ভারতে জামিন নিয়ে যত জটিলতা
১৩ আগস্ট ২০২১ভারতীয় সমুদ্রে মাছ ধরতে বেরিয়ে জলদস্যুর তাড়া খেয়েছিলেন এক মৎসজীবী৷ পালাতে গিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন বাংলাদেশের জলে৷ আটক হয়েছিলেন বিডিআর-এর হাতে৷ এর পরের গল্প লম্বা এবং পরিচিত৷ প্রথমে জেল৷ তারপর আদালত৷ আবার জেল৷ আবার আদালত৷ শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের নিম্ন আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়৷ কিন্তু কাহিনি শেষ হয় না৷ ভারত-বাংলাদেশ বন্দি প্রত্যার্পণ চুক্তিতে কীভাবে যেন দেশে ফেরার সুযোগ হয়ে যায় কার্যত নম্বর হয়ে যাওয়া ওই ব্যক্তির৷ ভারত নিয়ে আসে তাকে৷ কিন্তু বাংলাদেশে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ভারত বাড়ি যেতে দেয় না৷ আটক করে রাখে দেশের জেলে৷ এদিকে, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে বেকসুর খালাসের রায় হয়ে যায়৷ এতদিনে ফের নম্বর থেকে মৎসজীবী হওয়ার স্বপ্ন ফিরে আসে ওই ব্যক্তির৷ যদিও স্বপ্ন সফল হয়নি এখনো৷ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় প্রশাসনের হাতে কাগজ এলে তবেই মুক্তি সম্ভব৷ তার আগে নয়৷ দস্যুর তাড়া খাওয়া এক সাধারণ মৎসজীবী অপেক্ষায় আছেন আরো এক নিয়তির মোড় বদলের৷
নিঃশ্বাসের বিরতি নিলেন আইনজীবী৷ আড়চোখে সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে সামান্য ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, ‘‘এটা কোনো ব্যতিক্রমী গল্প নয়৷ হাজার হাজার মানুষ এভাবেই পড়ে আছেন ভারতীয় জেলে৷ কত মানুষ বেঘোরে মরে গেছেন এভাবেই! মৃত্যুর পর বাড়ির লোক জানতে পেরেছেন, আসলে নির্দোষ ছিলেন বন্দি৷’’
ভারতের ছোট থেকে বড় অসংখ্য আদালতের অলিন্দে অলিন্দে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক কাহিনি৷ এই লেখার সূত্রে বহুদিনের পরিচিত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অরিন্দম দাসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল৷ ওই মৎসজীবীর গল্প ছাড়াও আরো সব আশ্চর্য গল্প বলছিলেন অরিন্দম৷ বলছিলেন, আসলে সবটাই কীভাবে টাকার উপর নির্ভর করে৷ হ্যাঁ টাকাই৷ যে বন্দির টাকা আছে, ভালো আইনজীবী রাখার সুযোগও আছে তার৷ অরিন্দম বলছিলেন, ফৌজদারি মামলায় আইনজীবীর উপর অনেক কিছু নির্ভর করে৷ যে আইনজীবী যত ভালো আইনের মারপ্যাঁচ জানেন, প্রায় অসম্ভব জামিনকে তিনি সম্ভব করে তুলতে পারেন৷ বিনিময়ে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক তার বরাদ্দ৷ সময় সময় যা কোটি কোটি টাকা৷ উদাহরণ হিসেবে সারদা মামলার কথা বলছিলেন অরিন্দম৷ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের নাম চার্জশিটে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে তারা জামিন পেয়ে গেলেন, আইনের সেই জটিল আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই৷ সহজ সত্য হলো, ভালো আইনজীবী রাখার রেস্তো থাকলে কঠিন মামলাতেও জামিন পাওয়া সম্ভব৷ কিন্তু সেই সুযোগ নেওয়ার মতো 'মালদার’ মানুষ আর ক'জন?
উল্টো দিকের চিত্র অবর্ণনীয়৷ ভালো উকিল না থাকলে বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে মামলা৷ তারিখের পর তারিখ আসে, শুনানি হয় না৷ যদি বা শুনানি হয়, বন্দির পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবী জামিনের আবেদন পর্যন্ত করেন না৷ আইনজীবী বন্দির সঙ্গে কখনো কোনো কথাই বলেননি, এমনো ঘটনা ঘটেছে৷ অরিন্দম বলছিলেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই বহু বন্দি জামিন পেয়েও জেলে আটকে আছেন, কারণ জামিন বন্ডে টাকা দেওয়ার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত তাদের নেই৷
এ তো গেল সাধারণ মানুষের কথা৷ এর বাইরে আছে রাজনৈতিক বন্দি৷ সম্প্রতি স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু বিষয়টিকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে৷ ভিমা কোরেগাঁও মামলায় আটক হয়েছিলেন স্ট্যান স্বামী৷ প্রৌঢ় ওই বৃদ্ধের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা করেছিল পুলিশ৷ ইউএপিএ কার্যত রাষ্ট্রদ্রোহের নামান্তর৷ সাম্প্রতিক কালে বহু রাজনৈতিক কর্মীকে এই ধারায় আটক করেছে রাষ্ট্র৷ জেলে কার্যত চিকিৎসার সুযোগ পাননি স্ট্যান স্বামী৷ শেষপর্যন্ত তার মৃত্যু হয়৷
স্ট্যান স্বামীর ঘটনা নতুন নয়৷ বছরের পর বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন জেলে এভাবেই আটকে আছেন বহু রাজনৈতিক বন্দি৷ ৭০ এর অগ্নিগর্ভ সময়ে জেলে মৃত্যু হয়েছিল নকশাল নেতা চারু মজুমদারের৷ সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গে বহু নকশাল নেতাকে ইউএপিএ ধারায় আটক করা হয়েছিল৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি৷ আর মোদীর ভারতে ইউএপিএ নিয়ে যারা লাফাচ্ছেন, কংগ্রেস আমলের কথা তারা ভুলে গেলে ভুল হবে৷
মনে রাখতে হবে, এই ইউএপিএ-তেই এক সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক বিনায়ক সেন৷ রাম জেঠমালানি দাঁড়িয়েছিলেন আদালতে৷ এমন বিতর্ক করেছিলেন, যে আদালত বিনায়ক সেনের জামিন মঞ্জুর করে৷ ইউএপিএ মামলা লড়ছেন এমন এক আইনজীবী নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে সাংবাদিককে বলছিলেন, এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে দুটো জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এক আইনজীবীর নাম এবং দুই তার বিচক্ষণতা৷ রাম জেঠমালানির মতো আইনজীবীরা যখন আদালতে দাঁড়াতেন, বিচারপতিরা তখন অনেক বেশি সচেতন হয়ে যেতেন৷ বড় আইনজীবীদের ধার ও ভারের গুরুত্ব অপরিসীম৷ আরো একটি বিষয় আছে৷ প্রশাসনের চাপ ও প্রভাব৷ সরকার প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ প্রশাসন যে ভাবে চার্জশিট তৈরি করে, আদালত তার উপর বিচার করে৷ বিরোধী রাজনৈতিক বন্দিদের উপর এমন সব চার্জ আনা হচ্ছে যে বড় বড় আইনজীবীও জামিনের ফাঁক খুঁজে পাচ্ছেন না৷ আবার শাসক দলের ঘনিষ্ট নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রে এমন ভাবে চার্জ সাজানো হচ্ছে যে, সহজেই তাদের জামিন মঞ্জুর হয়ে যাচ্ছে৷
আইনজীবীদের মতে, জামিন নিয়ে জটিলতা কাটার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ সমস্যাগুলির সুরাহাও সম্ভব নয়৷ নয় বলেই গত সত্তর বছর ধরে এই বিতর্কের অবসান হয়নি৷