1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লোকসংস্কৃতির একাল-সেকাল

রিদওয়ান আক্রাম
২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ গোপাল হালদার হাজার বছরের প্রবহমান বঙ্গ সংস্কৃতিকে ‘পল্লী প্রধান বাঙ্গালি সংস্কৃতি' বলে অভিহিত করেছেন৷ আমার মতে গ্রাম থেকে যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তাকেই এককথায় লোকসংস্কৃতি বলা যেতে পারে৷

https://p.dw.com/p/2psM0
ছবি: M. M. Rahman

সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ গোপাল হালদার হাজার বছরের প্রবহমান বঙ্গ সংস্কৃতিকে ‘পল্লী প্রধান বাঙ্গালি সংস্কৃতি' বলে অভিহিত করেছেন৷ আমার মতে গ্রাম থেকে যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তাকেই এককথায় লোকসংস্কৃতি বলা যেতে পারে৷

সাহিত্য বিষয়ক গবেষক ওয়াকিল আহমদের মতে, বাংলা সংস্কৃতিকে নগরসংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতিকে এবং আদিমসংস্কৃতি – এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়৷ তবে লোকসংস্কৃতিই হচ্ছেই বঙ্গসংস্কৃতির প্রধান ধারা৷ লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী মতে, ‘লোক সমাজের জীবনচরণ ও ভূয়োদর্শনের প্রতিফলন আছে লোক-বিশ্বাস, লোক-সংস্কার আর লোকাচারে৷'

লোকসংস্কৃতি লোকসম্প্রদায়ের গ্রামীণ মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস ও আচার-আচরণ, জীবনযাপন প্রণালী, চিত্তবিনোদনের উপায় প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠছে এই সংস্কৃতি৷ আর একদিনে গড়ে উঠেনি এই সংস্কৃতি৷ দীর্ঘ সময় ধরে একটু একটু করে এই সংস্কৃতির ধারা গড়ে উঠেছে৷ তবে সেই সংস্কৃতি এখন নগর সংস্কৃতি দ্বারা বিপর্যস্ত৷ নগর সংস্কৃতির চাকচিক্যর কাছে ধীরে ধীরে পরাজয় ঘটেছে লোকসংস্কৃতির৷ এই সংস্কৃতির ধারক যেই মানুষগুলো, অর্থাৎ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে নগরসংস্কৃতি গিয়ে হাজির হচ্ছে৷ ফলে তাঁরা সহজেই ধারণ করতে পারছেন নগরসংস্কৃতি৷ এর পেছনে প্রযুক্তির একটা বড় অবদান আছে৷ কীভাবে লোকসংস্কৃতির পরিবর্তনের দিকে হাঁটছে, সেটা একটা তুলনামূলক আলোচনা করার চেষ্টা করব৷

শুরুটা না হয় পোশাক দিয়েই করা যাক৷ যে কোনো সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে পোশাক৷ সেই পোশাকে মোটা দাগে চোখে পড়ে বাঙালি নারীর শাড়ি৷ একটা সময় ছিল যখন বাঙালি নারীদের আটপৌরের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জাড়িয়ে ছিল ‘শাড়ি' নামক পোশাকটি৷ পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে শাড়ির প্রচলন ছিল৷ সম্ভবত সেই তখন থেকে এখনও শাড়ির দৈর্ঘ্যের প্রায় একই রয়েছে৷ তবে গত ১৫-২০ বছর ধরে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ অফিসে থেকে আসা-যাওয়া, দৌড়-ঝাপ করে বাসে উঠা, শাড়িতে অনভ্যস্ততা, পোশাকের বৈচিত্র্যতা আসা, শাড়ির বাইরে অন্যান্য পোশককে বাঙালি নারীকে মেনে নেয়া – এ সব কিছু মিলিয়ে বলা চলে শাড়ি এখন অনেক উৎসবের পোশাক হয়ে যাচ্ছে৷ আজকাল অনেক টিনেজ মেয়ে পাওয়া যাবে, যারা শাড়িকে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের পোশাক বলে মনে করে না৷ শাড়ি থেকে সালাওয়ার কিংবা প্যান্ট-টিশার্টে বেশি অভ্যস্ত তারা৷

