‘বাংলা একাডেমির বাইরেই অনুবাদের বই বেশি বের হয়'
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯এসব নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলা একাডেমির অনুবাদ উপ-বিভাগের অনুবাদ কর্মকর্তা মোজাফ্ফর হোসেন৷
ডয়চে ভেলে: বাংলা একাডেমি অনুবাদের বিষয়ে কতটা উদ্যোগী? শুরুতে কেমন ছিল আর এখন উদ্যোগটা কোন পর্যায়ে আছে?
মোজাফ্ফর হোসেন: একাডেমির প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই যে দুটি বিভাগ সৃষ্টি হয়েছিল তার একটি ছিল অনুবাদ৷ ১৯৫৭ সালের ১৮ই মে বিভাগসমূহ নতুন করে সাজানো হয়৷ এবং ছয়টি বিভাগ করা হয়৷ সেখানেও স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে অনুবাদ বিভাগ ছিল৷ ফলে আমরা অনুমান করতে পারি, বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা কাল থেকে অনুবাদ খুব গুরুত্ব পেয়েছে৷ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৫৫ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব বাংলার সরকার বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷ সেখানেও অনুবাদ গুরুত্ব পেয়েছে৷ কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা যেটা দেখি, স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে অনুবাদ বিভাগ আর থাকেনি৷ ১৯৮২ সালে একাডেমির বিভাগসমূহ নতুনভাবে সাজানো হয়৷ সেখানে অনুবাদ বিভাগ উপ-বিভাগে পরিণত হয়৷ এবং এখন পর্যন্ত অনুবাদ উপ-বিভাগ হিসেবেই আছে৷ সে অর্থে অনুবাদের গুরুত্ব কিছুটা কম পাচ্ছে বলে মনে হতে পারে এবং এই মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ তবে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই উপবিভাগের সঙ্গে আছি৷ সে হিসেবে বলতে পারি, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান অনুবাদকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বর্তমান মহাপরিচালক যিনি এসেছেন, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, তিনিও ঘোষণা দিয়েছেন অনুবাদকে তিনি গুরুত্ব দিতে চান৷ তারপরও একটা কথা থেকে যায়৷ আমি বলব যে, অনুবাদটা যদি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ হয়, সে-ক্ষেত্রে এর কাজের পরিধি আরো বাড়বে৷ এমনও হতে পারে যে, অনুবাদ ইনস্টিটিউট করা যেতে পারে৷ সেটা স্বতন্ত্রভাবে হতে পারে বা বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানেও হতে পারে৷ সেটা হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আরো ভালো হবে৷
বাংলা একাডেমির উদ্যোগে এ পর্যন্ত কতগুলো বই অনুবাদ হয়েছে এবং কী ধরনের বইয়ের অনুবাদ বেশি হয়?
১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম বাংলা বইটা একাডেমি থেকে অনুবাদ হয়৷ সেই বইটা ছিল মনিরউদ্দীন ইউসুফের আল্লামা ইকবালের কাব্যসংগ্রহ৷ এরপর যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে দেখবো যে, শেক্সপিয়ারের বই, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা, আল-বেরুনীর ভারততত্ত্বসহ অনেক বই অনুবাদ হয়েছে৷ মালয়েশিয়ার একটি উপন্যাস অনুবাদ হয়েছে, জাপানি লেখকের বই, অষ্ট্রীয় লেখকের বইও অনুবাদ হয়েছে৷ অনুবাদের শুরুর দিকে অনেক ব্যাপক আকারে বই অনুবাদ হয়েছে৷ মেডিকেল সায়েন্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের অনুবাদ হয়েছে৷ যেটা বলছি, সেটা সত্তর এবং আশির দশকের চিত্র৷ নব্বইয়ের পর যদি আমরা দেখি, এই জায়গাটা কমে গেছে৷ সে-ক্ষেত্রে আগে বিভিন্ন বিভাগ থেকে অনুবাদের বই বের হতো৷ পরবর্তীতে সাহিত্যের জায়গাটা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে৷ ইতিহাসের কিছু বই অনুবাদ হয়েছে৷ এখন বছরে ৩-৪টি করে বই অনুবাদ হচ্ছে৷ তবে গত ২১ বছরে একাডেমি থেকে যে বই অনুবাদ হয়েছে, তাতে সাহিত্যই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে৷
এখন কোন ধরনের বই বেশি অনুবাদ হচ্ছে?
বাংলা একাডেমি থেকে অতি সম্প্রতি যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখবো যে, কারাগারের রোজনামচা বইটির অনুবাদ হয়েছে৷ অধ্যাপক ফখরুল আলম এটা করেছেন৷ আর বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু' অনুবাদ হয়েছে৷ ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি' নীলিমা ইব্রাহিমের এই বইটি অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক ফায়েজ হাসনাত৷ সৈয়দ শামসুল হকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি' অনুবাদ হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিশরের একজন সাংবাদিক একটি বই লিখেছেন৷ সেই বইটি অনুবাদ হয়েছে৷ বাংলা একাডেমি থেকে অনুবাদ করেছেন একাডেমি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম৷ বইমেলার শুরুর দিন এই বইটির মোড়ক উন্মোচন হবে৷
দেশি বই আর বিদেশি বইয়ের অনুবাদের হার কেমন?
বাংলাদেশে ইংরেজি থেকে ট্র্যান্সলেশন বা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হওয়ার হার খুব একটা ভালো নয়৷ অতি সম্প্রতি আমরা দেখছি যে, এই হারটা খুব কাছাকাছি এসেছে, কারণ, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক উদ্যোগ নিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের ক্লাসিক বইগুলো যেন ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়৷ তারই ধারাবাহিকতায় কমিশন করা হয়েছিল৷ এর প্রেক্ষিতে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি', ‘সূর্য দীঘল বাড়ি' অনুবাদ করা হয়৷ এখন মোটামুটি চেষ্টা চলছে যে, ফিফটি ফিফটি রাখতে বা বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে আরো একটু গুরুত্ব বেশি দিতে৷
যেসব বই অনুবাদ হচ্ছে সেগুলোর মান কেমন?
যখন বিদেশি কোনো বই বাংলায় অনূদিত হচ্ছে, তখন বাংলা একাডেমির একটা প্রক্রিয়া আছে৷ সেখানে দু'জন রিভিউয়ার থাকেন বিশেষজ্ঞ পরীক্ষক৷ কে বইটির অনুবাদ করেছেন, সেটি তাঁদের জানানো হয় না৷ তাঁরা অনুবাদকের নাম না জেনেই তাঁদের মতামত দেন৷ তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে বই প্রকাশিত হয়৷ এখন মনে হচ্ছে, মোটামুটি ঠিকঠাক অনুবাদ এখানে হচ্ছে এবং পজিটিভলি হচ্ছে৷ বাংলা থেকে যখন ইংরেজি হচ্ছে, তখন কিছুটা সংকট থাকতে পারে৷ কিন্তু বাংলায় যখন অনুবাদ হচ্ছে, তখন বাংলা একাডেমি মোটামুটিভাবে মান নিশ্চিত করার পরেই সেটা প্রকাশিত হয়৷
ভালো অনুবাদক কি দেশে আছে?
আমি এ ব্যাপারে আশাবাদী৷ ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অনুবাদকের সংখ্যাটা ওইভাবে কমে গেছে৷ একটা সময় আমরা দেখেছি সরাসরি রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ হচ্ছে, জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ হচ্ছে৷ কিন্তু এখন বহুভাষিক যেটা বলি যে, বহু ভাষা জানেন সে ধরনের মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে৷ যদিও দুই-একজন আছেন, যাঁরা ল্যাটিন ভাষা থেকে অনুবাদ করতে পারেন৷ ইংলিশ ভাষা থেকে তো হরহামেশাই অনুবাদ হচ্ছে৷ এই সংখ্যাটা পর্যাপ্ত নয়৷ এই অর্থে বলছি যে, একজন অনুবাদের একটি বই প্রস্তুত করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে৷ অনুবাদকের যদি সংখ্যা বলেন, সেটি ভালো-খারাপ সব মিলিয়ে একেবারে কম নয়৷ বইমেলায় অনুবাদের বই প্রায়ই দেখা যায়৷ এটা সংখ্যায় হাজারের মতো তো হবেই৷
বাংলা একাডেমির বাইরে ব্যক্তি উদ্যোগে অনুবাদ হচ্ছে কেমন?
বাংলা একাডেমির বাইরে সবচেয়ে বেশি অনুবাদের বই বের হয়৷ আমি যেটা কিছুক্ষণ আগে বলছিলাম যে, বাংলা একাডেমি থেকে মাত্র ৩-৪টি বই বছরে বের হচ্ছে৷ কিন্তু এর বাইরে কিছু প্রকাশক নির্দিষ্ট করে আছেন, যাঁরা অনুবাদের বই প্রকাশ করেন৷
এই ধরনের প্রকাশকদের সংখ্যা কেমন?
