বিশ্বের সেরা শিক্ষকের গল্প
২৯ মার্চ ২০১৯প্রত্যন্ত স্কুলটিতে মাত্র একটি কম্পিউটার৷ তাতে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ নেই বললেই চলে৷ ল্যাবরেটরি বলেও তেমন কিছু নেই৷ কিন্তু তাতেও শিক্ষার্থীরা দমে যায়নি৷ গত বছর দেশটির বিজ্ঞান ও প্রকৌশল মেলায় শহরাঞ্চলের বাঘা বাঘা একাডেমিকে পেছনে ফেলে গণিত বিভাগের সেরা পুরস্কার তারা ছিনিয়ে নিয়েছে৷ এমন একটি যন্ত্র তারা উদ্ভাবন করেছে, যা শুধু বৃত্তের পরিমাপ সহজে বের করতেই সক্ষম নয়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আর বধিররাও সেটি ব্যবহার করতে পারে৷ মাত্র ছয় বছর আগে যাত্রা করা স্কুলটি কেনিয়ার ৫৬ তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রকৌশল মেলায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে৷ শিক্ষার্থীদের গণিত দলটি এবার ইন্টেল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল মেলার জন্যেও উত্তীর্ণ হয়েছে৷ আগামী মে মাসে তাদের দুজন প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার সেই আয়োজনে অংশ নেবে৷ এই স্কুলটি যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রিরও অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে৷
গল্পটি কেরিকো মিক্সড ডে সেকেন্ডারি স্কুলের৷ কেনিয়ার নাকুরু কাউন্টির পোয়ানি নামের প্রত্যন্ত এক গ্রামে তার অবস্থান৷ যার নাম এখন শুধু আফ্রিকার দেশটিতেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে৷ আর এই পরিচিতি এনে দিয়েছেন স্কুলটির গণিত ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক পিটার তাবিচি, যিনি দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর সহিংসতা জয় করে শিক্ষার্থীদের উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য লড়াইয়ের পথ দেখাচ্ছেন৷ তৈরি করে দিচ্ছেন সাফল্যের সুযোগ৷
শিক্ষার্থীদের জীবন বদলের গল্প
পিটার তাবিচির এক তৃতীয়াংশ ছাত্রই এতিম কিংবা একক অভিভাবকের পরিবার থেকে আসা৷ তাদের ৯৫ ভাগই দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন যাপন করে৷ অনেককে স্কুলে আসতে হয় সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, বর্ষায় যা ব্যবহারেরই অনুপযোগী হয়ে পড়ে৷
ক্লাসে ঠিকমত বসবার সুযোগ হয় না৷ ৩৫ থেকে ৪০ জনের এক একটি শ্রেণিতে ৭০ থেকে ৮০ জনকে জায়গা দিতে হয়৷ কিন্তু তাতে কি, পিটার তাবিচি সুবিধাবঞ্চিত এই শিক্ষার্থীদের মধ্যেই অদম্য স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন৷ গণিত আর বিজ্ঞানের অবারিত দুনিয়ার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন৷ তাদেরকে তিনি পিছিয়ে রাখতে চান না আধুনিক জ্ঞান আর প্রযুক্তিতেও৷ তাঁর মতে, ‘‘ভাল শিক্ষক হতে হলে আপনাকে সৃজনশীল হতে হবে, সেই সঙ্গে প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করতে হবে৷ আপনাকে অবশ্যই শিক্ষকতার আধুনিক উপায়গুলোকে গ্রহণ করতে হবে৷ কাজ করতে হবে বেশি, কথা বলতে হবে কম৷'' ছাত্রদের জানানোর জন্য বিশ্বের নিত্যনতুন জ্ঞানের সাথে পরিচিত হতে হয় তাঁকে৷ এজন্য স্কুলে ইন্টারনেট না থাকলেও নিয়মিত সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে সেই ক্ষুধা মেটান তিনি৷
শুধু ক্লাসের পড়াশোনাতেই নয় তার বাইরেও শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান চর্চার প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন পিটার৷ তাঁর মতে বিজ্ঞানই তার শিষ্যদের ভবিষ্যৎ দেখানোর পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে৷ এজন্য স্কুলে দুটি ক্লাবও গড়েছেন৷ একটি ট্যালেন্ট নারচারিং ক্লাব, অন্যটি সায়েন্স ক্লাব৷
