ভিসি নিয়োগে শতভাগ রাজনীতি
২৮ জানুয়ারি ২০২২বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের এই দলীয় ভাগ প্রকাশ পায় নানা রং দিয়ে৷ যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল হলো আওয়ামী লীগপন্থীর৷ বিএনপি- জামায়াতের হলে সাদা৷ বামপন্থীরা গোলাপী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগপন্থীরা হলুদ৷ বিএনপি- জামায়াতপন্থীরা সাদা৷
এই সময়ে আলোচিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরা আবার রং দিয়ে ভাগ নয়৷ আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের দুইটি গ্রুপ৷ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ৷ বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল শিক্ষক ফোরাম৷
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগপন্থীদের জন্য আছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিক্ষক পরিষদ৷ বিএনপিপন্থীদের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম৷
বাংলাদেশে এখন ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাস করা আছে৷ এরমধ্যে উপাচার্য নিয়োগ করা আছে ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৮টি৷ এরমধ্যে ৯৯টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে৷
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের(ইউজিসি) সচিব ফেরদৌস জামান জানান, ‘‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে ইউজিসির কোনোই ভূমিকা নাই৷ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে ট্রাস্টি বোর্ড তিনজনের প্যানেল পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের কাছ থেকে মতামত নেয় মাত্র৷’’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র চারটি ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হয়৷ ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়৷ বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আইন আছে৷
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য জানান, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করার কথা সিনেটে ভোটের মধ্য দিয়ে তিনজনের প্যানেল থেকে একজনকে৷ আর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ কারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) সেক্রেটারিয়েট হিসেবে কাজ করে৷ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেন৷ কিন্তু অধ্যাদেশভুক্ত একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সিনেটের মাধ্যমে প্রস্তাব যায়৷ বাকি তিনটিতে সেটা আর হয় না৷ কিন্তু সিনেট যে তিনজনের প্যানেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে একজনকে নিয়োগ দেন৷ ফলে যা হয়েছে, কে ভিসি হবেন তা পুরোপুরিই সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে৷ তাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য না থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়া সম্ভব নয়৷
বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে দেশের ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব উপাচার্যই সরকারপন্থী৷ তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন আগে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সদস্য ছিলেন৷ আর বর্তমানে ওই দলের সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন বা ক্যাম্পাস ভিত্তিক সরকার সমর্থক প্যানেলের সদস্য৷
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন৷ ভিসি হওয়ার পরও তিনি যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন৷ তিনি ভিসি থাকা অবস্থায় ওই পদ ছেড়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে অবশ্য বলেন, ‘‘ভিসি হওয়ার পর যুবলীগে আমার পদ আপনা আপনি ডিফাংক্ট হয়ে যায়৷ তাই সেখান থেকে পদত্যাগের বিষয় ছিলো না৷’’
তবে তার কথা, ‘‘রাজনীতি করা কোনো দোষের নয়৷ কিন্তু ভিসি হিসেবে দক্ষ না হলে সমস্যা৷ অনেকেই ভিসি হওয়ার জন্য রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেন৷ কিন্তু তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান থাকেনা৷ থাকলে তারা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চালাতে পারতেন৷ আমার দুই টার্মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তো কোনো সমস্যা হয়নি৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আসলে এখন অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাওয়ায় ভিসি পদের জন্য যোগ্য শিক্ষক পাওয়াও সমস্যা হয়ে গেছে৷ অনেকেই নানাভাবে তদবির করে ভিসি হয়ে যাচ্ছেন৷ যা সংকট তৈরি করছে৷’’
সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত এক ডজন ভিসিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ কেউ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন৷ কেউ আবার ছুটি নিয়ে ঢাকায় থেকে মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে কয়েকজন আছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন৷ বর্তমানেও আছেন যারা সরাসরি ছাত্র রাজনীতি করতেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন মনে করেন, ‘‘এই সরকার রাজনৈতিকভাবে বশংবদ শিক্ষকদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে৷ তাদের মেধা, মনন বিবেচনা করা হচ্ছে না৷ ফলে অন্তত এক ডজন ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে৷ ক্যাম্পাস অশান্ত হয়ে উঠছে৷ ৭৩-এর অধ্যাদেশেও ত্রুটি আছে৷ সারাবছর শিক্ষকদের নির্বাচন করতে হয়৷ তাহলে শিক্ষকেরা পড়াবেন কখন৷ আর সেখানে শিক্ষকদের জবাবদিহিতা কোথায় তা নিশ্চিত করা হয়নি৷ ফলে তারা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কাজ করেন৷’’
তিনি তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে সার্চ কমিটির প্রস্তাব করেন যা পাশের দেশ ভারতে আছে৷ তবে এই সার্চ কমিটি হতে হবে সরকারের প্রভাবমুক্ত শিক্ষাবিদদের নিয়ে৷ তারাই সার্চ করে ভিসি নিয়োগ দেবেন৷ সরকার যেভাবে করছে তাতে যোগ্য ভিসি পাওয়া সম্ভব নয়৷
শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদও মনে করেন, ‘‘দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা শিক্ষকেরাই ভিসি পদে নিয়োগ পাচ্ছেন৷ ফলে তারা দলীয় আনুগত্যে যতটা দক্ষ ভিসি হিসেবে ততটা নয়৷’’
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘ভিসিদের ক্যাম্পাসের শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতি, স্থানীয় রাজনীতি সবকিছুই ম্যানেজ করতে হয়৷ ফলে তাদের নানা চাপের মুখে থাকতে হয়৷ আবার নিজ দলের মধ্যেও একাধিক গ্রুপ থাকে৷ তাই দক্ষ ভিসি হতে হলে এখন রাজনৈতিকভাবে অনেক শার্প হতে হয়৷ দলীয়ভাবে নিয়োগ পেলেও নিরপেক্ষ থাকতে হবে৷’’
রাজনৈতিক নিয়োগের কারণে কোনো কোনো ভিসি সরাসরি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন৷ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অভিযোগ স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি৷
ফেরদৌস জামান জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে তারা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্তও করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী ভিসি যে অবৈধভাবে বড় ধরনের নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন বিদায়ের আগে আমরা সরকারকে জানিয়েছিলাম৷ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দুর্নীতির তদন্ত করেছি৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির তদন্ত করেছি৷ তবে তেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ভিসি নিয়োগে আমাদের উচ্চশিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব আছে৷ যেটা ইউজিসির মাধ্যমেই করার কথা আমরা বলছি৷ আমরা ভিসি হওয়ার যোগ্যদের তালিকা করব৷ তাদের ডাটা সংরক্ষণ করব৷ সরকার সেখান থেকেই নিয়োগ দেবে৷ কিন্তু তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না৷’’
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসি কুমার দাসও মনে করেন, ‘‘ভিসি নিয়োগে যাচাই বাছাই প্রক্রিয়াটা আরো স্বচ্ছ এবং উন্নত করা দরকার৷ যাতে সত্যিকার যোগ্য শিক্ষকরা ভিসি হতে পারেন৷ আর ভিসিদের হতে হবে শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বান্ধব৷’’