মমতার প্রাণনাশের চেষ্টা?
৫ ডিসেম্বর ২০১৬কলকাতায় গত সপ্তাহে নোট বাতিলের বিরুদ্ধে মমতার নেতৃত্বে নাগরিক বিক্ষোভে যে জনজোয়ার দেখা গিয়েছিল, তা সম্ভবত কেবলই মমতা অনুরক্ত নাগরিক সমাজের একাংশ এবং অনুগত পার্টি কর্মীদের ভিড় ছিল৷ কারণ নোট বাতিলের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ বিরোধীদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন কিছুতেই দানা বাঁধতে পারছে না৷ যদিও পরিস্থিতি যথেষ্ট অনুকূল ছিল৷ ব্যাংকে, এটিএম-এ এখনও নোটের আকাল, টাকার অভাবে অনেক এটিএম দিনভর বন্ধ, ব্যাংকের বাইরে টাকা তোলার জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন৷ অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে একাধিক৷ সাধারণ মানুষের হেনস্থা হচ্ছে বিস্তর, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে৷ খুচরো ব্যবসা-বাণিজ্য যাও বা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, পাইকারি লেনদেন প্রায় বন্ধের মুখে৷ দোকান, বাজারহাট থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের শপিং মল – সব জায়গায় ক্রেতাদের যাতায়াত, বেচাকেনা লক্ষ্যণীয় রকমের কম৷ কিন্তু তৃণমূল নেত্রী যে গণবিক্ষোভের কথা বলছেন, তার আভাস এখনও পাওয়া যাচ্ছে না৷ দেখা যাচ্ছে না জনবিক্ষোভ৷ বরং লোকে এখনও ধৈর্য ধরছে, অপেক্ষা করছে শান্তভাবে৷ হাঙ্গামার ঘটনা নেহাতই বিক্ষিপ্ত৷
এই পরিস্থিতিতে উঠল মমতা ব্যানার্জির বিমান নামতে না দিয়ে, জ্বালানি কমে আসা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘক্ষণ আকাশে রেখে দিয়ে নেত্রীকে মেরে ফেলার চক্রান্তের অভিযোগ৷ মমতা একটি বেসরকারি সংস্থার বিমানে পাটনা থেকে ফেরছিলেন৷ জানা যায়, পথে কলকাতা বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল একটু বেশি সময় বিমানটিকে আকাশে চক্কর কাটতে বাধ্য করেছিল৷ কিন্তু তার কারণ, কলকাতা বিমানবন্দরে তখন ছ-ছ'টি বিমান রানওয়েতে অপেক্ষা করছিল, উড়ে যাওয়ার সবুজ সংকেতের অপেক্ষায়৷ রানওয়ে খালি না করে মমতার বিমানটিকে অবতরণ করতে দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না৷ তবে বিমানের জ্বালানি যে কমে এসেছিল, এটাও সত্যি৷
নিয়মমাফিক বিমানের পাইলট যেটা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে জানিয়েছিলেন৷ এটা অবশ্য পুরোপুরি কারিগরি বিষয়৷ উড়ন্ত বিমানের জ্বালানি কখনই এতটা কম হয় না যে, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে সেটি আকাশ থেকে পড়ে যাবে৷ বরং সবসময়ই কিছুটা জ্বালানি সংরক্ষিত থাকে, যাতে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সবথেকে কাছের বিমানবন্দরে উড়ে যাওয়া যায়৷ কিন্তু মমতার দল এবং সরকারের বদ্ধমূল ধারণা, জ্বালানিশূন্য বিমানকে মাটিতে আছড়ে ফেলে নেত্রীকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রই করা হয়েছিল৷ এছাড়া এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের অসহযোগিতার পেছনে প্রাক্তন শাসকদলের অনুগত কোনো কর্মীর হাত আছে কিনা, সেই সন্দেহও দানা বেঁধেছে৷ যে কারণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারি মামলা পর্যন্ত করে বসেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার৷