২০০৭ সালের নির্বাচনের পর কেনিয়ায় জাতিগত সংঘাত তৈরি হয়৷ সেটি পৌঁছে প্রত্যন্ত এই গ্রামেও৷ আদিবাসী বিভিন্ন গোষ্ঠী সেখানে একে অপরের সাথে বিবদমান৷ এই পরিস্থিতি থেকে নিজের ছাত্রদের দূরে রাখতেও উদ্যোগ নিয়েছেন পিটার৷ গড়ে তুলেছেন ‘পিস ক্লাব'৷ ৭টি গোষ্ঠী থেকে আসা তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলাই যার উদ্দেশ্য৷
পিটারের এসব কার্যক্রমে সুফলও মিলছে হাতে নাতে৷ স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে৷ মেয়েরা ছেলেদের চেয়েও ভাল করছে৷ স্কুলে শিক্ষার্থীদের বাজে আচরণের ঘটনা সপ্তাহে ত্রিশটি থেকে মাত্র তিনটিতে নেমে এসেছে৷ আর তাঁর পুরনো শিক্ষার্থীরা স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জায়গা করে নিচ্ছে৷ এর কৃতিত্ব অবশ্য নিজেকে নন, শিষ্যদেরই দিচ্ছেন পিটার৷ বলেন ‘‘আমি আমার ছাত্রদের নিয়ে ভীষণ গর্বিত৷ একজন শিক্ষক হিসেবে আমি সামনে থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি, মেধা, বুদ্ধি আর বিশ্বাস দেখতে পাই৷''
স্কুলের বাইরেও যিনি শিক্ষক
পিটার মাসে যে বেতন পান তার আশিভাগই খরচ করেন শিক্ষার্থী আর স্থানীয় মানুষের কল্যাণে৷ কেননা শুধু ক্লাসে আসলেই তো হবে না, শিশুরা যে পরিবেশে বাস করে তারও তো উন্নয়ন চাই৷
তাঁর মতে, অভিভাবকদেরকে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝানোই অন্যতম চ্যালেঞ্জ৷ এজন্য যেসব শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার সম্ভাবনা থাকে তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন তিনি৷ যেসব মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা থাকে বোঝান সেসব পরিবারকেও৷ সন্তানদের স্কুলে নিয়মিত পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করেন৷
এই গ্রামটির অবস্থান এমন এক জায়গায় যেখানে দুর্ভিক্ষ নিয়মিত ঘটনা৷ তার হাত থেকে বাঁচাতে গ্রামবাসীকে ক্ষরা সহিষ্ণু শস্য উৎপাদনের উপর প্রশিক্ষণও দেন তিনি৷
সেরা শিক্ষক
পিটার তাবিচির এসব গল্প এখন গোটা বিশ্বের মানুষের কাছেই ছড়িয়ে পড়েছে৷ গত কয়েকদিনে বিশ্বের প্রধান সব গণমাধ্যম তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে৷ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিটার যা করেছেন তা অনেক ধনী দেশের জ্ঞানীদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে৷ আর এমন ব্যক্তি যদি বিশ্বের সেরা শিক্ষকের উপাধি পান তাহলে অবাক হবারইবা কী আছে৷
শিক্ষকতা পেশায় অসামান্য অবদান রাখছেন এমন একজনকে ২০১৫ সাল থেকে ‘গ্লোবাল টিচার প্রাইজে' ভূষিত করে আসছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যারিটি ‘ভারকি ফাউন্ডেশন'৷ চলতি বছর এজন্য ১৭৯টি দেশ থেকে ১০ হাজার জনকে মনোনীত করা হয়েছিল৷ সবাইকে পেছনে ফেলে পিটার তাবিচিই নির্বাচিত হয়েছেন সেরা শিক্ষক হিসেবে৷ পেয়েছেন ১০ লাখ ডলার মুল্যের পুরস্কার৷ সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রথমবারের মতো উড়োজাহাজে চেপে তাঁকে যেতে হয়েছে দুবাইতে৷
বাবা, চাচাসহ, সহোদর সবাই শিক্ষক৷ পরিবারের মহান পেশাকেই জীবনের ব্রত করেছে পিটার৷ পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, তাঁর ছাত্রদের অর্জনই তাঁকে এতদূর পৌঁছে দিয়েছে৷ এই পুরস্কার তাদেরকেও একটা সুযোগ করে দিয়েছে৷ সুযোগ করে দিয়েছে এটি বলার যে তারা যে-কোনো কিছু করতে পারে৷ তাঁর স্বপ্ন, ‘‘আফ্রিকার তরুণদের প্রতি আর নিম্ন প্রত্যাশা করা হবে না৷ আফ্রিকা বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, উদ্যোক্তার জন্ম দিবে যাদের নাম একদিন গোটা বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়বে৷ এবং এই গল্পের একটি বড় অংশ জুড়েই থাকবে মেয়েরা৷''