ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া
৩ অক্টোবর ২০১৭ভাওয়াইয়া হচ্ছে দোতরার গান৷ দোতরা না হলে ভাওয়াইয়া গাওয়া যাবে না৷ নানা রকম বাদ্যযন্ত্র জুড়ে দেয়া হচ্ছে সকালবেলার টিভি অনুষ্ঠানগুলোতে৷ তাতে আমার আব্বার গানও আছে, আছে নতুনদের লেখা গান৷ সবই ঠিক, কিন্তু তা ভাওয়াইয়া হচ্ছে না৷ কারণ, ভাওয়াইয়া হচ্ছে আভরণহীন সংগীত, যা থাকবে চিরদিন নিরলংকৃত৷ অলংকার দিলেই মনে হবে, সে অন্যের মা, আমার নয়৷ আমার মা'র সাদা শাড়ি, তাতে একটি নীল পাড়৷ ঐটি আমার মা৷ যদি দশটা যন্ত্র জুড়ে দেন, তা হলে শুনতে বেশ ভালো লাগবে৷ কিন্তু ভাওয়াইয়া পালিয়ে যাবে৷
নতুন শিল্পীরা একদিনের তরেও আমার কাছে উপদেশের জন্যে আসেনি৷ আমাদের দেশের শিল্পীদের সেই কালচার নেই৷ তারা ভাবছে, ‘‘আমরা তো বেশ নিজেরাই উঠে যাচ্ছি৷ কারও প্রয়োজন হবে না৷'' কন্ঠটি জুতসই৷ কাজেই আমাকে ও ফেরদৌসীকে অনায়াসেই ডিঙ্গিয়ে যাওয়া যাবে, তা হবে না৷ ওরা আমাদের স্বীকৃতি পাবে না৷ শুধু কন্ঠ ভালো হলেই হবে না, ভালো হতে হবে ভাওয়াইয়ার রূপকে সঠিকভাবে পরিবেশন৷ আমার আব্বার তিন মিনিট দশ সেকেন্ডের একটি গান বাজান, দেখবেন, ওতে আছে একটি দোতরা, আর একটি ছোট্ট মন্দিরা৷ তবলাও নেই, বাঁশিও নেই৷ নেই হারমোনিয়াম, নেই অক্টোপ্যাড, নেই বেহালা, নেই অন্য কোনো বিদেশি যন্ত্র৷ কন্ঠটাই হলো যন্ত্র৷ আব্বাসউদ্দিনকে কেউ অতিক্রম করতে পারেনি, এই কারণে যে শুধু তাঁর কন্ঠ নয়, দেশের প্রতিটি গাছ তরুলতা নদী প্রান্তর তাঁর সঙ্গে গেয়ে উঠেছে৷ গান শেষ হওয়ার পর লোকে ভুগেছে পরম হতাশায়, কেন ‘ও মোর চান্দরে সোনা' গানটি শেষ হয়ে গেল! কেমন করে নারী হৃদয়ের বিরহ, আকুতি আব্বাসউদ্দিন ফুটিয়ে তুললেন কয়েকটি মিনিটে৷ গানগুলো গ্রামের৷ গানগুলো কালজানি নদীর তীরের৷ গানগুলো মরবে না, যতদিন আমরা বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে বাঙালি নাম ধারণ করে৷ আব্বাসউদ্দিনও মরবেন না৷
কেন? ঐ দোতরার জন্যে৷ আজকাল দোতরা বাজাতে কেউ শিখছেন না৷ রেডিওতে যারা ঢুকেছেন, তারা বেঁচে আছেন বাইরের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে৷ প্রতি অনুষ্ঠানে তারা তিন হাজার টাকা পান৷ ঐ টাকায় তারা ভাওয়াইয়ার বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন৷ কিভাবে? লোকে শুনতে চায় চটুল গান, বাজে কথা, বাজে ইংগিত, কৌতুককর কথা, অপর নাম চটকা৷ যন্ত্রীরা ব্যবহার করছেন ম্যান্ডোলিনের স্ট্রোক অথবা স্প্যানিশ গীটারের স্ট্রোক, যাতে খানিকটা আবহ আসে, কিন্তু আসলটি অনুপস্থিত৷
ভাওয়াইয়া তা নয়৷ আসল ভাওয়াইয়া দীঘল নাশি৷ অনেক দূর বিস্তৃত কন্ঠের জাদু৷ ঐটি গিয়ে আঘাত করে মানুষের হৃদয়ে৷ একটি মিনিটেই কাতর হয়ে পড়ে৷ আবার শুনতে চায় ঐ গানটি৷ কেন? কারণ, এটিই বাংলার জাদু৷