এবার আসা যাক পুরুষদের পোশাকের ব্যাপারে৷ ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না৷ এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরিধানে থাকলে হতো ‘ধুতি' আর মেয়েদের পরিধানে থাকলে ‘শাড়ি'৷ সেই ধারা সপ্তম শতকেও বহাল তবিয়তেই ছিল৷ কেননা সেসময়ে হিউয়েন সাং-এর বর্ণনাতে বাংলার যে পোশাকগুলির বিবরণ রয়েছে, সেগুলি সেলাই করা নয়৷ দীর্ঘ গ্রীষ্মকালের গরম থেকে বাঁচার জন্য অধিকাংশ মানুষই শাদা কাপড় পরতেন৷ পুরুষরা একটা লম্বা কাপড় কটি বেষ্টন করে বাহুর নীচে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে শরীর পেঁচিয়ে ডান দিকে ঝুলিয়ে দিতেন৷

উনিশ শতকের শেষের দিকে উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত বাঙালি পুরুষরা ইংরেজদের মতো করে ব্যাপকভাবে প্যান্ট পরা শুরু করলেন৷ নারীদের পোশাক শাড়িতে যে পরিবর্তন আসতে কয়েকশ বছর লেগে গিয়েছিল, সেখানে পুরুষদের পোশাকে পরিবর্তন এসেছিল বেশ দ্রুততার সঙ্গে৷ সম্ভবত তাঁরা পরিবারের মূল কর্মজীবী ব্যক্তি হওয়ায় সেটা হয়েছিল৷ কর্মসূত্রের প্রয়োজনে পশ্চিমা পোশাক গ্রহণ করলেও ঘরোয়া পোশাক হিসেবে তখনও ধুতি কিংবা লুঙ্গিরই জয়জয়কার বজায় ছিল৷ সেটা যে এখনও খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে তা বোধহয় বলা যাবে না৷ তবে লুঙ্গি কিংবা ধুতি এখন আরো বেশি ঘরোয়া হয়ে গেছে৷ কেননা এ সব পরে অনেকেই এখন আর ঘরের বাইরে বের হতে চান না৷ এমনকি বাজারে যেতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না তাঁরা৷ কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের বেলায় এ কথা একেবারেই খাটে না৷ এখনও তারা প্রাত্যহিক কাজে লুঙ্গিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন৷ ধুতির ক্ষেত্রেও সেই একই কথা চলে৷ ধর্মীয় এবং পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়া এটা সেভাবে আর পরা হয় না৷

সঙ্গে ছোট করে পুরুষদের পোশাকের অন্যতম সঙ্গী হয়ে উঠা গামছার কথা না বললেই নয়৷ সেকালের গামছাকে বলা হতো ‘শাঙালি' আর ‘গা-মোছা' শব্দ কালক্রমে ‘গামছা' শব্দে পরিণত হয়েছে৷ নামকরণেই এর ব্যবহার নিহিত আছে৷ মাঠে কাজ করার সময় ঘাম মোছা থেকে গোসলের পর গা মোছার একমাত্র অনুসঙ্গ ছিল এই গামছা৷ ধুতির সঙ্গে এটার একটা সহাবস্থান দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই তখন থেকেই৷ কর্মজীবী, বিশেষ করে চাষীদের কাছে এর জনপ্রিয়তা ছিল অনস্বীকার্য৷ পরে গরমে ঘাম মোছার জন্য রিকশাচালক, ঠেলাওয়ালাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে গামছা৷ গত বেশ কয়েক বছর ধরে গামছা দিয়ে পোশাক তৈরির প্রচলনও শুরু হয়েছে৷ আর অনেকে সেটাকে সাদরে গ্রহণও করেছেন৷

