বিরোধী দলের এজেন্টদের মারধর, সহিংসতা গণনার দিনেও
১১ জুলাই ২০২৩মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোট গোনা শুরু হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের ভোট গোনা চলছে ৩৩৯টি কেন্দ্রে। প্রতি গণনা কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী, রাজ্য পুলিশ থাকলেও গণনা শুরুর আগেই অশান্তির খবর আসছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিভিন্ন দলের ৬১ জন আহত হয়েছেন। ৭৬টি তাজা বোমা উদ্ধার হয়েছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা
ডায়মন্ড হারবারে ভোর থেকেই বোমাবাজির অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বিরোধী দলের এজেন্টদের গণনা কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। গণনা কেন্দ্র ফকিরচাঁদ কলেজের কাছে বোমা পড়ে। বিষ্ণুপুরেও কেন্দ্রে বিরোধী দলের এজেন্টদের ঢুকতে না দেয়ার অভিযোগ ওঠে। বাম,কংগ্রেস ও বিজেপি একজোট হয়ে পথ অবরোধ করে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী একে 'ডায়মন্ডহারবার মডেল' বলে টুইট করেছেন।
এই জেলার ভাঙর দুই নম্বর ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় বোমাবাজি হয়েছে। এ দিন সকালে দিল্লি থেকে কলকাতা পৌঁছে সোজা ভাঙরে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস।
উত্তর ২৪ পরগনা
গণনা শুরুর আগে আমডাঙার দুটি পঞ্চায়েত এলাকায় দুই সিপিএম প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। বনগাঁয় গণনা কেন্দ্রের বাইরে তৃণমূল এবং বিরোধীদের মধ্যে বচসা বাধে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে দুই তৃণমূল কর্মীর মাথা ফাটে। গাইঘাটায় জমায়েত ভাঙতে লাঠি উঁচিয়ে তাড়া কেন্দ্রীয় বাহিনীর।
মুর্শিদাবাদ
ব্যতিক্রমী ছবি জেলার হরিহরপাড়ায়। তৃণমূল প্রার্থী ও তাঁর স্বামীকে মারধর করার, গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। গণনা কেন্দ্রে যাওয়ার পথে তাদের আটকানো হয়। ভয়ে কেঁদে ফেলেন তৃণমূল প্রার্থী। ভরতপুরের আমলাই গ্রাম থেকে তাজা বোমা উদ্ধার হয়েছে।
হাওড়া
ডোমজুড়ের গণনা কেন্দ্র থেকে সিপিএম এবং বিজেপির এজেন্টদের মারধরের অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এতে মাথা ফেটেছে বিরোধী সমর্থকের। বাগনান এক নম্বর ব্লকে বিরোধী এজেন্টদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবাদে বাগনান থানা ঘেরাও করা হয়। হয় রাস্তা অবরোধও। পাঁচলায় একই অভিযোগ। প্রতিবাদে ১৬ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিজেপি। সাঁকরাইলে গণনা কেন্দ্রের বাইরে উত্তেজনা তৈরি হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে।
হুগলি
একাধিক জায়গায় আইএসএফ এবং বাম প্রার্থীদের মারধর করে গণনা কেন্দ্র থেকে বার করে দেয়ায় অভিযুক্ত তৃণমূল। জাঙ্গিপাড়ায় সিপিএমের কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ধনেখালির গণনা কেন্দ্রে বিরোধীদের মারধর করে তাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
দুই বর্ধমান
পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া এক নম্বর ব্লকের গণনা কেন্দ্রে আহত হয়েছেন এক সিপিএম সমর্থক। অভিযোগ, সিপিএম এবং বিজেপি এজেন্ট দের গণনা কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে। গলসি এক নম্বর ব্লকে বিরোধী দলের এজেন্টদের মারধর করার অভিযোগ উঠেছে।
পশ্চিম বর্ধমানের বারাবনি গণনা শুরুর আগে বারাবনি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কেন্দ্রের বাইরে তৃণমূল ও বিজেপির তুমুল বিতণ্ডা শুরু হয়। হাতাহাতি হয় দুই পক্ষের। কাঁকসায় তির-ধনুক নিয়ে তৃণমূলের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে।
বীরভূম
নানুরে গণনা কেন্দ্রে সিপিএম ও কংগ্রেস এজেন্টদের ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। কীর্ণাহারে মারধরের অভিযোগ তুলে রাস্তা অবরোধ করে বিরোধীরা।
জেলায় জেলায় অশান্তি
বাঁকুড়ার শালতোড়ায় বিজেপি বিধায়ক চন্দনা বাউড়ির গাড়ি লক্ষ করে পাথর ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বিধায়কের গাড়ি গণনা কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে রাখা ছিল। নদিয়ার তেহট্টে আধাসেনা জওয়ানের লাঠিচার্জে আহত হয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক তাপস সাহা। তিনি কেন্দ্রের বাইরে দলীয় সমর্থকদের সঙ্গে বিজয় উৎসবে সামিল হয়েছিলেন। পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নায় বোমা বিস্ফোরণে একজনের হাত উড়ে গিয়েছে।
কমিশনারের বক্তব্য
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা গণনা শুরুর ঘণ্টা দুয়েক পর দপ্তরে আসেন। সহিংসতার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ''আমাদের কাছে অশান্তির অভিযোগ আসছে। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।''
সহিংসতার নেপথ্যে
নির্বাচন ঘোষণার পর মাসখানেকের বেশি সময়ে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নির্বাচনের দিন মারা গিয়েছেন ১৮ জন। দিনের পর দিন সহিংসতা চলছে। একটানা এই পরিস্থিতি থেকে কেন বেরোতে পারছে না পশ্চিমবঙ্গ? রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''বিরোধী এবং শাসকদলের এই সংঘর্ষের ফলে নির্বাচন কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনের ওপর বিরোধী দল ও জনতা আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তাই তারা নিজেরা হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে।''
রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''এই হিংসা সারা বছরই থাকে। এখন একটা বড় ইভেন্ট হচ্ছে বলে, আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি। সরকার খুব একটা চায় না যে এসব মিটে যাক। অস্ত্র বাংলার রাজনীতিতে একটা স্থায়ী জায়গা নিয়ে নিয়েছে। রাজনীতিবিদরা সেটা অনুমতিও দিচ্ছেন।''
শাসকের জন্য বার্তা?
তুমুল সমালোচনার মুখে পড়া রাজ্য নির্বাচন কমিশনের গতকালের একটি নির্দেশ আজ শাসক দলকে আরো মরিয়া করে তুলেছে বলে মত সিনিয়র সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্যের। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''প্রতি ব্যালটে প্রিসাইডিং অফিসারের সই দেখতে বলেছে কমিশন। এতে শাসক দল প্রমাদ গোনে যে, তাদের সামনে আরো বড় চ্যালেঞ্জ আছে। সে কারণে গণনার দিনও অশান্তি হচ্ছে। এসব ঘটনা যেহেতু মূলত সংখ্যালঘু এলাকায় ঘটছে, সেটা শাসকের ভোটব্যাঙ্কের পক্ষে অশনি সঙ্কেত।''