‘বৈধতার সংকট কাটাতে উন্নয়ন আগ্রাসন ঋণগ্রস্ত করে ফেলে’
১৫ জুলাই ২০২২বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর জন্য কেমন সময় অপেক্ষা করছে? ডয়চে ভেলের সঙ্গে এ নিয়েই কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান৷
ডয়চে ভেলে : এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে রাজনীতি না অর্থনীতি, কোনটি বেশি অস্থির মনে হচ্ছে আপনার কাছে?
অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান : আমি যেহেতু রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র, তাই আমি এই দুটোকে কখনোই আলাদা করে দেখি না৷ রাজনীতি অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে, আবার অর্থনীতি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে৷ তার মানে হচ্ছে, এই দুটোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো উপায় নেই৷ যদিও অর্থনীতিবিদরা বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই দুটোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন, কিন্তু আমি সেভাবে দেখি না৷
তাহলে বর্তমান যে সংকট সেটা রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ,না অর্থনৈতিক কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা?
এটাকে আমি বলব, রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক আবার অর্থনৈতিক কারণেও রাজনৈতিক৷ রাজনীতি তো অর্থ ছাড়া চলে না, আবার অর্থের জন্য তো রাজনীতিরও দরকার, যার ফলশ্রুতিতে এই দুটোকে আপনি কখনোই আলাদা করে দেখতে পারেন না৷ যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটকে আপনি অর্থনৈতিক হিসেবেও দেখতে পারেন, আবার রাজনৈতিক সংকট হিসেবেও দেখতে পারেন৷ আমি যেহেতু রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র, তাই এটাকে বলি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংকট৷
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
প্রভাব ফেলার চেয়ে আমার কাছে মনে হয়, এটা এক ধরনের সতর্কবার্তা৷ বিশেষ করে আমি এটাকে উন্নয়ন আগ্রাসন বলি৷ আমাদের যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাসীন থাকে, তাদের সঙ্গে সমাজের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে৷ সেই দূরত্বের জায়গায় একটা বৈধতার সংকট থাকে৷ এই বৈধতার সংকট কাটানোর জন্য তাকে কোনো কিছু প্রদর্শন করতে হয়৷ এই প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে উন্নয়ন আগ্রাসনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়৷ শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও এটা একই রকম সত্য৷ এই যে জিডিপিভিত্তিক উন্নয়নের প্রদর্শনী এবং এটা নিশ্চিত করতে গিয়ে ভয়ানকভাবে ঋণগ্রস্থ হয়ে যাওয়া, এটার সঙ্গে যে অনেক বহির্ঝুঁকি থাকে, এই মুহূর্তে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সেই ঝুঁকিটা দেখছি৷ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ শ্রীলঙ্কায় অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় যে অব্যবস্থাপনা, সেটার একটা বড় প্রভাব আছে৷ পরবর্তীতে কোভিড এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই অবস্থাটা তৈরি হয়েছে৷
জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, লোডশেডিং ইত্যাদি মিলিয়ে যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
আমাদের যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তারাও একই রকম৷ তাদের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রকৃতি এবং মানুষ নেই৷ এই কারণে আমরাও জিডিপি প্রবৃদ্ধিভিত্তিক যে উন্নয়ন, সেই দিকে মনোযোগী৷ আমাদের সম্প্রতি যে বাজেটটা হলো, সেখানেও শ্রীলঙ্কা আমাদের যে বার্তাটা পৌঁছে দিলো, সেটাকে মাথায় রেখেই বাজেটে যে ধরনের প্রস্তুতি থাকার কথা ছিল, সেটা আমরা দেখলাম না৷ বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে এক ধরনের মন্দার মধ্যে প্রবেশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের বাজেট দেখলে মনে হয় অর্থনীতিতে আমরা ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছি৷ সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে, সামগ্রিক দূরদর্শিতার একটা অভাব আছে৷ সামনে বড় ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এটা একটা দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে৷
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আঞ্চলিক জোটগুলো একে অপরকে সহযোগিতা করে৷ আমাদের এখানেও সার্ক ছিল, যেটা প্রায় অকার্যকর৷ সার্কের অধীনে একটা অভিন্ন ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল, যেন কোনো দেশ সংকটে পড়লে সেখান থেকে ঋণ নিতে পারে৷ সেটাও হয়নি৷ এটা না হওয়াকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ক্ষেত্রে চীন এবং ভারত ফ্যাক্টর, যার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা আছে৷ শক্তির ভারসাম্য নিশ্চিত করতে গিয়ে কখনো আমরা চীনমুখী হচ্ছি, আবার কখনো আমরা ভারতমুখী হচ্ছি৷ যার ফলশ্রুতিতে এক ধরনের অনাস্থা সবার মাঝেই আছে৷ এই অনাস্থাই সার্ককে অকার্যকর করে রেখেছে৷ শেষ পর্যন্ত যে অভিন্ন ব্যাংকটি হলো না, সেটা তো অনাস্থারই প্রকাশ৷
বর্তমানে জ্বালানি সংকট কেবল ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?
