1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপও আছে

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
১৩ মে ২০২২

এটাই ভারতের প্রকৃত পরিস্থিতি৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন আছে, তেমনই আছে সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের নিরন্তর প্রয়াস৷

https://p.dw.com/p/4BG1g
Indien | Demonstration für Pressefreiheit
ছবি: Javed Akhtar/DW

ভারতীয় সংবিধানে মতপ্রকাশের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে৷ যে কোনো নাগরিক মৌখিকভাবে, লিখে, ছাপিয়ে, ছবি  দিয়ে বা অন্যভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারবেন৷ সংবাদপত্রও ভারতে চতুর্থ স্তম্ভ বলে স্বীকৃত৷ অর্থাৎ, খবরের কাগজও নির্ভীকভাবে তাদের মতপ্রকাশের অধিকার পেয়েছে৷ আবার এই ভারতেই মতপ্রকাশের অধিকারের উপর, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর বারবার আঘাত করা হয়েছে৷ সাংবাদিকদের জেলে পাঠানো হয়েছে ও হচ্ছে৷ এই ঘটনা শুধু বর্তমানে হচ্ছে বা সাম্প্রতিক অতীতে হয়েছে তাই নয়, আগেও হয়েছে৷

ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করলেন এবং সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপ চালু হয়ে গেল৷ রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও জেলে পোরা হলো৷ কলকাতার দুই প্রখ্যাত সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ ও বরুণ সেনগুপ্তকেও জরুরি অবস্থায় জেলে রাখা হয়েছিল৷ কী খবর যাবে তা সরকার ঠিক করে দিত৷ আবার সেই জরুরি অবস্থার সময় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সম্পাদকীয়র জায়গাটা সাদা রেখে কাগজ বের করেছিল৷ সেই অভিনব প্রতিবাদ ছিল সেসময় লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার৷

ফলে ভারতে সংবিধান স্বীকৃত অধিকার ও সেই অধিকারের উপর আঘাতের ঘটনা পাশাপাশি চলে আসছে৷ এই সময়ের ছবিটাও দেখুন৷ কংগ্রেসসহ বিরোধী নেতারা সমানে অভিযোগ করেন যে, ভারতে এখন অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে৷ তাদের দাবি, নরেন্দ্র মোদী সরকার সংবাদমাধ্যমের উপর চাপ দিয়ে তাদের শুধু সরকারপন্থি খবর প্রকাশে বাধ্য করে৷ বিরোধীদের খবর বা সরকারবিরোধী কোনো খবর তাই ভারতের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বিশেষ ছাপা হয় না৷ একটা সময় তো রাহুল গান্ধী সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসে প্রথমেই বলতেন, ‘‘মোদী সরকারের বিরুদ্ধে, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আমার সমালোচনা তো আপনারা দেখাবেন না৷ ছাপবেনও না৷ তবে আপনাদের দোষ দিচ্ছি না৷ আপনাদের খবর করতে দেয়া হয় না৷ খবর করলে চাকরি যাবে৷’’ তখন বারবার করে রাহুল সাংবাদিকদের বলতেন ‘ডরো মত’, মানে ভয় পেয়ো না৷ এই অভিযোগ করে করে রাহুল সম্ভবত এখন ক্লান্ত হয়ে গেছেন৷ এখন তিনি আর ডরো মত-টত বলেন না৷

এরপরেও ঘটনা হলো, রাহুলের কথা বহু চ্যানেলে লাইভ দেখানো হয়, অধিকাংশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়৷ কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধী খবর যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না, এমন নয়৷ প্রচুর কাগজে, টিভি চ্যানেলে ও ডিজিটাল মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ও মোদী-বিরোধী খবর দেখতে পাবেন৷ আবার উল্টো দিকের ঘটনাও আছে৷ যারা সরকার-বিরোধী সংবাদ করে এমন কিছু সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআই তদন্তের অভিযোগ উঠেছে৷  এরকম দুইটি নাম হলো, দৈনিক ভাস্কর ও ভারত সমাচার৷ ইডি-র বক্তব্য, আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্ত করতেই তারা গিয়েছিলেন৷

