1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রেস কাউন্সিল নিধিরাম, সরকার আসল সর্দার

৭ এপ্রিল ২০২৩

সম্প্রতি প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে হয়রানি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর সরকার ও তার সংস্থাগুলোর নিবর্তনমূলক ইচ্ছার প্রতিফলন আরো একবার আমরা দেখলাম৷

https://p.dw.com/p/4Poqh
Bangladesch | Büro des Presserats in Dhaka
ছবি: Mortuza Rashed

প্রসঙ্গক্রমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, দেশে প্রেস কাউন্সিল বলবৎ থাকতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো এমন কঠোর নিবর্তনমূলক আইনের অধীনে মামলা দিয়ে, গ্রেপ্তার করে- কেন সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে৷ অর্থাৎ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার্থে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটির প্রাসঙ্গিকতা, কার্যকারিতা ও সক্ষমতা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে৷ যখনই কোনো নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের হয়রানি করার চেষ্টা করা হয় তখন প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকা ও সংস্থাটির সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যখন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছিল, আইনটির অধীনে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তখনও অভিযোগ করা হয়েছিল, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকাকে বারবার উপেক্ষা করা হয়েছে৷ এমন অভিযোগ অতীতে বহুবার বলা হয়েছে – এটি হলো ধান নাই চাল নাই, আন্দিরাম মহাজনের মতো কিংবা এটি একটি নখদন্তহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান৷

ওয়ার্ল্ড এসোসিয়েশন অব প্রেস কাউন্সিলের সদস্যদের উদ্দেশ্য এবং কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিশ্বের প্রায় সব দেশের প্রেস কাউন্সিলই (কোনো কোনো দেশে প্রেস অমবুডসম্যান বা ন্যায়পাল নামে পরিচিত) দুটি মৌলিক উদ্দেশ্যে গঠিত: এক. বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও সংবাদ প্রকাশে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা; দুই. রাজনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থা থেকে উদ্ভুত যে কোনো বাহ্যিক চাপ বা হস্তক্ষেপ থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা৷ পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন প্রেস কাউন্সিল হলো সুইডিশ প্রেস কাউন্সিল, যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৬ সালে৷ এরপর থেকে যতগুলো প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সবারই উদ্দেশ্য একই-গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কাজ করা৷ বাংলাদেশেও সংবাদপত্র এবং সংবাদসংস্থার স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের পেশাগত মান সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ এর জন্য প্রণীত ১৯৭৪ সালের আইনের ১১ নম্বর ধারায় কাউন্সিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রেসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাসমূহের মান বজায় রাখা ও উন্নয়ন করা৷ কার্যাবলীতে বলা হয়েছে, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাসমূহের স্বাধীনতা সংরক্ষণে সহায়তা করা; সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের কাজের উচ্চমান বজায় রাখতে আচরণ বিধি প্রণয়ন করা; সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা৷ ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসব উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী কতটুকু সংস্থাটি পালন করতে পেরেছে? সংস্থাটি বার্ষিক আমলনামার যে বিবরণী প্রকাশ করে থাকে সেগুলোতে দৃষ্টি দিলে এর অন্তঃসারশূন্যতা সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠে৷ তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি একবার বলেছিল, যে উদ্দেশ্যে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তার নিরিখে প্রতি বছর সংস্থাটির জন্য যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় তার পুরোটাই জলে যায়৷

Bangladesch | Wahlen | Talkshow
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷ছবি: bdnews24.com

