জনসংখ্যাকে কীভাবে জনসম্পদে পরিণত করা যায়?
৩১ জুলাই ২০১৮১৯৭৪ থেকে ২০১১ সালের সময়ের মধ্যে শতাংশের হিসেবে নির্ভরশীল জনসংখ্যার (০-১৪ বছর) হার কমেছে৷ ১৯৭৪ সালে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ, যা ২০১১ সালে হয়েছে ৩৪.৪ শতাংশ৷ এর প্রধান কারণ হলো, দেশে নারীদের মোট উর্বরতা হ্রাসের প্রবণতা৷ অন্যদিকে, ২০১১ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যার (১৫-৫৯ বছর) হার ৫৮.১ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ১৯৭৪ সালে ৪৬.৩ শতাংশ ছিল এবং বয়স্কদের সংখ্যা (বয়স ৬০+) ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সময়ের সাথে সাথে ৭.৫ শতাংশ হয় ২০১১ সালে৷
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উচ্চ প্রজনন দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল৷ ১৯৮০-র দশকে ও তার পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় এবং সেই সাথে সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায়৷ উচ্চ প্রজননশীলতা হ্রাস, মাতৃমৃত্যু হ্রাস, শিশুমৃত্যু হ্রাস, মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি ও গড় আয়ু যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনই অনদিকে কর্মক্ষম বিপুল জনগোষ্ঠী দেশের শ্রম বাজারে যোগ হয়েছে৷ খুশির খবর, কিন্তু এর বিভিন্ন ঝুঁকিও আছে৷
২০১৭ সালের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৩২ লক্ষ যুবক আছে৷ কর্মক্ষম যুব জনগোষ্ঠীকে দেশের মোট নির্বাচনি এলাকা (৩৫০) দিয়ে ভাগ করলে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় গড়ে ৯ লক্ষ্য ৩০ হাজার কর্মক্ষম যুবক কর্ম চায়৷ দেশের কোন কোন খাতে ঐ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো হবে, তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷
প্রশ্ন হলো –
- কীভাবে এই নতুন প্রজন্মকে কাজে লাগান যাবে?
- কে কী কী ধরনের কাজ করবে?
- কার কী কী ধরনের দক্ষতা ও শিক্ষা দরকার?
- কোন কোন খাতে কতজন কাজ করবে বা কোন কোন ক্ষেত্রে কতজন লোক কাজ পাবে তা জানা দরকার?
- বাংলাদেশের পরবর্তী দশকে (২০২৫, ২০৩০, ২০৪০, ২০৫০...) সেবা খাতগুলো কী কী, যেখানে দেশের অধিক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী সেবা প্রদান করবে দক্ষতা অনুসারে৷
প্রথমত যদি চিন্তা করি যে দেশের এই জনগোষ্ঠী কোন কোন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত হতে পারে? কর্ম সুহগের প্রধান দু'টি ক্ষেত্র – একটি হলো, দেশের মধ্যে অন্যটি হলো দেশের বাইরে৷ দেশের মধ্যে চারটি প্রধান ক্ষেত্র যেখানে জনগোষ্ঠী তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম সুযোগ করে নিতে পারে৷ এগুলো হলো –
- সরকারিভাবে
- বেসরকারি খাত (অনেক ধরণের বাক্তি, গ্রপ-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত)
- বাবসা-বাণিজ্য, এবং
- স্ব-উদ্যোগ এবং (নিজে উদ্দগতা হয়ে নিজের কর্মসংস্থান করা ও অন্যের জন্য করমসুজগ তৈরি করা)