দারিদ্র্যের ভেতরে থাকা বাঙালি নারীদের শাড়ি তালি জোড়া দিতে গিয়েই বোধহয় নকশি কাঁথার জন্ম৷ নকশি কাঁথার বয়স কত? সে বিষয়ে লিখিত কোনো প্রামাণ্য পাওয়া যায় না৷ তবে ৫০০ বছর আগে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত' বইয়ে প্রথম নকশি কাঁথার কথা পাওয়া যায়৷ পুরনো শাড়ি কিংবা লুঙ্গি দিয়ে তৈরি করায় এ সব কাঁথা যেমন আরামদায়ক হতো, তেমনি এ সবের সঙ্গে যুক্ত থাকতো পারিবারিক আবেগ৷ মায়ের পুরনো শাড়িতে তৈরি কাঁথাটা যেন মমতাময়ী মায়ের মতো করেই শীতের সময় ওম দিত৷ তবে নকশি কাঁথাকে শুধু শীত নিবারণের হাতিয়ার বললে চলবে না৷ কেননা এতে পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালি নারীদের শিল্পী মনের৷ এতে ‘মোটিফ' হিসেবে স্থান পেত প্রকৃতি, বাস্তব জীবন এবং লোককাহিনি৷ এ সব সূক্ষ মোটিফের কাজ করতে ধৈর্য্য আর সময়ের প্রয়োজনীয়তা ছিল৷ কিন্তু এ সবের এখন বড়ই অভাব৷ এখন এ সব কাজ জানা মানুষ এবং কদর করা মানুষ – দুইয়ের সংখ্যাই কমছে৷ এখন শীত এলে হয় লেপ না হয় কম্বলের কদর বাড়ে৷ এটার একটা কারণ এগুলো ‘রেডিমেড' পাওয়া যায়৷ কিংবা অর্ডার দিলে অল্প সময়ের মধ্যে পাওয়া যায়৷ বর্তমানে শ্রমঘণ্টা হিসেবে করলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথার অর্থমূল এখন অনেক৷ আড়ং-এর মতো অভিজাত বিপনীবিতান ছাড়া এগুলো পাওয়া এখন বেশ কষ্টকর৷ গ্রামে হয়ত এখনও এ সব মিলে যাবে৷ কিন্তু শহুরে মানুষের কাছে নকশি কাঁথা এখন ‘শো-পিস', যা কিনা ব্যবহার করার চেয়ে ফ্রেম করে দেয়ালে সাজিয়ে রাখাটাই শ্রেয়তর মনে করেন অনেকে৷

লোকসংস্কৃতির আরেক উপাদান অলংকার৷ প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানুষগুলো নিজেদের সাজিয়ে নেয়ার জন্য প্রকৃতির কাছেই দারস্থ হতো৷ সময় সময় সে জায়গায় স্থান করে নিয়েছে নানারকম পুঁতি৷ ইতিহাসও তাই বলে৷ রুচির পরিবর্তন এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে ক্রয়ক্ষমতার সামঞ্জ্যতায় মিলিয়ে অলংকারের আকৃতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে অলংকারে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে৷ অলংকার বলতে শুধু সোনা আর দামি রত্ন দিয়ে তৈরি কোনো গয়না বোঝায় না৷ বাঙালি নারীরা এখন ইমিটেশনের অলংকার থেকে শুরু করে প্লাস্টিক, মাটির অলংকারও ব্যবহার করেন৷ অবশ্য ভারী অলংকার পরার মধ্যে এখন আর ‘স্মার্টনেস' খুঁজে পায় না আধুনিক মহিলারা৷ তাই মাটির অলংকার আধুনিক নারীদের কাছে বেশ সমাদৃত৷ পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, বিজয় দিবসসহ বিশেষ দিনগুলোতে মাটির অলংকারের কদর বাড়ে৷ বিশেষ দিবস বাদেও প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে গেছে এ সব মাটির অলংকার৷ আগে অবশ্য মাটির তৈরি গয়না বেশ ভারী ছিল৷ আর এখন হালকা গয়নার চল বেশি৷