যাঁরা এটাতে ভূমিকা রাখছেন, বলতে গেলে ৮-১০ জন প্রকাশক আছেন, যাঁরা অনুবাদকে খুব বেশি গুরুত্ব দেন৷ আর আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি যে, প্রত্যেক প্রকাশকই বা প্রকাশনা সংস্থা প্রতি বছরই কোনো-না-কোনো অনুবাদের বই আনেন৷ হয় সেটা নতুন করে অনুবাদ করা অথবা পুনর্মুদ্রণ হতে পারে৷ কিন্তু অনুবাদের বই সবারই থাকে৷
অনুবাদ সাহিত্য সামগ্রিক সাহিত্যের বিকাশে কতটা ভূমিকা রাখছে? আর অনুবাদ হওয়া বইয়ের পাঠক কেমন?
একটা বিষয় এখানে বলতেই হবে যে, আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখবো, বাংলা সাহিত্যের বিকাশটা মধ্যযুগে শুরু হয়েছে৷ সেটা কিন্তু অনুবাদ সাহিত্যের হাত ধরেই এগিয়েছে৷ এখানে কৃত্তিবাসের রামায়ণ একটা বড় ভূমিকা রেখেছে৷ আমাদের এখানে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ থেকে এ পর্যন্ত সেই বিকাশে বিদেশি সাহিত্যের একটা বড় ভূমিকা আছে৷ এটা শুধুমাত্র যে চিন্তাগত দিক দিয়ে, তা নয়, কাঠামোগত দিক দিয়েও৷ আমরা যখন সনেটের ফর্মটা নিচ্ছি, আমরা যখন উপন্যাসে কাঠামোগুলো নিচ্ছি, নানান ধরনের সাহিত্য নিচ্ছি,
এগুলো কিন্তু অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমাদের সাহিত্যে মূলত এসেছে৷
মৌলিক বইয়ের সঙ্গে অনুদিত বইয়ের কোন প্রতিযোগিতা আছে ?
প্রতিযোগিতা বলতে আসলে আমরা যেটা বুঝি, এখানে কিন্তু বইয়ের মধ্যে সেই প্রতিযোগিতা নেই৷ প্রতিটি বই স্বতন্ত্রভাবে আসে৷ একজন পাঠকের কাছে অনুবাদের বইটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠাই বড় কথা৷ আমরা যদি প্রকাশনা শিল্পের দিকটা দেখি, তাহলে অনুবাদ বইয়ের মার্কেটটা বাংলাদেশে বরাবরই ভালো৷ এছাড়া একটা ভালো বইয়ের প্রতিযোগী এভাবে একটা বই হতে পারে না৷ একজন পাঠক কিন্তু অনেকগুলো বই কিনেই পড়েন৷ তিনি ভাবেন না যে, একটা বই কিনব৷ একটা বাসায় একটা টেলিভিশন থাকতে পারে, কিন্তু বই তো আর একটা থাকে না, অনেক বই থাকতে পারে৷ সে অর্থে আমি মনে করি না একটা বই আরেকটা বইয়ের প্রতিযোগী৷ বরং আমি মনে করি এটা পরিপূরক৷
এবারের বইমেলায় অনুবাদের বই নিয়ে বাংলা একাডেমির প্রস্তুতি কেমন?
এবারের বই মেলায় বাংলা একাডেমির ২-৩টি অনুবাদের বই আসার কথা৷ গত ২৩ বছরে যে বইগুলো এসেছে, সেগুলোও থাকবে৷ কিন্তু বড় করে ব্যাপক আকারে অনুবাদ নিয়ে যে আলাদা করে একটা প্রস্তুতি, সেটা ওভাবে নেই৷ কারণ, বাংলা একাডেমিকে বইমেলার প্রস্তুতির মধ্যে থাকতে হয়৷ তাদের নানা ধরনের কাজকর্ম করতে হয়৷ পুরো বইমেলার আয়োজনের সাথেই বাংলা একাডেমি সম্পৃক্ত৷ এখানে বাংলা একাডেমিকে অনেক কিছুই করতে হয়৷ তবে আমরা আশা করছি যে, যদি বাংলা একাডেমি অনুবাদকে একটি প্রকল্পের আন্ডারে অনেকগুলো বই প্রকাশ করতে পারে, তাহলে আগামীতে একটা বড় পরিসরে অনেকগুলো বই বাংলা একাডেমি থেকে আসতে পারে৷
বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্যের মান কেমন? লিখুন নীচের ঘরে৷