সরকারিভাবে কতজন নিয়োগ করা যাবে বা করা হচ্ছে তো জানা৷ এ হিসাব বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষের মতো৷ বেসরকারি পর্যায়ে কর্ম সংস্থান একটি আশাব্যাঞ্জক দিক৷ বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, ব্যাংক, বীমা, শপিং মল গড়ে উঠেছে৷ ফলে যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, পরবর্তীতে আরও হবে৷ তবে বর্তমানে কেবল চার থেকে সাড়ে চার লক্ষ্যের মত বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে৷
অনেকে নিয়োজিত আছেন ব্যবসা-বাণিজ্যে৷ পড়াশোনা শেষ করার পর তারা চাকরি পছন্দ করেন না বা মনের মতো চাকরি পাননি অথবা কোনো চাকরিই মেলেনি৷ এ ধরনের ক্ষেত্রে অনেকে পারিবারিক ব্যাবসায় যোগ দেয়, কেউ বা বন্ধু অথবা পরিচিত প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা শুরু করে৷ কেউ কেউ নিজে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন৷
চতুর্থটি হলো উদ্যোক্তা তৈরি করা৷ বিদেশে ধরে নেওয়া হয় যে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন উদ্যোক্তা হবেন এবং তিনিই বাকি চারজনের কর্মের সুযোগ করে দেবেন৷ বাংলাদেশে উদ্যোক্তা তৈরি ও বিকাশের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হয় না৷ আমাদের দেশে শতভাগ ছাত্রই পড়াশোনা করে চাকরি করার জন্য৷ কিন্তু এত চাকরি কে তৈরি করবে? কোনো বেসরকারি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে পক্ষে এত চাকরির সুযোগ তৈরীই সম্ভব না৷
দেশের জনগণ, পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এই বাস্তবতা জানাতে হবে, বোঝাতে হবে , অর্থাৎ তাদের মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে৷ দেশে এখনও একটা মানসিকতা কাজ করে যে এই কাজ আমার না, ঐ কাজ আমার জন্য না৷ যেমন দেশের জন্য, সমাজের জন্য জনকল্যাণমূলক কাজ করা, স্বেচ্ছাসেবা প্রদান করা, পরিষ্কার-পরিছন্নতায় অংশ নেয়া, রাস্তাঘাট সুন্দর রাখা, নর্দমা পরিষ্কার রাখা, এমনকি ময়লা সঠিক জায়গায় ফেলাকেও আমরা আমাদের কাজ মনে করি না৷ নিজের বাড়ি পরিষ্কার করা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিষ্কার রাখা আমাদের কাজ মনে করি না৷ এগুলোই হলো সমাজের সেবা, দেশের সেবা, জাতির সেবা, নিজের সেবা৷ এগুলোই হলো বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি কাজ আমাদের সমাজে৷
এগুলো করার জন্য যে পাঠ্যক্রম প্রয়োজন, তা হলো মানসিকতার পরিবর্তন৷ ছোটবেলা থেকে, প্রথম শ্রেণি থেকে৷ যদি শুধু দেশের শহর অঞ্চলকে পরিষ্কার করতে পারি, তাহলে দেশে ছোঁয়াচে রোগ-বালাই কমে যাবে৷ কতদিন লাগবে এই কাজ গুলো করতে? কে কে রাজি হবেন? কতদিন লাগবে এ মানসিকতার মানুষ গড়তে? কর্মক্ষম মানুষ, কর্মক্ষম যুবক এ কাজগুলো যদি না করেন তাহলে কে করবেন?
বাংলাদেশ বর্তমানে ৪০ শতাংশ যুবক কোনো ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ গ্রহণ অথবা কর্মের মধ্যে নেই৷ তারা পড়াশুনা যতটুকু করার করেছেন এবং বসে আছেন৷ জীবনের কোনো পরিকল্পনা নেই, প্রচেষ্টা নেই কর্ম সুযোগ তৈরি করার৷ একটাই পরিকল্পনা, একটাই প্রত্যাশা যে কবে চাকরি হবে৷
বাংলাদেশের এ মুহূর্তে প্রধান কাজ হলো যতদূর সম্ভব দক্ষ জনগোষ্ঠী বিশ্বের শ্রমবাজারে রপ্তানি করা৷ যে দেশের জন্য কাজ করতে চাই সে দেশের কর্ম-কৌশল রপ্ত করাতে হবে৷ যদি জার্মানিতে কাজ করতে চাই তবে ঐ দেশের কর্ম-প্রশিক্ষণ গ্রহণ করাতে হবে৷ এভাবে প্রতিটি দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রেরণের কৌশল জানতে হবে, যুবকদের জানাতে হবে এবং বিশ্ববাজারে কোথায় কী কী ধরনের কাজের সুযোগ আছে, তার জন্য কী কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, তার আলোচনা হতে হবে৷
