বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশীয়দের ঝুঁকির কারণ জানা দরকার
৮ মে ২০২০যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (ওএনএস) এতদিনকার তথ্য যাচাই করে বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ সেখানে দেখা গেছে, ইংল্যান্ড ও ওয়েলশে কালো ও দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে কোভিডে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি৷ তারা বলছে, এমনকি সামাজিক কারণগুলো বিবেচনায় নিয়েও দেখা গেছে, ঝুঁকির মাত্রা কমেনি৷ সেই ঝুঁকির মাত্রা কতটুকু? তারা বলছে, প্রায় দ্বিগুণ৷ অর্থাৎ, একজন সাদার চেয়ে একজন বাংলদেশি বা দক্ষিণ এশীয়র মৃত্যুঝুঁকি প্রায় ১.৮ গুণ বেশি৷ ৬৫ বা ততোধিক বয়সি একজন সাদা (ব্রিটিশ, স্কটিশ, আইরিশ, নর্দার্ন আইরিশ, জিপসি) পুরুষের করোনায় মৃত্যুর হার যেখানে ০.২০ ভাগ, সেখানে একজন একই বয়সি ভারতীয় পুরুষের ক্ষেত্রে হার ০.৪৫ এবং বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রে ০.৪৯৷ তবে চীনাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি প্রায় সাদাদের মতোই৷ গবেষণাটি আরো বলছে, যু্ক্তরাষ্ট্রেও একই ধরনের ফল পাওয়া গেছে৷
এ অবস্থায় আসলে এই গবেষণাটি নিয়ে কাজ করা দরকার৷ যুক্তরাজ্যে এরই মধ্যে মৃতের অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে তাঁর বর্ণ পরিচয় লিপিবদ্ধ করার দাবি উঠেছে৷ এর কারণ, প্রত্যেক বর্ণের মানুষের নিজস্ব জেনেটিক গঠন আছে৷ সেই জেনেটিক গঠন অনুযায়ী এই ভাইরাস যদি ভিন্ন আচরণ করলেই বিপদ৷ এর অর্থ হবে, ভাইরাসটির আচরণ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে ঔষধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কারও আরো জটিল ও দীর্ঘসূত্রী হয়ে যাচ্ছে৷
যুক্তরাজ্যে অনেকদিন আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল৷ তখন বারবার বলা হচ্ছিল যে, অন্যান্য সামাজিক ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় এনে তারপর বিশ্লেষণ ক্রা হোক৷ এই গবেষণায় সেটি করা হয়েছে৷ এখানে দারিদ্র্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় আনা হয়েছে৷ আগে এসব ফ্যাক্টর বাদ দিয়ে দেখা গেছে, মোটা দাগে কালোরা ৪.২ গুণ বেশি মারা যাচ্ছেন৷ আর ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় তা এখন সেটি ১.৮-১.৯ গুণ৷
ব্রিটেনে এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আরো গবেষণার ডাক উঠেছে৷ বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায়ও আলাদা করে দেখা দরকার৷ আদৌ মানুষের জৈবিক গঠন অনুযায়ী এই ভাইরাস ভিন্ন আচরণ করছে কিনা৷ যদি যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান যা বলছে, তাতে আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যতা থেকে থাকে, তা আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর৷ তাই বাংলাদেশি বা বংলা ভাষাভাষি গবেষকরাই শুধু নন, দক্ষিণ এশিয়ার গবেষকদের এগিয়ে আসা দরকার৷
তবে এটাও ঠিক, সিঙ্গাপুরেও আমরা দেখেছি, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রেও এমন দেখা গেছে যে, বাংলাদেশি বা দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের অনেকে একসঙ্গে থাকেন৷ তারা একজন সংক্রমিত হলে বাকিদেরও ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং আক্রান্তও হন৷ সিঙ্গাপুরের সেরাঙ্গুন বলে একটি জায়গা আছে৷ সেখানে স্বাভাবিক সময়ে মোস্তফা মার্কেটের পেছনে প্রচুর বাংলদেশির দেখা মেলে৷ বাংলা রেস্তোরাঁও আছে৷ তো, প্রথমদিকে সেখানে বাংলাদেশিদের মাঝে করোনার ব্যাপক সংক্রমণ দেখা গেছে৷ সচেতনতার অভাবও এর একটি কারণ ছিল৷ যুক্তরাষ্ট্রে গত বুধবার পর্যন্ত ২৩৯ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন বলে প্রতিবেদন করেছে দৈনিক প্রথম আলো৷ সংক্রমিত হয়েছেন অনেকে৷ প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বুধবার পর্যন্ত ১৭টি দেশে ৪৬৭ প্রবাসী বাংলাদেশি করোনার সংক্রমণে মারা গেছেন৷ অ্যামেরিকা ছাড়াও ব্রিটেনে ১২২ জন ও সৌদি আরবে ৫৫ জন মারা গেছেন৷ এছাড়া ইটালি, কুয়েত, ক্যানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, স্পেন, কাতার, সুইডেন, মালদ্বীপ, পর্তুগাল, কেনিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও গাম্বিয়ায়ও বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷
তবে ব্রিটেন ও অ্যামেরিকায় আরেকটি ফ্যাক্টর আছে৷ তা হলো, স্বাস্থ্যবিমা ও চিকিৎসার খরচ৷ সেদিন আমার এক জার্মান বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল৷ তিনি লন্ডনে থাকেন৷ বললেন, ইচ্ছে করেই প্রাইভেট ইনস্যুরেন্স করে রেখেছেন৷ পাবলিক ইনস্যুরেন্সে তার আস্থা নেই৷ তার দাবি, পাবলিক ইনস্যুরেন্স যাদের, তাদের খুব একটা যত্ন করে চিকিৎসা করানো হয় না৷ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই৷ অনেক মানুষ এর আওতায় নেই৷ এদের মধ্যে অভিবাসী আছেন অনেক৷ আর বিমা না থাকলে স্বাস্থ্যসেবার খরচ অনেক অনেক বেশি, যা অনেকের পক্ষেই জোগাড় করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে এই সময়ে, যখন আয় কম কিংবা একেবারেই নেই৷
সবমিলিয়ে একটা ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত এসেছে, আমাদের বর্ণের মানুষগুলোর করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি৷ কিন্তু তার বৈজ্ঞানিক সত্যতা এখনো ষোলআনা পাওয়া যায়নি৷ এর মধ্যে কিঞ্চিৎ সত্যতা থাকলেও তা খুঁজে বের করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রতিষেধক আবিষ্কারে মনোযোগী হতে হবে৷