1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিএনপির ‘রেইনবো নেশনের’ রূপরেখা ও প্রতিক্রিয়া

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৯ ডিসেম্বর ২০২২

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ ঘোষণা করেছে সোমবার বিকেলে৷ এই রূপরেখার আলোকে তারা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ গঠন করতে চায়৷

https://p.dw.com/p/4LBBS
তারেক রহমানের ছবি তুলে ধরেছেন বিএনপির এক সমর্থক৷
ঢাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে অনলাইনে যোগ দিয়ে প্রথমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রূপরেখার ২৭ দফা তুলে ধরেন (ফাইল ফটো)ছবি: Imago/ZumaPress

বিএনপি নির্বাচনে জয় লাভের পর একটি জাতীয় সরকার গঠন করে তাদের ঘোষিত এই রূপরেখা বাস্তবায়ন করবে বলে জানিয়েছে৷ সংবিধান সংস্কার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন বাতিল, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থার প্রবর্তন, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা করা, প্রমাসন ও বিচার বিভাগীয় সংস্কারসহ ২৭ দফা রূপরেখার কথা জানিয়েছে বিএনপি৷ দলটি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথাও বলেছে৷ 

বাংলাদেশে রাজনীতি পরিবার ভিত্তিক: নুরুল আমিন বেপারী

এর আগে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়৷

সোমবার ঢাকার একটি হোটেলে মেরামতের রূপরেখা ঘোষণা করে তা একটি অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জয়লাভের পর বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি৷ তাদের জাতীয় সরকার হবে সরকার ‘হটানোর' আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে৷ তারা বলছে, এটা হবে ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার'৷ তবে এই জাতীয় সরকারের মেয়াদ নিয়ে কিছু বলা হয়নি৷ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে করা হবে কী না তাও উল্লেখ করা হয়নি৷

অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে প্রথমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রূপরেখার ২৭ দফা তুলে ধরেন৷ এরপর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তার বিস্তারিত তুলে ধরেন৷ জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং খালেদা জিয়ার ‘ভিশন-২০৩০'-এর আলোকে বিএনপি এই রূপরেখা তৈরি করেছে বলে ড. খন্দকার মোশাররফ জানান৷

২৭ দফা রূপরেখার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো:

১. একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন' গঠন করে বর্তমান অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত সকল অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ রহিত ও সংশোধন করা৷

২. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন' প্রতিষ্ঠা করা৷

৩. ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার' ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে৷

৪. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা৷

৫. পরপর দুই টার্মের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না৷

৬. জাতীয় সংসদে ‘উচ্চ কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা' প্রবর্তন করা হবে৷ সংসদ হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট৷

৭. সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে৷

৮. বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ সংশোধন করা হবে৷

৯. সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে৷ শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এইসব প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হবে৷

১০. বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে৷ বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন' গঠন করা হবে৷

১১. একটি ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন' গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে৷

১২. মিডিয়ার সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি ‘মিডিয়া কমিশন' গঠন করা হবে৷

১৩. দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোন আপস করা হবে না৷ অর্থ-পাচার ও দুর্নীতি অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে৷ সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে৷

১৪. সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে৷ বিশ্বজনীন মানবাধিকার নীতি অনুযায়ী মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা হবে৷

১৫. বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন' গঠন করা হবে৷

১৬. ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার' এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন৷

১৭. মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে৷

১৮. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে৷

১৯. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হবে৷ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না৷ সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক ঢাল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধী দল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব হবে৷

২০. দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে৷

২১. ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে৷

২২. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হবে৷

২৩. যুবসমাজের ভিশন, চিন্তা ও আকাঙ্খাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে৷ এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটাই আগে হবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা দেয়া হবে৷ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিবেচনা করা হবে৷

২৪. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে৷ জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে নারীদের প্রাধান্য দেয়া হবে৷

২৫. চাহিদা-ভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হবে৷

২৬. ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য' এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করা হবে৷