পশ্চিমবঙ্গে ভাওয়াইয়াকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে বিরাট কর্মসূচী গ্রহণ করেছে৷ গত তিরিশ বছর ধরে এইসব অনুষ্ঠানে দু-একবার যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে বৈকি৷ কখনও বিশেষ অতিথি, কখনও বা গায়ক হিসেবে৷ আব্বাসউদ্দিনের পুত্র হিসেবে সম্মান পেয়েছি৷ সবচেয়ে খুশি হয়েছি যখন দেখেছি নটু বর্মন ও তার মেয়েরা, গ্রামের গায়ক-গায়িকারা সেই পুরনো ঢংয়ে ভাওয়াইয়া গেয়ে চলেছেন৷ কথা বিকৃত হয়নি, সুর বিকৃত হয়নি, তাল বিকৃত হয়নি৷ কারণ, দোতরাটি ছিল অবিকৃত৷ লম্বা আকৃতির দোতরা, তাতে আছে মুগা সুতা, মধ্যমের তারটি শুধু মেটালিক৷ ভাওয়াইয়ার কথা রাজবংশী ভাষায়, বোল আলাদা, বাজানোর পদ্ধতি আলাদা৷ তাই ভাটিয়ালির দোতরার সঙ্গে এই দোতরা তুলনীয় নয়৷
একদিন আমার পিতা আব্বাসউদ্দিন ও দোতরা শিল্পী কানাইশীল গল্প করছিলেন৷ কানাইশীল বললেন, ‘‘দাদা 'ও কি চান্দরে মোর সোনা', 'ও কি গাড়িয়াল ভাই' এগুলোকে যখন ছাড় হয়েছিল, আমি বাজিয়েছি৷'' আমার আব্বা বললেন, ‘‘কানাই, তুমি বাজাওনি৷ এগুলো সব বাজিয়েছে অন্ধ শিল্পী টগর৷ আমার বলরামপুর গ্রামের৷ তুমি তাকে কোনোদিন দেখোনি৷ এই স্ট্রোক শেখোনি৷ তোমার বাজনা ভাটিয়ালি এবং বিচ্ছেদির জন্যে৷ তাই তোমাকে ভাওয়াইয়ার মধ্যে আনিনি৷'' কানাইশীলের ছেলে অবিনাশকে নিয়ে আমি কয়েকবার অ্যামেরিকায় গিয়েছি এবং সে আমার উপর খুশি৷ কারণ, তাকে সেখানেই ফেলে এসেছিলাম, যাতে তার দু'পয়সা রোজগার হয়৷ আজ সে নেই৷ ওকে ভাওয়াইয়ার স্ট্রোক শিখিয়েছিলাম, যেহেতু আমি দোতরা বাজাতে পারি৷
কানাই শীলের জ্যেষ্ঠ পুত্র আশুতোষ শীল এই স্ট্রোক শেখেনি৷ যখন টেলিভিশনে আমার সঙ্গে বাজাতো, তখন সে শুধু দাঁড়িয়ে থাকত৷ কারণ, ঐটি তার জানা নেই৷ ভাটিয়ালি এবং বিচ্ছেদির সঙ্গে সে আমার সঙ্গে ভালোই বাজাতো৷ অপর দোতরা শিল্পী, যাদেরকে আমি বিদেশে পাঠিয়েছি, তারা ভাওয়াইয়ার স্ট্রোক শেখেনি৷ একজনের নাম চান্দ মিয়া৷ অপর দোতরা শিল্পী ফেলু শেখ আমাকে অনেক নতুন গান তুলে দিয়েছে৷ তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ৷ কিন্তু সে ভাওয়াইয়ার স্ট্রোক শেখেনি৷ এরা সবাই পরলোকগত৷ এদের সম্বন্ধে কোনো মিথ্যাচার আমার পক্ষে অধর্ম হবে৷ এখন যারা দোতরা বাজাচ্ছেন ঢাকায়, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ সুলাইমান ছাড়া আর কেউ ভাওয়াইয়ার স্ট্রোক সম্বন্ধে অবহিত নয়৷ অথচ ওটি না বাজালে ভাওয়াইয়া হবে না৷ তাই ত্রিপুরার আগরতলায় যে বিরাট অনুষ্ঠান হলো, ত্রিপুরার রাজ্যপালের সামনে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ও আব্বাসউদ্দিনের এক সঙ্গে স্মরণ, সেখানে আমি মোহাম্মদ সুলাইমানকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ ভিসা দিতে চায় না৷ সে অনেক ব্যাপার৷ আমি পথের ভিসা না পেয়ে এয়ার ভিসার অধীনে ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা-কলকাতা-ঢাকা উড়ে গিয়েছিলাম৷ একজন ভিসা অফিসারও আমাদের সাহায্য করেনি৷ অথচ ওদের অনুষ্ঠানে আমি প্রায়ই গান গাই অল্প টাকায়৷
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় রংপুর, কুড়িগ্রাম, অঞ্চলের ভাওয়াইয়ার জন্যে কোনো বরাদ্দ নেই৷ মমতা ব্যানার্জির বরাদ্দ বছরে দু' কোটি টাকা৷ তাই আমি মমতা ব্যানার্জির সুখ্যাতি করব৷ ভুপতিভুষণ বর্মা, পঞ্চানন রায় ও এখানকার শিল্পীরা প্রায় না খেয়ে আছেন৷ আমার তেমন কোনো ক্ষমতা নেই যে, ওদেরকে সামান্যতম সাহায্য করি৷ তবু আমি কারও দ্বারে হাজির হইনি৷ কারণ একটিই: আমি আব্বাসউদ্দিনের পুত্র৷ 'চির উন্নত মমশির'৷
ভাটিয়ালি নিয়ে বই লিখেছি, তা নিয়ে কয়েক হাজার শব্দের প্রবন্ধ লিখতে পারি৷ কিন্তু তাতে কী লাভ হবে? ভাটিয়ালি মরে যাচ্ছে৷ কারণ, নদী মরে যাচ্ছে৷ নদীর উজানে বাঁধ বেধেছে বন্ধুরা৷ আর ভাটির দিকে সব নদী খেয়ে ফেলেছে লুটেরা সম্প্রদায়৷ নদী বন্ধ করে শহর, বন কেটে বসত৷ এই তো বাংলাদেশ৷ ভাটিয়ালি গান গাওয়ার লোক এখনও আছে৷ তারা প্রায় না খেয়ে আছে৷ কারণ, ওদের আসল ভাটিয়ালি আর কেউ শুনতে চায় না৷ চুটকি কথা, বাজে রসিকতা গানগুলোকে বানিয়েছে ভাগাড়ের সম্পদে৷ মেয়েরা বিশ্রি বিশ্রি কথা দিয়ে গান বানাচ্ছে ও টেলিভিশনে গাচ্ছে৷ সেগুলো লুটে নিচ্ছে শহুরে লোভী শ্রোতারা৷
কোথায় আব্বাসউদ্দিন, কোথায় জসীমউদ্দিন, কোথায় মমতাজ আলি খান, কোথায় কানাইলাল, কোথায় বিজয়? নতুন লেখকরা ঘাবড়ে গিয়ে নতুন নতুন ভাটিয়ালি লিখছেন, যাতে না আছে সুর, না আছে ছন্দ, না আছে ভাটিয়ালির রস৷ নদী নেই, নৌকো নেই, তা হলে ভাটিয়ালি থাকবে কী করে? জোর করে আমরা বলছি, ‘‘সব ঠিক হ্যায়''৷ বলছি, ‘‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই'' (শহীদ কাদরি)৷ আমি বহুবার বলেছি, ভাটিয়ালি মরে গেলে আমাদের গৌরব করার আর কিছুই থাকবে না৷
তবে সবই যে নেগেটিভ, তা নয়৷ সব নদী মরে গেলেও কিছু নদী বেঁচে থাকবে৷ সব নৌকো পথ হারালেও কিছু নৌকো বেঁচে থাকবে৷ যেমন বেঁচে আছে প্রাচীণ বাংলায়: 'কা আ তরুবর পঞ্চবিডাল...'৷ তেমনি, ‘নদীর কুল নাই কিনার নাইরে৷' তেমনি, ‘আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলিরে৷' ভালো দিন হয়ত আসবে, যখন আমরা থাকব না৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