মাটির অলংকারের পর কাপড়ের অলংকারেরও ব্যবহার বাড়ছে৷ সম্পূর্ণ কাপড়ের তৈরি এ সব অলংকারে থাকে বাহারি এমব্রয়ডারি, নকশি কাঁথার ফোঁড়, ক্রস স্টিচ, চেন সেলাই, বোতাম স্টিচ৷ এছাড়া গায়ে হলুদের সাজে ফুলের তৈরি অলংকার এখন একরকম চল হয়ে গেছে বলা চলে৷ শাহবাগ, কাঁটাবন, গুলশানসহ দেশের বেশিরভাগ ফুলের দোকানেই পাওয়া যায় এ সব ফুলের অলংকার৷

গ্রাম বাংলায় আবহমানকাল ধরে নানারকম আনন্দ অনুষ্ঠান ও উৎসবের মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে বাংলার নতুন বছর৷ আর গ্রাম বাংলায় পহেলা বৈশাখ মানেই মেলা৷ এই মেলাগুলো বসে সাধারণত বড় গাছতলায়, গ্রামের একপ্রান্তে, নদীর ধারে৷ এই মেলাগুলো ছিল আমাদের লোকসংস্কৃতির নানা নিদর্শনের এক বিশাল সমাবেশ৷ বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় দ্রব্য আর নানা রকমের খাবার৷ এছাড়া আরও থাকে নানারকমের খেলার আয়োজন৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণি গ্রাম ছেড়ে শহরে হাজির হলেও সেইসব মেলাকে ভুলে যায়নি৷ ফলে সেইসব মানুষের জন্য মেলা হাজির হয়েছে শহরে৷ তবে শহরে এসে মেলার মূল চরিত্রটি হারিয়ে গেছে অনেকটাই৷ সময় যত গড়িয়েছে, এ সব মেলা থেকে লোকসংস্কৃতির উপাদানসমূহ হারিয়ে যেতে শুরু করেছে৷ সেখানে জায়গা করে নিয়েছে আধুনিক সময়ের জিনিসপত্র৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে একসময় মেলায় যেমন মাটির তৈরি টেপা পুতুল স্থান পেত, সেখানে এখন জায়গা করে নিচ্ছে কম দামি প্লাস্টিকের পুতুল৷ ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মেলা বসে৷সেখানে পাওয়া যায় সিলভারের হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র৷ তাই আজ আর সেখানে আপনি শখের হাড়ি, শোলার খেলনা, দারুশিল্প, পিতল শিল্প, শীতলপাটি, দারুশিল্প, গাজীর পট পাবেন না৷ কিছু মেলায় হয়ত এ সব দেখতে পাওয়া যায়, তবে সেসব কালেভদ্রে৷ তবে বাংলা একাডেমি এবং সোনারগাঁয়ের মানুষ ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন নিজেরা যে মেলা আয়োজন করে, তাতে গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতির কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়৷ এটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো হলেও, নতুন প্রজন্মের জন্য এটা বিশাল এক ‘শোকেজ'-এর মতো৷ কেননা রাজধানীতে থেকে এক জায়গায় এক সাথে এতগুলো লোকসংস্কৃতির উপাদান দেখতে পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার৷ এ কথা অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর বাইরে এ চিত্র অপেক্ষাকৃত ভালো৷

বাংলার লোকশিল্পের আরেকটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ দারুশিল্প৷ কাঠের গায়ে খোদাই করা নকশা – এই হলো দারুশিল্প৷ শুধু নিমার্ণ সামগ্রীর অংশ হিসেবেই নয়, একসময় কাঠ ব্যবহার হতো প্রাত্যহিক জীবনের নানা অঙ্গনে৷ ঘুমানোর খাট-পালঙ্ক থেকে শুরু করে টাকা-পয়সা রাখার সিন্দুক, ঘরের আসবাবপত্রসহ থালা-বাটি-চামচ পর্যন্ত৷ এ সব শুধু বানিয়েই ক্ষান্ত হন না দারুশিল্পের শিল্পীরা৷ তাঁরা এ সবের মধ্যে নিজেদের শিল্পী মনের প্রতিফলন ঘটাতে শুরু করেন৷ ফলে দারুশিল্পটা একটা সত্যিকারের শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়৷ তাই বলা যায় যে দারুশিল্পও আমাদের লোকশিল্পের অন্যতম ধারক৷ দারুশিল্পে লোকায়ত নকশার মধ্যে পশুপাখি, দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য, বনফুল, কলমিলতা, লৌকিক দেবদেবী ইত্যাদি প্রাধান্য পায়৷

