ব্যাংক খাতে পরিবর্তন আনার যত চেষ্টা
ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির উন্নয়ন অন্তবর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ৷ ব্যাংক খাত নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা, সরকারের পদক্ষেপ আর অর্থনীতিবিদদের মতামত নিয়েই এবারের ছবিঘর৷
নাজুক অবস্থা
ডলারের তীব্র সংকট, খেলাপি ঋণের ভারসহ নানা দিক সামলে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো অন্তর্বতী সরকারের জন্য খুব বড় চ্যালেঞ্জ৷ এরই মাঝে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার৷ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে এমন আশা ব্যবসায়ীদের অনেকের৷ ব্যাংক খাতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখছেন অর্থনীতিবেদরাও৷
‘এখনো দুর্বল ব্যাংক এড়িয়ে চলছি’
টেকনোলজি প্রতিষ্ঠান মোশন ভিউ-এর স্বত্বাধিকারী ইমরুল হাসান বলেন, ‘‘গত দুই-তিন বছর ধরে আমরা চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছি না৷ এখনও যে যতটা চাচ্ছি, ততটা পাচ্ছি- তেমন নয়৷ তবে আগের চেয়ে বেশি পাচ্ছি৷ বিশেষ করে ব্যাংকের কর্মকর্তারা ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কথা বলছেন৷ আগে থেকেই আমরা দুর্বল ব্যাংক এড়িয়ে চলছি, অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছি৷ আমাদের সঙ্গে যাদের লেনদেন, তারা আমাদের সহযোগিতা করছেন৷
‘ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে’
অ্যাপেক্স ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য কিছু সিসি লোন নিই এবং শোধ করে দিই৷ ফলে আমাদের এই লোন পেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি৷ অনেক ব্যাংক আবার আগে এটা দিতে চাইতো না৷ এখন যে পরিবর্তনটা দেখি, সেটা হলো, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে৷ তারা ঋণ দিতে না পারলেও এখন আমাদের ডেকে কথা বলেন৷ আগে তো তারা কথাই বলতেন না৷’’
‘সরকারের উদ্যোগে এক ধরনের ইতিবাচক অবস্থা দেখতে পাচ্ছি’
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘‘রাতারাতি বিরাট কোনো পরিবর্তন হবে এমনটা আমরা আশা করি না৷ বিগত সরকারের গত দুই-তিন বছর আমরা এলসি খুলতে যেমন পারিনি, তেমনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে আমাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে৷ এইসব সমস্যার সমাধান যে গত তিন মাসে হয়ে গেছে, এমনটি নয়৷ তবে সরকারের উদ্যোগের মধ্যে আমরা এক ধরনের ইতিবাচক অবস্থা দেখতে পাচ্ছি৷’’
‘প্রাধিকার ঠিক করার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে বলে মনে হচ্ছে’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক সেক্টরে একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে৷ উপদেষ্টাদের যারা অর্থনৈতিক সেক্টরের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের উদ্যোগগুলো ইতিবাচক৷ আবার কেউ কেউ পুরনো ধারায় সমাধানের চেষ্টা করছেন৷ এই প্রেক্ষাপটে আরো উদ্যোগ দরকার৷ প্রাধিকার ঠিক করার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে বলে মনে হচ্ছে৷’’
তারল্য সহায়তা দিয়ে ৭ ব্যাংককে বাঁচানোর চেষ্টা
তারল্য সহায়তা দিয়ে অর্থ সংকটে পড়া ৭টি ব্যাংককে বাঁচানোর চেষ্টা করছে সরকার৷ এরমধ্যে ইসলামী ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দুই হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সাত হাজার ৯০০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক দেড় হাজার কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি টাকা ও এক্সিম ব্যাংক চার হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা চেয়েছে৷
বিদেশি ঋণ এনে ঘুরে দাঁড়াতে চায় ন্যাশনাল ব্যাংক
বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক বিদেশি তহবিল এনে ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে৷ ২০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকটি৷ তহবিলটি আসবে নিউইয়র্কের জেপি মরগ্যান ব্যাংকের মাধ্যমে৷ ঋণের মেয়াদ ১০ বছর, বার্ষিক সুদের হার প্রায় ৫ শতাংশ৷ ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘‘আমরা ব্যাংকের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি৷ এ জন্য দেশি-বিদেশি সহায়তা নেওয়া হচ্ছে৷’’
বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি
বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে সামগ্রিক বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যা এক বছর আগে ছিল ৯৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার৷ এই ঋণের মধ্যে ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার নিয়েছে সরকারি খাত এবং বাকি অংশ নিয়েছে বেসরকারি খাত৷ অন্তর্বর্তী সরকার গত তিন মাসে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার এবং ঋনের সুদ বাবদ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার শোধ করেছে৷
অর্থনীতিতে এখনও যেসব চ্যালেঞ্জ
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনাই প্রধান চ্যালেঞ্জ৷ এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মনোযোগ দিতে হবে৷ শিল্পখাতে রপ্তানি ঠিক রাখতে গ্যাস ও বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে হবে৷ একই সঙ্গে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাদের স্বস্তি দেওয়াটা আরো বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা৷