এই যুদ্ধটা জ্বালানি সংকটের কারণ হতে পারে৷ তবে এটাই একমাত্র কারণ না৷ সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আমরা ২০১০ সালে পাওয়ার সিস্টেমের মাস্টার প্ল্যান করলাম৷ এটা আমরা করলাম কয়লা এবং এলএমজিনির্ভরতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে৷ বারবার এটা রিভাইজ করলাম৷ এই পরিকল্পনাটা কে করলো? জাপানের একটা কোম্পানী৷ জাইকার অর্থায়নে আমরা এই মাস্টার প্ল্যানটা করলাম৷ এই পরিকল্পনাটা করার ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিলাম না, আমরা পুরো জ্বলানিটা আমদানিনির্ভর করে ফেললাম৷ আমরা গ্যাসের নতুন মজুদের সন্ধান না করেই আমদানিনির্ভর করে ফেললাম, যার ফলে আমাদের এই সময়ের সংকটটা হচ্ছে৷ এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করলে বহির্ঝুঁকিটা মাথায় নিয়েই করতে হয়৷ সেটা না করে আমরা একটা কোম্পানি, যারা মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত, তাদের দিয়ে করলাম৷ এখানে কিন্তু স্বার্থের দ্বন্দ্বও আছে৷ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব মালিকানাও নেই৷ এসব কারণে এখন আমরা যে ধরনের সংকটে পড়েছি, সেটা আমরা দূরদৃষ্টির সাহায্যে দেখতে পাইনি৷
এই যে অস্থির পরিস্থিতি, এর প্রভাবে বাংলাদেশের সরকার, না রাষ্ট্রের বেশি ক্ষতি হচ্ছে?
আমাদের সরকার কে? আর রাষ্ট্র কে? সেটা পার্থক্য করাই তো মুশকিল৷ সরকার আর রাষ্ট্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে৷ এক্ষেত্রে সরকার যদি ব্যর্থ হয়, সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখতে হচ্ছে৷ আর রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, সেটা সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখতে হবে৷
বর্তমানে যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, এটা কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন আপনি?
এই বৃদ্ধিটা তো হঠাৎ করেই হয়নি৷ আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরই যে বেড়েছে তা-ও নয়৷ আমরা পেঁয়াজ নিয়ে দেখেছি, আলু নিয়ে দেখেছি৷ সময় সময় আমরা সিন্ডিকেটের কথা শুনি৷ এগুলোর উপর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে ধরনের প্রভাব থাকার কথা ছিল বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে ধরনের জবাবদিহিতা থাকার কথা ছিল, সেটা না থাকার কারণেই কিন্তু মূল্য বৃদ্ধি৷ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নতুন প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে৷ এটাই একমাত্র প্রভাবক না৷ আমাদের এখানে রাজনীতিবিদরা নিজেরাই ব্যবসায়ী আবার ব্যবসায়িরা নিজেরাই রাজনীতিবিদ৷ ফলশ্রুতিতে কে কাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে? এখানে নির্বাচন নিয়ে অনেক রকমের বিতর্ক আছে৷ বৈধতার সংকট আছে৷ সবকিছু মিলিয়ে এখানে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সেটা অব্যবস্থাপনা বটে৷
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ভবিষ্যৎ বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ কতটা বদলাতে পারে?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা দেখেছি ব্রিটেনের উত্থান৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান৷ এই যুদ্ধেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত তো আছেই৷ বিশেষ করে এনার্জিকে ঘিরে রাশিয়ার যে প্রভাব তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি জাতিসংঘে ভোটিং প্যাটার্নটাও দেখি সেখানে কিন্তু রাশিয়া-চীনের মধ্যে যে ঐক্যমত, তাতে মেরুকরণটা খুবই স্পষ্ট৷ এই যুদ্ধটা একটা প্রতিষ্ঠানিক মাত্রা দিয়েছে৷ বিশ্ব-ব্যবস্থা এখন একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থাও কিন্তু সেই অবস্থায় নেই৷
বর্তমানে যে সংকটময় অবস্থা এটা থেকে উত্তরণের পথ কী? বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে?
বাংলাদেশে তো অনেক রকম সংকট আছে৷ এখানে রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা আছে৷ বাংলাদেশকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে ঘিরে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা আছে৷ এই সবকিছু শেষ পর্যন্ত কোনদিকে নিয়ে যায়, তার উপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ৷ এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে যারা আছে, তারা কী ভূমিকা পালন করে, তার উপর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে৷