ভারতে নির্বাচনের আবহে এক অনুষ্ঠানে সদ্য় অবসরপ্রাপ্ত এক কূটনীতিকের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সুযোগ হলো। স্বাভাবিকভাবেই কূটনীতিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো ভারতের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতির প্রসঙ্গ। আর তার হাত ধরে নানাবিধ কূটনৈতিক জোট। কেবলমাত্র সেদিনের সেই কথপোকথন তুলে দিলেই এদিনের এই লেখা সম্পূর্ণ হতো। কিন্তু যেহেতু একান্ত আলাপচারিতায় গোপনীয়তার দায় ছাড়াই কথাগুলি বলেছিলেন ওই কূটনীতিক, তা-ই তার নাম বা উদ্ধৃতি ব্যবহার করব না এই লেখায়। কিন্তু তার কথার স্পিরিটগুলি ধরার চেষ্টা করবো।
গোড়াতেই বলে নেওয়া ভালো, প্রাতিষ্ঠানিক যে জোটগুলি ঐতিহাসিককাল থেকে বিশ্ব কূটনীতিতে আলোচিত হয়ে আসছে, তা যে কতটা অকেজো হয়ে পড়েছে বর্তমান দুনিয়ায়, সে কথা দিয়েই আলোচনা শুরু করেছিলেন ওই কূটনীতিক। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন জাতিসংঘ এবং সার্কের প্রসঙ্গ। তিনি যখন জাতিসংঘের সমালোচনা করছেন, মনে পড়ছিল, কয়েকমাস আগে দিল্লিতে জি-২০ চলার সময় আরেক ভারতীয় কূটনীতিক রিভা গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ''জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তার আয়তন। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়েছে এই মঞ্চ। আর সে কারণেই আরো নতুন নতুন বিষয়ভিত্তিক মঞ্চের প্রয়োজন বাড়ছে।''
খানিকটা রিভার লাইনেই কথা বলছিলেন অন্য কূটনীতিক। বলছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন সার্কের চেয়ে কোয়াডের গুরুত্ব বেশি। অথবা সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের! তার কথার ভিতর থেকে আসলে যে স্পিরিটটি বার হয়ে আসছিল, তা হলো, বড় মঞ্চ নয়, ছোট ছোট ভূরাজনৈতিক বিষয়ভিত্তিক জোটই এই সময়ের কূটনীতির অন্য়তম চালিকাশক্তি। আপাত চোখে অনেক সময়েই মনে হয়, এই ধরনের ছোট ছোট জোটগুলি আসলে এক ধরনের কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। কিন্তু আপাত চোখে যা স্বার্থের দ্বন্দ্ব বলে মনে হয়, তা আসলে নয়া ভূরাজনৈতিক পরিবেশে এক ধরনের ব্যালান্স বা ভারসাম্য় তৈরি করে। ভারতীয় কূটনীতি এখন সেই ভারসাম্য়ের খেলাটিই খেলতে চাইছে।
দুইটি উদাহরণ দেওয়া যাক-গত কয়েকবছরে কোয়াড নিয়ে ভারত অত্য়ন্ত সরব। কোয়াড অর্থাৎ, অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের জোট। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই জোটের গুরুত্ব অপরিসীম। ক্ল্যাসিকাল কূটনীতি বলবে, এই জোট আসলে চীনের সামনে একটি ব্য়ারিকেড তৈরির জন্য় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কথা ভুল নয়। কোয়াড নিয়ে বিশ্ব মঞ্চে বার বার নিজের অসম্মতি জানিয়েছে চীন। এই জোটের যৌথ সমুদ্র মহড়া নিয়ে নালিশও করেছেন শি জিনপিং। কিন্তু এই জোটে অংশ নেওয়ার অর্থ কি ভারত সার্বিকভাবে একটি চীন-বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে? ক্ল্যাসিকাল কূটনীতি সেদিকে ইঙ্গিত করলেও নয়া কূটনীতি তা বলবে না। নয়া কূটনীতি তখন সামনে নিয়ে আসবে সাংহাই কোঅপারেশনের অঙ্ক। রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে এই জোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ভারত। আর এখান থেকেই তৈরি হয় ভারসাম্য়ের নতুন তত্ত্ব। যেখানে কারও সঙ্গে না থেকেও আসলে সকলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার একটা অবস্থান তৈরি করা।
ক্ল্যাসিকাল জোটগুলি এই অবস্থানের জায়গাটি তৈরি করতে পারেনি। সেখানে সবটাই অনেকবেশি মেরুকৃত। সম্প্রতি রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান এবং ইসরায়েল-হামাস দ্বন্দ্বে সেই মেরুকরণ আরো বেশি স্পষ্ট হয়েছে। ভারত খুব সতর্কভাবে এই মেরুকরণের রাস্তা এড়িয়ে একটি তৃতীয় পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। আর এইটাই এই মুহূর্তে ভারতের কূটনৈতিক লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য়ে পৌঁছাতে ভারত ব্য়বহার করছে ছোট ছোট বিষয়ভিত্তিক জোটগুলিকে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথম সরকারে আসেন, তার কিছু বছর আগে মনমোহন সিংয়ের সরকার অ্যামেরিকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু চুক্তি বা নিউক ডিল সই করেছিল। ভারতে পরমাণু গবেষণার দ্বার যেমন খুলে দিয়েছিল এই চুক্তি, তেমনই ভারতকে পরমাণু শক্তি হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছিল। উল্লেখ্য, পরমাণু পরীক্ষা এর অনেক আগে করলেও ভারতের উপর জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই চুক্তি সেখান থেকে উত্তরণ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই চুক্তির ক্ষেত্রেও ভারত সাবেক জোট বা মঞ্চকে ব্যবহার না করে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার উপর জোর দিয়েছিল অনেক বেশি।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসেই প্রথম শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্কের সমস্ত নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন ভারতের 'প্রতিবেশী প্রথম' নীতি। অর্থাৎ, কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে। ১০ বছরে সেই পথেই কি চলেছেন মোদী? একদিকে এই প্রশ্নের উত্তর যেমন 'হ্যাঁ', তেমন অন্যদিকে 'না'।
গত ১০ বছরে মোদীভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিকে একটি পপুলার ডিসকোর্সে নিয়ে গেছেন। এটি আর কেবল কূটনীতির আলিন্দে আলোচনার বিষয় নয়। দেশের মানুষ এখন এনিয়ে কথা বলেন, আলোচনা করেন। বিভিন্ন দেশে গিয়ে ডায়াস্পোরার সঙ্গে দেখা করেন মোদী। তাদের নিয়ে সভা করেন। এবং ক্রমে যে বার্তাটি তিনি তৈরি করে ফেলেছেন, তা হলো ধর্মনিরপেক্ষ ভারত নয়, ভারতীয় কূটনীতির মূল আধারটি হলো হিন্দুত্ববাদ। যে কারণে অন্য় দেশে গিয়ে মন্দির উদ্বোধনকেও ভারত এখন কূটনীতির অংশ বলে মনে করে। ভারতের এই হিন্দুত্ববাদী পররাষ্ট্রনীতি একদিকে যেমন 'বিশ্বগুরু'র ধারণা তৈরি করেছে, আবার অন্য়দিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির ক্ষোভের কারণও হয়েছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ মালদ্বীপ। যে মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, তারাই সে দেশ থেকে ভারতকে সেনা ঘাঁটি সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশ আগের চেয়ে অনেক বেশি চীনপন্থি হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। চীন লাদাখ এবং অরুণাচলে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। আবার এই পরিস্থিতিতেই করোনার টিকা সবার আগে এই প্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছে দেয় ভারত। যে মালদ্বীপের সঙ্গে এত বৈরিতা, সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নিজের তৃতীয় দফার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান মোদী। অর্থনৈতিকভাবে যে শ্রীলঙ্কা অনেক বেশি চীন অভিমুখী হয়ে পড়েছিল, অর্থনৈতিক সংকটে তার পাশে দাঁড়ায় ভারত। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত যেভাবে তেল কিনেছে, পাকিস্তান কীভাবে তা কিনতে পারে, সে পরামর্শ চাওয়ার প্রসঙ্গ ওঠে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে। আর এই প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনেই কোনো না কোনোভাবে কাজ করেছে ছোট ছোট বিষয়ভিত্তিক জোট বা মঞ্চের গুরুত্ব।
বর্তমান কূটনীতিকেরা মনে করেন, ভারসাম্য়ের এই কূটনীতি ভারতকে বিশ্বের কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। তবে একই সঙ্গে একথাও সত্যি, ভারসাম্য়ের এই অবস্থান এক অতি সূক্ষ্ম সুতোর উপর দাঁড়িয়ে। সামান্য চ্যূতি ঘটলেই ভারত বড়সড় বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অ্যামেরিকা বা ইউরোপ যে ভালো চোখে দেখছে না, তা একবার নয়, বার বার বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে ভারতকে। আবার অ্যামেরিকার সঙ্গে অতি বন্ধুত্ব রাশিয়া বা চীন যে ভালো চোখে দেখছে না, তা-ও স্পষ্ট। আর এই বৃহত্তর ভারসাম্য়ের কূটনীতির উপরেই দাঁড়িয়ে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বা আরো ছোট করে বললে, ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলে ভারতের গুরুত্ব। এই ভারসাম্য়ের তত্ত্বই শেষপর্যন্ত ঠিক করবে ভারত কতদূর পর্যন্ত 'বিশ্বগুরু' হতে পারবে।