তবে রাহুল গান্ধীর কথা শুনে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, এই কাজ শুধু কেন্দ্রীয় সরকার করে, অভিযোগটা শুধু মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ওঠে, বাকি কোনো দলের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ ওঠে না৷ রাহুল গান্ধীর সরকার যেখানে আছে, সেই রাজস্থানেও সম্প্রতি অশোক গেহলট সরকারের পুলিশ সাংবাদিকের বাড়িতে হামলা করেছে৷ ওই সাংবাদিক জাহাঙ্গিরপুরির সঙ্গে ভিলওয়াড়াকে জড়িয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন৷ আর যে সরকারে কংগ্রেস শরিক দল হিসাবে আছে, সেই মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরে সরকারের পুলিশ তো রিপাবলিকের সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীকে গ্রেপ্তার করেছিল৷

ভারতে একটা প্রবাদ খুবই জনপ্রিয়, যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ৷ কেন্দ্র বা রাজ্যে ক্ষমতায় যে-ই থাকুন না কেন, তাদের আচরণের প্রভেদ খুব কম, অন্তত এই জায়গায়৷ ফারাকটা কেবল বেশি-কমের৷ মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের কথা বলেছি, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গই বা বাদ যাবে কেন৷ উত্তরপ্রদেশে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর করার দায়ে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ৷ রিগিংয়ের খবর করার জন্য আগ্রায় এক সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ হাথরাসে ধর্ষণের খবর করতে যাওয়ার পথে সিদ্দিক কাপ্পন ও তার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ সম্প্রতি কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে মন্তব্য করার জন্য পাঞ্জাব পুলিশ সোজা দিল্লিতে এসে এক বিজেপি নেতাকে আটক করে তাদের রাজ্যে নিয়ে যেতে গিয়েছিল৷ ওই লঙ্কা-রাবণ কেস৷

পশ্চিমবঙ্গে তো মুখ্যমন্ত্রীর কার্টুন আঁকার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল অম্বিকেশ মহাপাত্রকে৷ মুখ্যমন্ত্রীকে জনসভায় প্রশ্ন করার জন্যও এক যুবকের একই হাল হয়েছিল৷ একজন সাংবাদিককে মাঝরাতে বাড়ির দরজা ভেঙে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, যেন কোনো সন্ত্রাসবাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷৷ যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে সম্প্রতি স্থগিত রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট, সেই আইনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কতজনকে যে ধরা হয়েছে, তার হিসাবে চোখ বোলালে দেখা যাবে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে গেছে৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

আর সংবাদপত্র, চ্যানেল, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মালিকরা যেহেতু মূলত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, তাই সরকারের পক্ষে তাদের চাপ তৈরি করার কাজটাও সহজ হয়৷ সাধারণ মানুষকে নিরস্ত করা আরো সহজ৷ আইন থাকুক বা না থাকুক, সরকার চাইলে নানাভাবে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতেই পারে এবং অনেকখানি সফলও হতে পারে৷ আর ভারতে তো আইনের অভাব নেই৷ ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর বুলডোজার চালাতে গেলে নতুন করে কোনো আইন করারও দরকার নেই৷ সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিলেই অধিকাংশ সংবাদপত্র ও চ্যানেলের নাভিশ্বাস উঠবে৷ ফলে ডান-বাম, দক্ষিণপন্থি, মধ্যপন্থি সকলেই এই অস্ত্রটা ব্যবহার করেছে, এখনো করছে, ভবিষ্যতেও করবে৷ আর বিরুদ্ধে কথা বললে ভারতীয় দণ্ডবিধি তো আছেই৷

কিন্তু এতকিছু বলার পরেও, এত উদাহরণ দেয়ার পরেও বলতেই হচ্ছে, মতপ্রকাশের অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা অত সহজ নয়৷ সংবাদমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা, বিরোধী খবর আগেও হতো, এখনো ঢালাও হচ্ছে৷ হয়ত কিছু সংবাদপত্রে বা চ্যানেলে কম হচ্ছে৷ হয়ত মতপ্রকাশের অধিকারের প্রয়োগ করতে অনেকে ভয় পাচ্ছেন৷ কিন্তু সামাজিক মধ্যম দেখুন৷ সেখানে মানুষ নিজের মত জানাতে পিছপা হচ্ছেন না৷ সে সব কথা ক্ষমতায় যারা বসে আছেন, তাদের কানে মধুবর্ষণ নাও করতে পারে৷ 

তাই, সব শেষ হয়ে যায়নি৷ যায় না৷ অন্ধকারের পর আলোর রেখা ঠিকই দেখা যায়৷