1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘অপুর পাঠশালা’

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাঙালির সন্তান, অথচ বাংলা ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ নেই বললেই চলে৷ পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে এমনই পরিস্থিতি৷ এর সমাধানে ঘাটশিলায় বাঙালিরাই বিভূতিভূষণের স্মৃতি বিজড়িত গৌরীকুঞ্জে চালু করেছেন ‘অপুর পাঠশালা’৷

https://p.dw.com/p/3DmmZ
Indien Ghatsila Jharkhand - Bengali sprechende eröffnen Schule um Bengalisch zu unterrichten
ছবি: DW/P. Samanta

ঝাড়খণ্ডে প্রচুর বাঙালির বাস৷ কয়েক প্রজন্ম ধরে তাঁরা অবিভক্ত বিহার তথা অধুনা ঝাড়খণ্ডে বসবাস করছেন৷ কিন্তু, এই রাজ্যে সরকারি স্তরে বা প্রশাসনিক কাজকর্মে বাংলার কোনো ব্যবহারিক কার্যকারিতা নেই৷ সর্বত্র হিন্দি ভাষারই রাজত্ব৷ স্থানীয় স্কুলগুলিতে হিন্দি, ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও সেখানে নেই বাংলার কোনো স্থান৷ ফলে শিশুপাঠ্যে নেই বাংলা ছড়া, কবিতা বা গদ্য৷ ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে' কিংবা ‘পাখি সব করে রব'-এর অমোঘ ছন্দ বাঙালি শিশুদের অজানা৷ এও কি কম যন্ত্রণার! এরকম অবস্থায় স্থানীয় বাঙালিরা ভাষা নিয়ে বহু আন্দোলন করলেও তার ফল আদতে কিছুই মেলেনি৷ মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস বাংলা ভাষাকে ঝাড়খণ্ডের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে চালু করার কথা বললেও তা বাস্তবায়িত হয়নি৷ 

‘এই চেষ্টা অকুন্ঠভাবে প্রশংসনীয়’

মাতৃভাষা যে কোনো জাতির কাছে অনেক প্রিয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ বাংলা ভাষার সম্মানে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখেছে বাংলাদেশ ও ভারতের আসামের বরাক উপত্যকা৷ ভাষার জন্য বাংলাদেশের সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় বিশ্বজুড়ে৷ সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন ঘাটশিলার বাঙালিরা৷ সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২৫তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে গতবছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কচিকাঁচাদের বাংলা শেখার জন্য শুরু হয়েছে ‘অপুর পাঠশালা'৷ বরেণ্য সাহিত্যিকের  সাহিত্যকর্মে যেমন ঘাটশিলার বিভিন্ন অঞ্চলের কথা বারবার উঠে এসেছে, তেমনই তাঁর ব্যক্তিজীবনেও ছিল এই এলাকার দারুণ প্রভাব৷ ‘চাঁদের পাহাড়', ‘পথের পাঁচালী', ‘আরণ্যক'-এর স্রষ্টা গৌরীকুঞ্জেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন৷ সেই ভিটেতেই শতরঞ্জি পেতে সপ্তাহের একটি দিন, রবিবার চলছে ‘অ-আ-ক-খ' শেখার প্রথা বহির্ভূত অবৈতনিক ‘অপুর পাঠশালা'৷

পাঠশালা খোলার তাগিদ কেন অনুভব করলেন? গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতির সভাপতি তাপস চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এখানে শহরের কিছু এলাকা বাদ দিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলেন৷ বিগত ২০ বছর ধরে বাংলা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ আগে স্কুলগুলিতে বাংলা পঠনপাঠন থাকলেও এখন স্কুলে বাংলা পড়ানো হয় না৷ এখানে বাংলা বইও পাওয়া যায় না৷ অথচ বাংলাই এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা৷ নতুন প্রজন্ম তো বাংলা পড়তে পারে না৷ এমন অবস্থা হয়েছে যে ভবিষ্যতে পঞ্জিকা দেখতে গেলে বাংলা জানা লোক আনতে হবে বাইরে থেকে৷'' 

‘অপুর পাঠশালা’য় পাঠদান

মাতৃভাষার জন্য আন্দোলনে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় বাংলা ভাষা৷ অথচ সেই ভাষার করুণ হাল পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া ভারতের একটি রাজ্যে৷ কেন বাংলার প্রতি এই বিমাতৃসুলভ আচরণ? বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঝাড়খণ্ডে প্রায় ৪৩ শতাংশ মানুষ মাতৃভাষা হিসেবে বাংলায় কথা বলেন৷ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ঝাড়খণ্ড সরকারও স্বীকার করে নিয়েছেন যে বাংলাও সরকারি ভাষা৷ কিন্তু, স্বীকার করে নিলেও সরকার এখানে উদাসীন৷ এটা হয়তো চালাকি বা প্রতারণা৷ তাই স্কুল স্তরে বাংলা পঠনপাঠনের ব্যবস্থা নেই৷''

এমন পরিস্থিতিতে বাংলা শেখানোর জন্য গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি অপুর পাঠশালার আয়োজন করেছে৷ গৌরীকুঞ্জের কেয়ারটেকার তথা উন্নয়ন সমিতির সদস্য প্রদীপ ভদ্র বলেন, ‘‘বিভূতিভূষণের বাড়ি ঘিরে ঘাটশিলার পাঁচটা বাংলাভাষী ক্লাবকে নিয়ে এই উন্নয়ন সমিতি তৈরি হয়েছিল৷ তখন থেকেই গৌরীকুঞ্জের দেখভালের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কাজকর্ম করার ভাবনাচিন্তা ছিল৷ বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য আন্দোলনও হয়েছে৷ বিভূতিভূষণের পুত্রবধূ মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতিতেও আমরা অপুর পাঠশালা নিয়ে এগিয়েছি৷''

প্রতি রবিবার গৌরীকুঞ্জে অপুর পাঠশালায় হাজির হয় পড়ুয়াদের দল৷ নীচু থেকে উঁচু শ্রেণির পড়ুয়ারা সকলেই নিয়ম মেনে আসে৷ সেপ্টেম্বর মাসে পড়ুয়া সংখ্যা ছিল ৩৫৷ এখন অপুর পাঠশালায় পড়ুয়াদের সংখ্যা ১০০৷ বোঝা যাচ্ছে পড়ুয়াদের সংখ্যা বাড়ছে৷ এদের মধ্যে সবাই যে শুধু বাঙালি, তা কিন্তু নয়৷ তাপস বলেন, ‘‘উড়িয়া, হিন্দিভাষী, আদিবাসী সব শিশুদেরই ভাষা শেখার প্রবল আগ্রহ৷ আসলে ভাষা সকলেই শিখতে চায়৷ ঘাটশিলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধানসহ আরো অনেক অধ্যাপক, শিক্ষক এখানে এসে পড়ান৷'' সবমিলিয়ে জনা দশেক শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে গৌরীকুঞ্জ চত্বরে তারাদাস মঞ্চে পাঠশালা বসে৷ 

‘আমাদের বাংলা শেখানোর কোনো কোর্স নেই’

ডয়চে ভেলের কথা শুনে এই মঞ্চে জড়ো হয়ে গিয়েছিল একঝাঁক ছেলেমেয়ে৷ বইপত্র নিয়ে ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে একে একে কংক্রিটের চাতালে ওসে বসে ওরা৷ ব্ল্যাকবোর্ডে শিক্ষক লেখেন অ-আ-ক-খ৷ ওরা শিক্ষকের সঙ্গে সমস্বরে গলা মিলিয়ে পড়তে থাকে দুঃখিনী বর্ণমালা৷ এই কচিকাঁচাদের কেমন লাগে বাংলা পড়তে? সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শুভম মণ্ডল বলে, ‘‘প্রতি রবিবার এখানে আসি বাংলা শেখার জন্য৷ আমি যে স্কুলে পড়ি, সেখানে বাংলা পড়ানো হয় না৷ এখানে অ-আ-ক-খ শিখছি৷ ভালোই লাগছে বাংলা শিখতে৷'' 

শুভমের মতো বিশাল কুমার, কবিতা প্রধানরা হাজির হয় বাংলার টানে৷ অবাঙালিরা পরিবারের সন্তান বাংলা শিখছে, যেহেতু এই এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীর বাস৷ পড়ুয়ারা আপাতত ‘বর্ণপরিচয়'-এর পাঠ নিচ্ছে৷ লিখতেও পারছে অক্ষরগুলি৷ এর পর কী পরিকল্পনা? তাপস চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের বাংলা শেখানোর কোনো কোর্স নেই৷ বাচ্চারা মনের আনন্দে যাতে ভাষা শিখতে পারে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য৷ কোনো জোর-জবরদস্তি নেই৷ নেই কোনো পরীক্ষা পদ্ধতি৷ তাই ভয়ে নয়, আনন্দে ওরা পড়াশোনা করছে৷ বর্ণপরিচয় দিয়ে শুরু করেছি৷ তবে মুখে মুখে বাংলা কবিতা, গল্প বলা হয়৷ বাংলার মহাপুরুষদের জীবনীও শোনানো হয়৷'' 

‘প্রতি রবিবার এখানে আসি বাংলা শেখার জন্য'

এই উদ্যোগে হাসি ফুটেছে বাঙালি অভিভাবকদের মুখেও৷ এখানকার বাসিন্দা সুখেন্দু মণ্ডল বলেন, ‘‘আমাদের এলাকার জগদীশ চন্দ্র স্কুলটি বাঙালিদের জন্য৷ এখানে আগে বাংলায় সবকিছু পড়ানো হলেও এখন শুধু বাংলা ভাষা হিসেবে একটা বিষয়ই পড়ানো হয়৷ তাই বাংলা ভাষাকে জানার সুযোগ যতটুকু ছিল, সেটাও আর ততটা নেই৷ তাই অপুর পাঠশালা আমাদের একটা পরম নির্ভরতা৷''

অমর একুশে উদযাপনের ক্ষণে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘এই চেষ্টা অকুন্ঠভাবে প্রশংসনীয়৷ ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরের বঙ্গভাষী সমিতি অনেক কাজ করছেন দেখেছি৷ তাঁরা বাড়িতে বাড়িতে বর্ণপরিচয় দিচ্ছেন৷ একইভাবে গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতির কাজ সারা ঝাড়খণ্ডে ছড়িয়ে যাক, এই কামনা করি৷ অক্ষর পরিচয়ের পাশাপাশি গান, কবিতা, নাটকের উপাদান মিলিয়ে শিক্ষাটা দিলে সেটা আরও ব্যাপক হয়ে উঠতে পারবে৷''