আজকাল অবশ্য এ ধরনের কাজের মূল্য দেওয়ার লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ এখন কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠান রেডিমেড দরজা থেকে বিভিন্ন আসবাবপত্র বানিয়ে থাকে৷ বিশাল সংখ্যক ক্রেতা ধরার জন্য কম খরচে এরা এ সব বানায়৷ ফলে বাড়তি কোনো নকশা দেখা যায় না এতে৷ তাছাড়া কাঠের অপ্রতুলতার কারণে লোকজন এখন প্লাইবোর্ডের দিকে ঝুঁকছেন৷ স্বল্প মূল্যে এ সব কিনে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা৷ তাই বলে একদমই যে অলংকরণ করা কাঠের জিনিসপত্র পাওয়া যায় না, তা কিন্তু নয়৷ তবে সেগুলোর অধিকাংশতেই মেশিনে করা নকশা আঁকা থাকে৷ দারুশিল্পের ঐতিহ্য অনুযায়ী হাতে কাজ করা আসবাবপত্র কিংবা দরজা কিন্তু সেভাবে আর পাওয়া যায় না৷ একমাত্র খোঁজ করলে মফঃস্বল শহরগুলোতে কদাচিৎ এ সবের দেখা মিললেও মিলতে পারে৷

কথায় আছে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি'৷ আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে মাছ ধরার জন্য ছিল হরেক রকমের ফাঁদ৷ একেক মাছের স্বভাব-চরিত্র আর আকারের উপর ভিত্তি করে তৈরি হতো সেসব ফাঁদ৷ প্রকৃতি খুব কাছে থাকা সেই সময়ের বাঙালি নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে তৈরি করেছিলেন সেগুলো৷ গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালে বন্যার সময় লোকে মাছ ধরার ফাঁদ পেতে রাখত৷ তারপর নিদিষ্ট সময় পর সেসব তুলে আনলেই পাওয়া যেত আটককৃত মাছ৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের ফাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইকবর চাঁই, বেগা, ডুবা ফাঁদ, দারকি, উন্টা, তেপাই, ধীল, চেং, চাঁই, চান্দি বাইর, বানা, পলো, রাবনি, চারো,  ভাসাজাল, ঝাঁকিজাল, ধর্মজাল, ঠেলাজাল, বিটে, খড়াজাল, আন্টা, পলো, গড়া, খুচইন, চরগড়া ইত্যাদি৷ কিন্তু বতর্মানে ফাঁদ পেতে মাছ ধরার দিন ফুরিয়ে আসছে৷ খোলা জলাশয়ের সংখ্যাও আসছে কমে৷ আমাদের মাছের একটা বড় অংশই এখন চাষের৷ তাই এখন আর ফাঁদ পেতে মাছ ধরতে হয় না৷ কেজি দরে মাছ কিনেই এখন সারতে হয় বাঙালির রসনা বিলাস৷

বাংলায় লোককাহিনি, লোকসংগীত, লোকগাঁথা, লোকনাট্য,  ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্যের প্রচলন আছে৷ লোকসাহিত্যের সব ধরনের উপাদান একত্র করলে এ সাহিত্য বিপুল আকার ধারণ করবে, এ কথা নিশ্চিত৷ লোককথা, রূপকথা, ব্রতকথা, কিংবদন্তি ও লোকপুরাণ মিলে লোককাহিনির এক বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে৷ বাংলার রূপকথায় ড্রাগন নেই, আছে রাক্ষস-খোক্কস ও ভূত-প্রেত৷ কিন্তু আজ এ সব বিদেশি কমিক্স, ফেইরি টেল আর সায়েন্স ফিশনের চাপে প্রায় বিলীন৷ আমাদের শিশুদের ক'জন ডালিম কুমার আর তার পঙ্খীরাজ ঘোড়ার কথা জানে? তার চেয়ে বরং তারা সুপারম্যান আর স্পাইডারম্যানের অভিযানের গল্প বলতে পারে একেবারে মুখস্ত৷  

লোকসাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে পুঁথি৷ ৫০-৬০ বছর আগেও বাংলার ঘরে ঘরে পুঁথি পাঠের চল ছিল৷ রাত হলেই ঘরের দাওয়ায় বসে যেতে পুঁথি পাঠের আসর৷ শ্বশুরবাড়িতে আসা জামাইয়ের পুঁথি পাঠ ছিল শ্যালিকাদের অন্যতম প্রধান আনন্দ ও বিনোদন৷ একই সঙ্গে তাতে থাকত জ্ঞানের কথাও৷ থাকত যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রেম ভালোবাসার গল্প৷ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেছেন, ‘পূর্ববঙ্গের মাটির বাসিন্দাদের মনের আনন্দরসে এই সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে৷' কুপিবাতি জ্বালিয়ে যন্ত্রানুঙ্গ ছাড়া খালি গলায় সুর করে এ সব পুঁথি পাঠ করা হতো৷ এ সব বিলুপ্ত হওয়ার জন্য বেশ কিছু কারণের কথা বলেছেন সাহিত্য বিষয়ক গবেষক ওয়াকিল আহমদ৷ তাঁর মতে, ‘‘বাংলার এক শ্রেণির মুসলমান যুগের পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে উনিশ শতক অবধি যে ভাষা ও সাহিত্যকে নিতান্ত মোহবশে অন্তরে লালন করেছেন, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছাড়া আজ আর কোনো মূল্য নেই৷ সৃজনশীলতা, মানবভাবনা ও কাব্যত্ব না থাকার কারণে এ যুগের পাঠক তা পাঠও করেন না৷''

Bangladesch Dhaka Ridwan Akram
রিদওয়ান আক্রাম, সাংবাদিক ও গবেষকছবি: privat

তবে পুঁথি পাঠ যে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়৷ এই ডিজিটাল সময়ে এসেও গ্রামাঞ্চলে খুঁজলে দু-একজন পুঁথি পাঠক পাওয়া যেতে পারে৷ তবে এরাঁ নিজেদের জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ এঁরা বিদায় নিলে পুঁথি পাঠ করবার আর কোনো মানুষই হয়ত পাওয়া যাবে না৷ এঁদের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে বাংলা লোকজ ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ৷

অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত প্রকার লোকসংগীতের প্রচলন আছে৷ জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তন, ঘাটু, ঝুমুর, বোলান, আলকাপ, লেটো, গাজন, বারমাসি, ধামালি, পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা প্রভৃতি গান এখন আর সেভাবে শোনা যায় না৷ এর জন্যও দায়ী প্রযুক্তি৷ প্রযুক্তির নানা সুবিধাই আমাদের লোকসংগীতের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

বাংলা লোকজ খেলাধুলাও তো কম নয়৷ কড়ি খেলা, কানামাছি, লাঠি খেলা, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, ষাঁড়ের লড়াই, বউচি, জব্বারের বলীখেলা, টোপাভাতি, ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্ধা, নুনতা খেলা, নৌকা বাইচ, পুতুল খেলা, ফুল টোকা, বাঘ ছাগল খেলা, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, লাটিম, ষোল গুটি, এক্কাদোক্কা প্রভৃতি৷ এ সব খেলা আজ ক্রিকেট, ফুটবলের পশনেসের কাছে পরাজিত৷ শহুরে শিশু-কিশোরদের তো এগুলো অনেকটা নিরামিষীই মনে হবে৷ এরা এখন বুঁদ হয়ে থাকে কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনে৷

এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান