বাংলা নিয়ে বাংলা ভাগ!
৩০ জুলাই ২০১৮পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলা৷ রাজ্যের নাম বদলের এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়৷ বিজেপিকে বাদ দিলে, হাতেগোনা যে কয়টি ইস্যুতে সরকারপক্ষ এবং বিরোধীরা এক জায়গায় হয়েছে, এই নাম বদলের প্রস্তাব তার মধ্যে একটি৷ বিজেপি কেন বিরোধিতা করছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক কেন বামপন্থিরা প্রস্তাবটি সমর্থন করল? তার কারণ, মূল প্রস্তাবটি আদতে বামেদেরই ছিল৷ ১৯৯৯ সালে বামফ্রন্ট যখন রাজ্যের ক্ষমতায় এবং জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী, তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা করার এই প্রস্তাব প্রথম বিধানসভায় আনা হয়৷ কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, যে কোনো সর্বভারতীয় প্রশাসনিক বৈঠকে যেহেতু বর্ণানুক্রমিকভাবে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পাওয়া যায়, ওয়েস্ট বেঙ্গল, অর্থাৎ ‘ডাব্লিউ'-এর পালা আসে অনেক দেরিতে৷ কার্যত সভার প্রায় শেষে৷ ফলে নিজেদের কথা জানানোর সুযোগও কম পাওয়া যায়, যেহেতু সবার বক্তব্যের শেষে সামান্য সময়ই বেঁচে থাকে৷
এবারও একই যুক্তিতে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার প্রস্তাবটি বিধানসভায় আনে এবং নীতিগতভাবেই সমর্থন জানাতে বাধ্য হয় বামেরা৷ যদিও সব বাম নেতাই এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এটা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যে আদত প্রস্তাবটি বামফ্রন্টেরই ছিল, তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস সেসময় যার বিরোধিতা করেছিল৷ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে কিন্তু আরও একটি কারণ আছে রাজ্যের নাম বদল করার৷ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আগ্রাসী হিন্দুত্বের নীতির বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জি বাঙালি এবং বাঙালিত্বকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করাতে চান৷ হিন্দি বলয়ের যে সংস্কৃতি বিজেপি বাংলাতেও চালু করতে চায়, রামনবমী পালন, বিজয়া দশমীর দিন সশস্ত্র মিছিল, গনেশ পূজার মাধ্যমে, তার বিরুদ্ধে বাংলা এবং বাঙালির উদারনীতিকে অস্ত্র করতে চান, যে চিন্তায় বাংলার একজন বাসিন্দা হিন্দু হোক, বা মুসলিম, সে আগে একজন বাঙালি৷ কাজেই নাম বদলের উদ্যোগে বিজেপির বিরোধিতার কারণও সহজে বোঝা যায়৷
রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এই নাম বদলকে সোৎসাহে সমর্থন করছেন৷ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ নামটা বাতিল করার মাধ্যমে কি ইতিহাসকে, বাঙালির ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা হলো না? তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘স্বীকার করা হলো৷ অস্বীকার করা হবে কেন! এ তো বাংলাই ছিল বরাবর৷ পূর্ববঙ্গ যখন ভাগ হয়ে গেল, দেশ যখন ভাগ হলো, তখন ওই ভাগটার নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান৷ আমাদের বাংলা নামটা চেঞ্জ করার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না! একটা নাম দেওয়া হলো, পশ্চিমবঙ্গ৷ কোনো মানে হয় না৷ পশ্চিমবঙ্গ নামটাই তো একটা অর্থহীন নাম, তাই না? বাংলা উঠিয়ে দেওয়া হলো, পশ্চিমবঙ্গ করা হলো৷ অকারণ করা হয়েছিল৷ কারণ এটা বরাবর বাংলা ছিল, আমরা বাংলায় জন্মেছি, বাংলাতেই বড় হয়েছি, হঠাৎ একদিন রাতারাতি নাম হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ৷ অথচ ওই দেশটার নাম তো বাংলা ছিল না, ছিল পূর্ব পাকিস্তান৷ বাংলার নামগন্ধও নেই৷ তা হলে আমাদের নামটা চেঞ্জ হলো কেন? কাজেই ঐতিহ্য তো বাংলার৷ পশ্চিমবঙ্গের তো কোনো ঐতিহ্য ছিল না৷ ১৯৪৭ সালে তৈরি হলো এ নাম, এবং এ নাম আমরা মোটেই পছন্দ করিনি কখনও৷ বাংলা নাম অত্যন্ত ভালো নাম, এর সঙ্গেই আমাদের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে৷''
কিন্তু বিরুদ্ধমতও অবশ্যই আছে৷ সবথেকে জোরাল মতটি হলো, প্রতিবেশী দেশটির নাম যেখানে বাংলাদেশ, সেখানে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের নাম বাংলা হলে বিভ্রান্তি তৈরি হবে৷ এই জনমতেরই প্রতিফলন ঘটল শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের কথায়৷ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রাজ্যের নাম যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা হলো, তাতে কি একটা ঐতিহাসিক সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া হলো?
জবাবে তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘আমার যেটা মনে হয়, এটা হচ্ছে একটা দিক৷ ঐতিহাসিক সত্য, যে দেশটা ভাগ হয়েছিল৷ সেই দেশভাগের স্মৃতি পশ্চিমবঙ্গ নামের মধ্যে ছিল৷ এই যুক্তিটা আমার কাছে একটু আবেগপ্রবণ মনে হয় এই কারণে, যে অনেক জায়গার নাম আমরা বদলেছি৷ সারা ভারতেই, ম্যাড্রাস হয়েছে চেন্নাই, বম্বে হয়েছে মুম্বই৷ এই নামগুলো আমরা বদলে দিয়েছি৷ সেখানে আমরা এই যুক্তিটা কেউ দিইনি, যে ইতিহাসের কারণে বদলানো যায় না৷ আমার কাছে যেটা বেশি আপত্তিজনক, প্রশ্নসঙ্কুল, সেটা হলো, বাংলাদেশের নামের সঙ্গে আমাদের নামের একটা বিভ্রান্তি হতে পারে৷ খবরের কাগজে রোমান হরফে যখনই ‘বাংলা' লেখা হয়, সেটা বাংলাদেশকে বোঝায়৷ সেখানে পশ্চিমবঙ্গও বাংলা হয়ে গেল, সেখানে আমার মনে হয় বিভ্রান্তি তৈরি হবে৷ এটা খুব কাঙ্খিত ব্যাপার নয়৷ বরং অন্যরকম নাম হলেই হতো৷ বঙ্গ প্রদেশ, বা বঙ্গ রাজ্য, বা বঙ্গভূমি, এই ধরনের নাম হলেই হতো৷''