বাল্যবিবাহের অভিশাপ
১৩ জুন ২০১৫প্রথমে সরকারের দিকে আঙুল তুলে বলতে ইচ্ছা করে যদি দারিদ্র্য আর ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাহীনতাই এর মৌলিক কারণ হয়, তাহলে তার ব্যর্থতার জন্য সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার যোগ্যতা নিয়ে কি প্রশ্ন ওঠে না? স্রেফ বাল্যবিবাহ নিবারণ আইনই যথেষ্ট নয়, তার কঠোরতম বাস্তবায়নের দায়ও সরকার এড়াতে পারে না৷
গ্রামে গঞ্জের গরিব, নিম্নবিত্ত পরিবার, অশিক্ষিত আদিবাসী-উপজাতি পরিবারে কন্যাসন্তানকে জন্ম থেকেই মনে করে বোঝা৷ যত তাড়াতাড়ি ঘাড় থেকে নামানো যায়, ততই মঙ্গল৷ অন্তত একটা মুখের খোরাক তো বাঁচবে৷ তাঁরা ভাবে না, হয়ত জানেও না যে, ১০-১২ বছর বয়সের মেয়েদের শরীর ও মন তৈরি হবার আগেই যদি বিয়ে দেয়া হয়, তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাবালিকা মা জন্ম দেয় হয় মৃত শিশু, না হয় অপরিণত বুদ্ধি আর বিকলাঙ্গ শিশুর৷ শুধু তাই নয়, নাবালিকা মায়ের স্বাস্থ্য কম বয়সেই ভেঙে পড়ে৷ নানারকম স্ত্রী ব্যাধি ও যৌনরোগের শিকার হয় তারা৷ এছাড়া এতে ত্বরান্বিত হয় জাতীয় মানব সম্পদের অবক্ষয়৷ ১৪, ১৫ বা ১৬-১৭ বছরের মেয়েদের বেলাতেও এটাই সত্য৷
এর জন্য অবশ্য সমাজ ও পরিবারও কম দায়ী নয়৷ যেমনটা দেখা যায় মুসলিম সমাজে৷ মুসলিম পার্সোনাল আইনে বিয়ে-শাদি ও তালাক কঠোর শরিয়ত নিয়মের আওতাভুক্ত৷ দেশের অন্য কোনো আইন সেখানে গ্রাহ্য নয়, পরিবারের রায়ই শেষ কথা৷ তাই বলে হিন্দুদের মধ্যে যে নাবালিকা বিবাহ দেয়া হয় না, তা কিন্তু একেবারেই নয়৷ ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে এমন বহু হিন্দু পরিবারেই মেয়ে রজস্বলা হওয়ার আগে বা তার মাসিক হওয়ার আগে বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রচলন রয়েছে৷
মনের মধ্যে আমার মানবিক বোধগুলো অসাড় হয়ে পড়ে, যখন ভাবি যাদের বয়স লেখাপড়া, খেলাধুলা আর আনন্দ-ফুর্তির করার, তখন তাদের জোর করে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে এক অচেনা পরিবেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে ঐ বয়সে তাদের হেঁসেল ঠেলতে হয়, বাড়ির পরিজনদের মন রাখতে সেবাদাসি হয়ে দিন-রাত খাটতে হয়৷ আর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেহে রাতে যখন দু'চোখে ঘুম নেমে আসে, তখন স্বামী ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তার কাম চরিতার্থ করে৷ না বলার জো নেই, কারণ তারা যে গরিব পরিবারের অশিক্ষিত হতভাগ্য নাবালিকা সন্তান৷ অন্যরকম দৈহিক নির্যাতনের কথা তো ছেড়েই দিলাম৷
এমন অনেক ঘটনা আমি জানি, যেখানে নাবালিকা পরিবারের অভিভাবকদের টাকা দিয়ে কচি মেয়েদের বিয়ে দেয়ার নাটক করে নিয়ে যায় দালাল শ্রেণির কিছু লোক৷ অল্পবয়সি মেয়েদের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে প্রথমে নিজেরা ভোগ করে তারপর বেশি দামে বিক্রি করে দেয় এই দালালরা৷ অনেকক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত তাদের গতি হয় গণিকালয়ে৷ হবে না? কচি মেয়েদের বাজার দাম যে অনেক! তাঁরা লেখাপড়া জানে না, প্রতিবাদের ভাষা জানে না, রুখে দাঁড়াবার সাহসও যে পায় না৷
আমি মনে করি, এটা শুধু আমানুষিকতাই নয়, এটা হিংস্রতা, সতীদাহ প্রথার ভিন্নরূপ৷ তাহলে এর প্রতিষেধক কী? সমাধানই বা কী? আমার মনে হয়, গ্রামে-গঞ্জে মেয়েদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো, যাতে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, সচেতনতা বাড়ে আর প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে৷ এই প্রসঙ্গে সুড়ঙ্গের শেষে আলোর বিন্দুর মতো কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই৷ সাম্প্রতিককালে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্ম সম্প্রদায়ের কিছু অল্পবয়সি মেয়ে বিয়ের আসর থেকে উঠে সোজা থানায় গিয়ে নিজেদের পরিবারের বিরুদ্ধে অভিয়োগ দায়ের করেছিল যে, তাদের জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ তারা এখন বিয়ে করতে চায় না, আরো পড়তে চায়৷
বলা বাহুল্য, পুলিশ সেইসব বিয়ে আটকে দেয়৷ সময়ের প্রয়োজন মেয়েদের এই প্রতিবাদী কণ্ঠ, তাদের সাহস৷ আশা করি, এরাই হবে আগামী প্রজন্মের মশালবাহক৷ সরকার অবশ্য সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে৷ এই যেমন বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও অভিযান৷ অথবা সাবালিকা মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সাহায্যদান ইত্যাদি৷