ভবিষ্যৎ শ্রমবাজার, শ্রমের ধরণ, এবং এর জন্য করণীয় কী – তার ওপর স্কুল-কলেজে নিয়মিতভাবে আলোচনা হতে হবে৷ একজন ছাত্র কোন শ্রমবাজেরে যাবে এবং এর জন্য তার কী প্রস্তুতি নিতে হবে তা তার বের করতে হবেএবং যথেষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে৷ রাষ্ট্রকেও এ বিষয়ে যথেষ্ট সহায়ক হতে হবে৷ যেমন ঐ ছাত্রের কাগজ-পত্র সত্যায়ন, আর্থিক জামানত, ভিসা প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি বিষয়ে কোনো হয়রানি ছাড়াই সহযোগিতা করতে হবে৷ একই সঙ্গে যদি সম্ভব হয় তবে দূতাবাসের মাধ্যমে কোন দেশ কী কী ধরনের প্রশিক্ষণ বা কাজের সুযোগ আছে, তা নিরূপণ করে বিষয়টি কর্মপিপাসুদের নিয়মিত জানাতে হবে৷
দেশে যে কাজটি করতে হবে তা হলো আগামীতে দেশের কোন কোন খাতে কত পরিমাণে লোকজন প্রয়োজন, তা নিরুপণ করা৷ দেশের সেবাখাত গুলো কী কী তা চিহ্নিত করতে হবে৷ ২০২৫ সালে, ২০৩০ সালে অথবা ২০৩৫ সালে দেশে কোন ধরনের সেবা খাত তৈরি হবে, কী পরিমাণ জনগোষ্ঠী তাতে নিযুক্ত হতে হবে, কী ধরনের দক্ষতা তাদের অর্জন করতে হবে, তা সুস্পষ্টভাবে সকল সম্ভাব্য যুবককে, তাদের পরিবারকে জানাতে হবে৷ যাতে প্রতিটি বাক্তি, প্রতিটি পরিবার তাদের যোগ্যতা, সামর্থ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারে এবং সে ধরনের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সংক্ষিপ্ত-শিক্ষা অর্জন করে সমাজের সেবাখাতে যোগ দিতে পারে এবং অর্থ উপার্জন করতে পারে, সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে৷
কর্মের এলাকা চিহ্নিত করতে পারলে শিক্ষা বাবস্থা, পাঠ্যক্রম পরিবর্তন হয়ে যাবে৷ মানুয এম.এ. পাশ করতে যাবে না, বরং কর্মমুখী দক্ষতা অর্জন করবে৷ যেমন দেশে যদি শহরাঞ্চল বাড়ে, তাহলে পাকা বাড়ি তৈরি হবে৷ একটা পাকা বাড়ি তৈরি করতে ইট, বালু, বিদ্যুৎ, সিমেন্ট, রং, পানির মিস্ত্রী ইত্যাদির প্রয়োজন৷ এ কাজগুলো কে করবে? বাসায় বাসায় টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল, কুকার, গ্যাস চুলা, ইলেক্টিশিয়ান সহ আরও অনেক ধরনের সেবা প্রয়োজন৷ কে প্রদান করবে এগুলো?
দেশে ৪.৫ কোটি হাউজহোল্ড আছে৷ যদি ৮০ শতাংশ বাসায় টিভি থাকে, তাহলে ৩ কোটি ২০ লক্ষ বাসায় টিভি রয়েছে৷ আর যদি ৫ শতাংশ টিভি মেরামতের প্রয়োজন হয়, তাহলে ১৬ লক্ষ টিভি প্রতিনিয়ত মেরামতের প্রয়োজন৷ একজন বাক্তি যদি দিনে ১৫টি টিভি মেরামত করেন তবে এক লক্ষ টিভি মেরামতের দক্ষ কারিগর প্রয়োজন৷ দেশে এভাবে সম্ভাব্য সেবাখাতে কী কী এবং কতজন লোক প্রয়োজন, তা নির্ধারণ খুবই জুরুরি৷ কবে এম.এ. পাশ করব, কবে চাকরি হবে, তারপর কর্মক্ষম হবো – সে ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে জাতিকে৷
প্রতিটি বাক্তির সমাজে সেবা প্রদানের নির্দিষ্ট পরিমাণ ও যোগ্যতা আছে৷ যোগ্যতা অনুযায়ী সেবা প্রদান করে ব্যক্তি অর্থ উপার্জন করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?
মো. আমিনুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক
তাঁর লেখাটি আপনার কেমন লাগলো? জানান নীচের ঘরে৷