২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে৷

বিএনপির এই রূপরেখা প্রকাশ অনুষ্ঠানে জামায়াত ছাড়া  যুগপৎ আন্দোলনের শরিকেরা উপস্থিত ছিলেন৷ এর সঙ্গে মিল রেখে জোটের দলগুলোও পর্যায়ক্রমে তাদের রূপরেখা প্রকাশ করবেন বলে জানা গেছে৷

মূল টার্গেট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার মনে করে, ‘‘এই রূপরেখার আসল কথা হলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন৷ আর এই ব্যবস্থার জন্য বিএনপির সঙ্গে যারা আন্দোলন করছেন তাদের নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হলে তারা একটি সরকার গঠন করতে চায়৷ এটা জাতীয় বা কোয়ালিশন যে সরকারই বলি না কেন৷ এটা নতুন কিছু না৷ তাদের রূপরেখার মধ্যে তারা তাদের সঙ্গে আন্দোলকারীদের কিছু দাবিও অন্তর্ভুক্ত করেছে৷ যেমন জাসদের দ্বি-কক্ষ সংসদ৷''

‘‘এর বাইরে যে বিষয়গুলো আছে সেগুলোর কথা সব দলই বলে৷ আমরা অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি৷ কিন্তু এর বাস্তবায়ন হলো আসল কথা,'' বলেন ড. শান্তনু মজুমদার৷ তার মতে, ‘‘এগুলো অনেক বিস্তৃত বিষয়৷ এগুলো নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না৷ কারণ পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেটা এখনো বোঝা যাবে না৷ পরিস্থিতি অনুয়ায়ী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান বদলায়৷''

হয়তোবা বিএপির বোধোদয় হয়েছে:

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ‘‘তারা যে রূপরেখা দিয়েছে তাকে আমি সাধুবাদ জানাই৷ তাদের প্রস্তাবগুলো ভালো৷ আমার মনে হয় বিএনপির উপলব্ধি হয়েছে যে এভাবে দেশ চলতে পারে না৷ কিন্তু বাস্তবে কাজের মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে তাদের উপলব্ধি হয়েছে কী না৷''

তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে তাহলে শাসকদের  চরিত্রের পরিবর্তন হবে কী না সেটাই বড় প্রশ্ন৷ ধরুন দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না৷ এটা বাস্তবায়ন কী সম্ভব হবে৷ বাংলদেশে রাজনীতি পরিবার ভিত্তিক৷ এখন যিনি ক্ষমতায় আছেন তিনি তৃতীয় মেয়াদে৷ বিএনপি ক্ষমতায় আসলে কী এটা ছাড়তে চাইবে? তারা কি আইন শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন করবে?'' 

এটা নতুন কিছু না: ড. শান্তনু মজুমদার

তার মতে, ‘‘যারা সংসদ সদস্য হবেন তারা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কালো টাকার মালিক, চোর৷ তারা কি চুরি বন্ধে আইন পাস করবেন৷ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করলে ৩৫০ চোরের সঙ্গে আরো চোর বাড়বে৷ তাই আগে প্রয়োজন আমাদের সমাজ কাঠামো ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন৷ দলের মধ্যে কি সেই পরিবর্তন আসছে? তাহলে রাষ্ট্রে কীভাবে আসবে?''

প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্যমত:

সুশাসনের জন্য নাগরিকের(সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘তারা নির্বাচন ব্যবস্থা, সাংবিধানিক সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এইসব বিষয় নিয়ে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিয়েছে৷ আমরা সুজনের পক্ষ থেকেও একই ধরনের ২১ দফা দিয়েছি৷ দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এগুলো আমরাও প্রয়োজন মনে করি৷ দেশের সম্পদ লুটপাটে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন৷''

তার কথা, ‘‘বর্তমান সরকার নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রায় অকার্যকর করে ফেলেছে৷ কিন্তু সংস্কারসহ যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন৷ নির্বাচনের আগে সেই রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা যেন সেটা বাস্তবায়নে বাধ্য থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে৷''