীদের উদ্যোগটা নিতে হবে৷ এবং দর্শক তৈরি করতে হবে৷ তাঁরা বলেন, দর্শক নেই৷ আসলে দর্শক তৈরি করতে হবে৷ দর্শকরা যাতে আসেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে৷ প্রতিদিন না হোক সপ্তাহে একদিন বা দুই দিন নির্দিষ্ট করতে হবে যে ওই দুই দিন সেখানে নাটক হয়৷ সবাই যখন সেটা জানবেন, তখন তাঁরা আসতে শুরু করবেন৷
দর্শক রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে কি আপনারা একমত? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