হারিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক সৌজন্য
১ জুন ২০১৯ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে জোর লড়াই হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে৷ বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের কান্ডারী যথাক্রমে দুই জনপ্রিয় নেতা নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ প্রচারে তাঁদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা চরমে উঠেছিল৷ বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন তৃণমূল নেত্রী৷ তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ‘গণতান্ত্রিক থাপ্পড়' মারার কথাও বলেছিলেন৷ বলেছিলেন, মোদীকে ‘কান ধরে ওঠবস' করতে হবে৷ এমনকি প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী-র প্রসঙ্গও উঠে এসেছে মমতার কথায়৷অন্যদিকে মোদী তৃণমূল নেতৃত্বকে ‘তোলাবাজ' তকমা দেন৷ বলেন, মাফিয়াদের প্রার্থী করেছে তৃণমূল৷ নির্বাচনি প্রচারে রাজনৈতিক সৌজন্যের গণ্ডি অতিক্রম করে চড়া সুরে আক্রমণ লক্ষ্য করা গিয়েছে বিজেপি ও তৃণমূলের অন্যান্য নেতাদের ক্ষেত্রেও৷ শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের অন্যত্রও এই ধরনের ঘটনা সামনে এসেছে৷ তবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এর তীব্রতা বেশি, যেহেতু এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল খুবই জোরালো৷
মোদী-মমতার রাজনৈতিক দ্বৈরথ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে সমাজের সর্বস্তরে৷ এই রাজনৈতিক বৈরিতার কি কোনো প্রভাব জনমানসে পড়ে? পর্যবেক্ষক, অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মোদী বা মমতা হলেন ক্যারিশমাটিক নেতা৷ এঁদের জনমোহিনী ক্ষমতা আছে৷ তাই এই নেতাদের মানুষ অনুসরণ করতে চায়৷ এঁরা কী বলেন সেদিকে নজর রাখে৷ প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে তীব্র চাপানউতোর দেখলে তার প্রভাব সমাজে পড়তেই পারে৷''
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা আছে৷ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দুই সরকারের শাসন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারে আলাদা দল ক্ষমতায় থাকলে বিরোধিতার পরিসর তৈরি হয়৷ নির্বাচনি লড়াইয়ের সময় সেই দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে৷ এমনকি বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের শাসক শিবিরের কেউই উপস্থিত ছিলেন না৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অনিন্দ্য বটব্যাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই রাজনৈতিক লড়াই নতুন কিছু নয়৷ অতীতে এমনটা দেখা গিয়েছে৷ তবে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতপার্থক্য যতই থাক না কেন, সৌজন্যের খাতিরে সাধরনভাবে বিভিন্ন দল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে৷ এবারে অনুষ্ঠানে কংগ্রেস থেকেও অনেকে ছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের তরফে ২০১৪ সালে অমিত মিত্র গিয়েছিলেন৷ এবারে কেউই উপস্থিত ছিলেন না৷ এতে বোঝা যাচ্ছে যত সময় যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে দু' দলের সৌজন্যের সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছে৷ ভবিষ্যতে আরও খারাপ হবে৷''
এতে কতটা ক্ষতি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর? অধ্যাপক বিমলশঙ্করের মত, ‘‘সাংবিধানিক সংকট হয়তো তৈরি হবে না৷ রাজনীতি ও শাসন পরিচালনা আলাদা বিষয়৷ তবে কেন্দ্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়৷ রাজ্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিস্থিতিতে থাকে৷ বিরোধিতা তীব্র হলে সেই জায়গায় একটা সমস্যা তৈরি হতে পারে৷''
তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে প্রবল এই দ্বন্দ্ব নিয়ে অন্য একটি মতও রয়েছে৷ বিরোধীরা সন্দিহান, আদৌ কতটা দ্বন্দ্ব রয়েছে দুই শিবিরের মধ্যে৷ প্রচার চলাকালীন কংগ্রেস ও বাম নেতৃত্ব বারবার বলেছেন, মোদী ও মমতার মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে, বিরোধিতা লোক দেখানো৷ এই ধরনের মন্তব্যের কারণ কী? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুজনের মধ্যে বিরোধ আছে বলে মনে হয় না৷ ২০১৪-র নির্বাচনি প্রচারেও আমরা বাকযুদ্ধ দেখেছিলাম৷ একজন অপর জনের কোমরে দড়ি পরাবেন বলেছিলেন৷ তারপর নারদ দুর্নীতিতে তৃণমূল নেতাদের টাকা নেওয়ার ছবি সামনে এসেছে৷ জেরা দূরের কথা, একটা চিঠিও পাঠানো হয়নি কেন্দ্রীয় সংস্থার তরফ থেকে৷''
কেন্দ্র ও রাজ্যে দুই ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে লড়াই এই লোকসভা নির্বাচনের পর অন্য মাত্রা পেয়েছে৷ আসন ও প্রাপ্ত ভোটের বিচারে তৃণমূলের থেকে সামান্য পিছিয়ে রয়েছে বিজেপি৷ ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন৷ সেই ভোটে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি৷ তাই প্রকাশ্যে মোদী ও মমতার মধুর সম্পর্কের ছবি অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না রাজনীতির বিশ্লেষকদের৷ অনিন্দ্য বলেন, ‘‘লোকসভা ভোটের ফল বেরোতেই তৃণমূলের বিধায়ক, পুর প্রতিনিধি, পঞ্চায়েত সদস্যরা দলে দলে যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে৷ যত দিন যাবে, এই প্রবণতা বাড়বে৷ তৃণমূল কংগ্রেসের একটা রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হবে৷ আর বিধানসভা ভোটে লড়াই আরো তীব্র হবে৷ তাই বাকবিতণ্ডা বাড়বে বৈ কমবে না৷ মোদী-মমতার সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হতে চলেছে৷'' অধ্যাপক বিমলশঙ্করের মতে, ‘‘অসৌজন্য বাংলার রাজনীতি থেকেই শুরু হয়েছিল৷ যখন ক্ষমতার ওপর আঘাত আসে, তখনই সৌজন্য চলে যায়৷ সে-ক্ষেত্রে বিজেপি লোকসভা ভোটে ভালো ফল করেছে৷ কার্যত দুটি দলই রাজনৈতিক ময়দানে যুযুধান৷ একে অপরের জমি কাড়তে তৎপর৷ তাই বিধানসভা ভোটের আগে সম্পর্ক কতটা উন্নত হবে, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে৷''