বাণিজ্য ও হুন্ডির আড়ালে টাকা পাচারের যত কৌশল
বৈধভাবে স্থানান্তরের সহজ উপায় না থাকলেও বিদেশে ঠিকই বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছেন অনেক বাংলাদেশি৷ বিপুল টাকা রাখছেন ব্যাংকেও৷ এই অর্থপাচারের কৌশলগুলো কী জেনে নিন ছবিঘরে...
পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো
ধরা যাক শিল্প কারখানার জন্য এক লাখ ডলারের যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র খুললেন দেশের কোনো আমদানিকারক৷ কিন্তু এই পণ্যের প্রকৃত মূল্য ৫০ হাজার ডলার৷ মূল্য বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি এক লাখ ডলার পাঠিয়ে দিলেন বিক্রেতাকে৷ সেই ব্যক্তি তার দামটি রেখে বাকি টাকা আমদানিকারকের বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন৷ এতে দেশ থেকে ৫০ হাজার ডলার পাচার হয়ে গেল৷ টাকা পাচারের এই কৌশলটি পরিচিত ‘ওভার ইনভয়েসিং’ নামে৷
রপ্তানির মূল্য কম দেখানো
ধরা যাক দেশের কোনো রপ্তানিকারক ৫০ হাজার ডলারের পণ্য বা সেবা রপ্তানির ঘোষণা দিলেন, যদিও তার প্রকৃত মূল্য এক লাখ ডলার৷ পণ্য পৌঁছানোর পর ক্রেতা দেশে ৫০ হাজার ডলার রপ্তানিকারককে পাঠালেন, আর অঘোষিত ৫০ হাজার ডলার তার বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন৷ মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে এভাবে রপ্তানিকারক দেশে অর্জিত ৫০ হাজার ডলার পাচার করলেন৷ টাকা পাচারের এই কৌশলটি পরিচিত ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ নামে৷
পণ্যের পরিমাণে হেরফের
শুধু টাকার গড়মিল না, আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যের হিসাবের গড়মিলের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়৷ যেমন, কোনো রপ্তানিকারক ৫০ হাজার পিস পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে এক লাখ পিস রপ্তানি করতে পারেন৷ এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ৫০ হাজার পিসের টাকা তিনি বিদেশে পাচার করলেন৷ উল্টোভাবে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণ অতিরিক্ত দেখিয়ে বেশি দাম পরিশোধের মাধ্যমে টাকা পাচার হতে পারে৷
ভুয়া কাগজপত্র তৈরি
বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচারের আরেকটি উপায় হলো ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা৷ কোনো পণ্য আমদানি না করেই ভুয়া ঋণপত্র এবং শুল্ক ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ভুয়া ছাড়পত্র দেখিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়৷ অনেক সময় একই পণ্যের আমদানির বিপরীতে একাধিক ঋণপত্র খুলে সেই পণ্যের নামে একাধিকবার টাকা পাঠানো হয়৷ সহজে যাতে ধরা না পড়েন তার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন টাকা পাচারকারীরা৷
টাকা পাঠানোর ভিন্ন চ্যানেল বা হুন্ডি
প্রবাসীরা জটিলতা এড়াতে স্বীকৃত পদ্ধতির বদলে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠান, যা হুন্ডি নামে পরিচিত৷ এই পদ্ধতিতে তারা বিদেশে কোনো ব্যক্তির কাছে বা কোনো মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর করেন৷ হুন্ডি পরিচালনাকারী নেটওয়ার্ক সমপরিমাণ টাকা প্রবাসীর পরিবারকে পরিশোধ করে দেয়৷ এতে পরিবার টাকা বুঝে পেলেও প্রবাসীর অর্জিত মূল্যবান অর্থ দেশে পৌঁছে না৷ টাকা পাচার করতে চান- এমন কারো বিদেশি অ্যাকাউন্টে হয়ত তা চলে যায়৷
কর স্বর্গে ছায়া কোম্পানি
পাচার করা অর্থ বিদেশে রাখা ও কর ফাঁকি দেয়ার আরেকটি প্রচলিত উপায় হলো ‘কর স্বর্গ’ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে বেনামে কোম্পানি খোলা৷ এই কোম্পানিগুলোর সাধারণত কাগজ-কলমেই অস্তিত্ব থাকে৷ কয়েক স্তরে এমনভাবে এর মালিকানা আড়াল করা হয় যে প্রকৃত ব্যক্তির নাম জানা কঠিন হয়ে পড়ে৷ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ জমা রাখা, নিজ দেশের বড় অংকের কর ফাঁকি দেয়া ও পাচারকৃত টাকা আড়াল করতে এই ধরনের কোম্পানি ব্যবহারের অভিযোগ আছে৷
বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব
বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি মেলে৷ উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের ধনী ও দুর্নীতিগ্রস্তরা এই সুযোগ লুফে নেন৷ ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপের মাল্টা, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, লুক্সেমবুর্গে বিদেশিদের জন্য এমন স্কিম আছে৷ এই ‘গোল্ডেন ভিসা স্কিম’-এর মাধ্যমে ইইউ দেশগুলো গত দশকে আড়াই হাজার কোটি ডলার আয় করেছে৷ এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী সাইপ্রাস ও স্পেন৷
কর স্বর্গে বাংলাদেশিরা
পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা হংকংয়ের মতো কর স্বর্গে বিভিন্ন সময়ে কোম্পানি খুলেছেন বাংলাদেশিরাও৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম আইসিআইজে-র ফাঁস হওয়া চারটি নথিতে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ১০২ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশে দুদক ২০২১ সালে পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা ৪৩টি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা আদালতে জমা দিয়েছে৷
বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে পাচার
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০২১-২২ অর্থবছরে শতকরা ২০ থেকে ২০০ শতাংশ অতিরিক্ত আমদানি মূল্যের ৮,৫৭১টি অর্থপাচারের ঘটনা শনাক্ত করে৷ এই সংখ্যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬২.৩৩ শতাংশ বেশি৷ ২০২৩ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর৷ ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত৷
বছরে চার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের হিসাবে, বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করে কর ফাঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা প্রায় চার হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা হারাচ্ছে৷ এই অর্থ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ৩১ শতাংশ ও শিক্ষার ছয় শতাংশের বেশি৷ মাথাপিছু হিসাবে দুই ডলার বা ২০০ টাকার উপরে৷ এর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ৩৭ কোটি ডলার ও ব্যক্তি পর্যায়ে ফাঁকির পরিমাণ দুই কোটি ৬০ লাখ ডলার৷
গোল্ডেন ভিসায় বাংলাদেশিরা
বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি নেয়ার পদ্ধতি পরিচিত গোল্ডেন ভিসা স্কিম নামে৷ গত কয়েক বছরে ক্যানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের এই সুযোগ নেয়ার খবর উঠে এসেছে৷ যেমন মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে ন্যূনতম এক লাখ ২৫ হাজার ডলার বিনিয়োগ করতে হয়৷ দেশ থেকে বৈধভাবে এত টাকা স্থানান্তরের সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের নাগরিকেরা এই স্কিম ব্যবহারে উপরের দিকে আছেন৷
পরিসংখ্যানে অর্থ পাচার
কোন দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয় তা বোঝার একটি কৌশল আমদানি-রপ্তানি করা দেশ ও গন্তব্যের পরিসংখ্যান তুলনা করা৷ তার ভিত্তিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি জানাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বছরে সম্ভাব্য ৮২৭ কোটি ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমান ছিল ৮৭ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা আট হাজার কোটি টাকার বেশি৷