এখানেই শেষ নয়৷ এর পর উঠল সেনাবাহিনী দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ৷ তার কারণ, রাজ্য সরকার এবং পুলিশের আপত্তি অগ্রাহ্য করে, ‘নবান্ন'৷ অর্থাৎ বর্তমান রাজ্য সচিবালয়ের কাছেই জাতীয় সড়কের একটি টোল প্লাজায় বেশ কিছু সেনাকর্মীর উপস্থিতি৷
প্রথমে বলা হলো, রাজ্যকে কিছু না জানিয়ে সেনা মোতায়েন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ বলা হলো, পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় কার্যত ‘সেনা অভ্যুত্থান' ঘটিয়ে দখল নিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেনাবাহিনীর তরফ থেকে পাঠানো চিঠি প্রকাশ করে প্রমাণ দেওয়া হলো, রাজ্য সরকারকে আগাম জানিয়েই এই সেনা সক্রিয়তা৷
এবং এটা প্রতি বছর হয়, সারা দেশে হয়, প্রতিটি রাজ্যে হয়৷ জাতীয় সড়কপথে পণ্যবাহী ট্রাক থামিয়ে তাদের ‘লোড ক্যাপাসিটি' বা ভারবহন ক্ষমতার হিসেব নেওয়া হয় এবং ভারি পণ্য বহনে সক্ষম কতগুলি ট্রাক দিনে একটি নির্দিষ্ট এলাকা দিয়ে যায়, তারও হিসেব রাখা হয়৷ এটা করা হয়, যাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সামরিক রসদ ও সরঞ্জাম বহনের জন্য এই ভারবাহী যানগুলি সেনাবাহিনী কাজে লাগাতে পারে৷ যে সেনাকর্মীরা এই কাজ করেন, তাঁরা সবাই নিরস্ত্র থাকেন৷ কারণ, সামরিক পরিভাষায় এটি ‘পিস টাইম অ্যাক্টিভিটি'৷
তখন দু'টি আপত্তি তোলা হয় মমতা সরকারের পক্ষ থেকে৷ এক, রাজ্য সচিবালয় তথাকথিত ‘হাই সিকিওরিটি জোন'৷ যে কারণে সেখানে এই সেনা উপস্থিতি নিয়ে গোড়াতেই আপত্তি তুলেছিল রাজ্য সরকার এবং পুলিশ৷ কিন্তু সেই আপত্তি সেনাবাহিনী অগ্রাহ্য করেছে৷ আর দ্বিতীয় আপত্তি, অথবা অভিযোগ যথেষ্ট গুরুতর৷ সেনাকর্মীরা নাকি ট্রাক থামিয়ে তোলাবাজি করেছে! চালকদের থেকে টাকা তুলেছে৷ কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাই সিকিওরিটি জোনে দেশের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক ঠিক কোন যুক্তিতে? যদি না মেনে নেওয় হয় যে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সংবিধান, নিয়ম-কানুন, সব অগ্রাহ্য করে সত্যিই একটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে সেনা পাঠিয়ে ফেলে দিতে, রাজ্যের দখল নিতে চাইছে৷ আর পুলিশের, বা সরকারের আপত্তির প্রসঙ্গে বক্তব্য, দেশের সেনাবাহিনী কোথায় যাবে, কী করবে, এটা একেবারেই রাজ্যের বিষয় নয়৷ বরং রাজ্য সরকারেরই কোনো এক্তিয়ার নিয়ে সে নিয়ে প্রশ্ন তোলার৷ আর সেনাকর্মীদের তোলাবাজির প্রশ্ন নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বিভিন্ন মহলে৷ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল নিজে বলেছেন, সেনাবাহিনী সম্পর্কে রাজ্য সরকারের একটু শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে৷ বলা বাহুল্য, তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন মমতা ব্যানার্জি, পাল্টা মন্তব্যও করেছেন৷
কিন্তু আরও একটি প্রশ্ন এই সঙ্গে উঠে এসেছে৷ সাম্প্রতিক এই কাজ কর্মে তৃণমূল নেত্রী তাঁর নিজের, দলের, সরকারের এবং সর্বোপরি এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ভাবমূর্তি বাকি দেশের কাছে কতটা উজ্জ্বল করলেন!
আপনার কী মনে হয়? মমতার কি সত্যিই প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছিল? লিখুন নীচের ঘরে৷