বুনো হাতির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০কফি চাষি হিসেবে তিরুমালাপ্পার জন্য সকালটা মোটেই ভালো ছিল না৷ হাতির পাল এসে সব তছনছ করে দিয়ে গেছে৷ কফি বিনসের খেতে হাতির তাণ্ডবের চিহ্ন এই প্রথম নয়৷ এবার সৌভাগ্যবশত শুধু ঘরের দরজা নষ্ট হয়েছে৷
গত সাত বছরে হাতির উৎপাতের কারণে তাঁর প্রায় সাত হেক্টর ধানের খেত এবং অনেক কফি বিনস ও পাম গাছের ক্ষতি হয়েছে৷ তিরুমালাপ্পা বলেন, ‘‘এখানে আমাদের জীবনের উপর হাতির অনেক প্রভাব রয়েছে৷ পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে উঠেছে৷ রোজগারের তাগিদে আমাকে কিছু চাষ তো করতেই হবে৷ কিন্তু হাতি প্রায়ই অনেক কিছু নষ্ট করে দেয়৷’’
সর্বশেষ ঘটনাটি অবশ্য অন্যরকম ছিল৷ প্রায় শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে তিনি প্লান্টেশনে বড় বিপর্যয় প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন৷ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিরুমালাপ্পা বলেন, ‘‘আমি খবর পেলাম, যে এই এলাকায় একটা হাতি দেখা গেছে৷ আমার এক মজুর ধানের খেতে ছিল৷ তার কাছে ফোন ছিল না বলে আমি এমন একজনকে জানিয়েছিলাম যে, তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল৷ হাতি খুব কাছে এসে গিয়েছিল৷ ওই মজুর কোনোরকমে পালিয়েছে৷ সাবধান না করলে তার উপর হামলা ঘটতে পারতো৷’’
হাতি ও মানুষের সংঘাত
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের হাসান শহরের আশেপাশের অঞ্চল হাতির সংখ্যার বিচারে তালিকার উপরদিকে রয়েছে৷ বনজঙ্গল, প্লান্টেশন ও ধানের খেতে হাতি বিচরণ করে৷ আগে গোটা অঞ্চল জুড়ে প্রায় শুধু জঙ্গল ছিল৷ গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শুরু থেকে সেখানে মানুষের বসতি বাড়তে থাকে৷ তখনই আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে মানুষের প্রথম সংঘাত শুরু হয়৷ আজ সেই জঙ্গল টুকরো টুকরো অংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে৷ বাড়িঘর ও গোটা গ্রাম হাতির বিচরণক্ষেত্রের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে৷
বন দফতর বার বার হাতির অবস্থান সম্পর্কে স্থানীয় মানুষকে সতর্ক করে দেয় এবং গ্রামবাসীকে সজাগ থাকার আবেদন জানায়৷ মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত এড়াতে বন দফতরের কর্মীরা সব সময়ে সজাগ থাকেন৷
আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ
বিনোদ কৃষ্ণন পাঁচ বছর ধরে হাসান শহরে বাস করছেন৷ তিনি ‘নেচার কনজারভেশন ফাউন্ডেশন’ নামের এক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংগঠনের জন্য কাজ করেন৷ এই সংগঠন আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে স্থানীয় মানুষকে হাতির পাল সম্পর্কে সতর্ক করার চেষ্টা করে৷ কৃষ্ণন হাতি ও মানুষ – দুই পক্ষেরই প্রাণ বাঁচাতে চান৷ তিনি জানালেন, ‘‘এই অঞ্চলে গত দশ বছরে প্রায় ৩৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ জানতেই পারে নি যে সেই অঞ্চলে হাতির পাল বেড়াচ্ছে৷ জানলে দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যু সম্ভবত এড়ানো যেত৷’’
২০১৭ সালে এই সংগঠন হাসান জেলার ২২০টি গ্রাম নিয়ে এক আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা চালু করে৷ স্থানীয় মানুষ মোবাইল ফোনের সাহায্যে বিনামূল্যে সেই প্রণালীতে নিজেদের নথিভুক্ত করতে পারেন৷ যেমন একটি বার্তায় সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হলো, যে হাম্পাপুরা ও কাগনুর গ্রামের কাছে বুনো হাতি দেখা গেছে৷ সবাইকে সজাগ থাকার আবেদন জানানো হলো৷
এই পরিষেবার গ্রাহকরা কন্নড় ভাষায় হাতির অবস্থান সম্পর্কে এমন সতর্কতা বার্তা পান৷ এসএমএস, ভয়েস মেসেজ এবং আটটি ডিজিটাল বোর্ড ও এলইডি হ্যাজার্ড লাইটের মাধ্যমে সতর্কতা বার্তা পাঠানো হয়৷ বিনোদ কৃষ্ণন বলেন, ‘‘আমরা এমন ব্যবস্থা চালু করার পর হাতির কারণে মাত্র একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷ গত বছর এই অঞ্চলে একটিও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে নি৷ হাসান জেলায় বহুকাল এমনটা ঘটে নি৷’’
পারস্পরিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত
সরকারি বন দফতরও এই প্রকৃতি সংরক্ষণ সংগঠনকে সাহায্য করে৷ বন দফতর স্থানীয় মানুষকে হাতির চিহ্ন দেখে হাতির পাল শনাক্ত করার প্রশিক্ষণ দেয়৷ এভাবে স্থানীয় মানুষের জন্য হাতির অবস্থান সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য নিশ্চিত করা যায়৷ এই তথ্য প্রেরণ ব্যবস্থার কল্যাণে মানুষ ও হাতির মধ্যে সম্পর্কও বদলে গেছে৷ প্রকল্পের সমন্বয়ক বিনোদ কৃষ্ণন বলেন, ‘‘আমি যে সবচেয়ে জরুরি পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, তা হলো মানুষ আর হাতির পেছনে ধাওয়া করছে না৷ আগে একটি কফির প্লান্টেশন থেকে অন্য একটিতে হাতির পাল তাড়িয়ে দেওয়া হতো৷ আমরা চাষিদের সঙ্গে অনেক শলাপরামর্শ করে তাঁদের বোঝাতে পেরেছি, যে দিনের বেলা হাতির পালকে বিরক্ত করা ঠিক নয়৷ অবশেষে তাঁরা সেটা মেনে নিয়েছেন৷ ফলে হাতির উপরও চাপ কমে গেছে৷’’
এই সতর্কতা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে সংঘাত কমানো গেছে৷ তবে এটা সামান্য একটা সান্ত্বনামাত্র৷ কারণ আরও জঙ্গল ধ্বংস করে সেখানে বসতি তৈরি হচ্ছে৷ ফলে মানুষ ও হাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনা নাজুক থেকে যাচ্ছে৷
জুহি চৌধুরী/এসবি