একই ধরনের উদ্দেশ্যে গঠিত ও পরিচালিত বিশ্বের সফল প্রেস কাউন্সিলগুলোর দিকে তাকালে বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিলের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিবন্ধকতা চোখে পড়বে৷ এসব সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশে প্রেস কাউন্সিল কখনই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি৷ এর মধ্যে প্রথম কারণটি হলো কাউন্সিল গঠনে সদস্য অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং পরিচালনার জন্য সরকারের ওপর আর্থিক নির্ভরশীলতা৷ যখন কোনো আধা-বিচারিক সংস্থার সদস্যগণ সরকারের আস্থাভাজন হয় এবং এর আর্থিক সক্ষমতার ভার সম্পূর্ণরূপে সরকারের হাতে থাকে তখন সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যে কোনো সরকারই নিজেদের হাতে রাখতে চাইবে৷ বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ১ জন চেয়ারম্যান ও ১৪ জন সদস্য নিয়ে গঠিত৷ সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান কিংবা সাবেক কোনো বিচারক এ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হবেন এবং তিনি রাষ্টপতি দ্বারা মনোনীত হবেন৷ বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত মানে সরকার দ্বারা মনোনীত৷ অর্থাৎ সরকার তার পছন্দসই ব্যক্তিকে সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকেন৷ ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিয়োগের ভার এককভাবে সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়নি৷ সেখানে লোকসভার স্পিকার, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ও প্রেস কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি মিলে চেয়ারম্যান বাছাই করেন৷ যুক্তরাজ্যের প্রেস কাউন্সিলে (যেটি প্রেস কমপ্লায়েন্ট কমিশন বা পিসিসি নামে পরিচিত) সরকারের কোনো প্রতিনিধি থাকে না এবং এর নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই৷ কিন্তু বাংলাদেশে আমরা ঠিক এর উল্টো চিত্র দেখতে পাই৷ প্রেস কাউন্সিল আইন অনুযায়ী ১৪ সদস্যের মধ্যে স্পিকার মনোনীত দুজন সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বাংলা একাডেমি ও বার কাউন্সিল থেকে একজন করে প্রতিনিধি, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার তিনজন মালিক প্রতিনিধি, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার তিনজন সম্পাদক প্রতিনিধি এবং সাংবাদিকদের ইউনিয়ন বা সমিতি থেকে তিনজন প্রতিনিধি থাকবেন৷ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানে পলিটিক্যাল প্যারালালিজম এতটাই প্রকট যে এখান থেকে সরকার-সমর্থক  ছাড়া মনোনয়ন পাওয়ার আশা কার্যত সুদূর পরাহত৷ উপরন্তু শুধু গণমাধ্যম মালিক নয়, বরং বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যেও রাজনৈতিক বিভক্তি প্রকট৷ দুটো সাংবাদিক ইউনিয়নের মধ্যে একটি আওয়ামী লীগ ও অন্যটি বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত৷ ফলে কার্যত সরকার সমর্থক প্রতিনিধিরাই প্রেস কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন৷ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন – সব পর্যায়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো কোনো প্রতিষ্ঠানই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না৷ কারণ সবখানে দলীয়, পরিষ্কারভাবে বললে, সরকার দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পায়৷ গত দুই দশকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম মালিকানার বিকাশ ঘটেছে দলীয় আনুগত্যের ওপর ভিত্তি করে৷ সাংবাদিক ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোতেও অনেক বেশি দলীয়করণের চর্চা হচ্ছে৷ ফলশ্রুতিতে প্রেস কাউন্সিল গঠিত হচ্ছে দলীয় অনুগত সাংবাদিক, মালিক ও অন্যান্য পেশাজীবী সদস্যদের সমন্বয়ে৷ যার অর্থ হলো প্রেস কাউন্সিলে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না৷ এই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিল বরাবরের মতো আস্থাহীনতার সঙ্কটে ভুগেছে যার ফলশ্রুতিতে অংশীদারগণের সাথে কোনো দৃঢ় সম্পর্ক সংস্থাটি এত বছরেও তৈরি করতে পারেনি৷ অর্থাৎ যে সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও সংবাদসংস্থার জন্য এই প্রেস কাউন্সিল গঠিত হয়েছে তাদের সাথে সংস্থাটির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে৷ বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের একটি অন্যতম কাজ হলো সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার জন্য একটি আচরণ বিধি তৈরি করা এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চর্চার মাপকাঠি হিসেবে একটি সর্বসম্মতভাবে পালনে উদ্বুদ্ধ করা৷ কাউন্সিল ১৯৯৩ সালে ২২টি ধারা সম্বলিত (২০০২ সালে সংশোধিত) একটি আচরণ বিধি প্রকাশ করেছিল যেটির কোনো প্রভাব আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে গণমাধ্যম শিল্পে দেখা যায়নি৷ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বেশিরভাগ সাংবাদিক এই আচরণ বিধি সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই রাখে না৷ সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ইসরাইল, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে আমরা এর ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই৷

বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিল সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার পেছনে একটি বড় কারণ হলো সরকারের ওপর এর আর্থিক নির্ভরশীলতা৷ অথচ ভারত, ডেনমার্কসহ অনেক দেশের প্রেস কাউন্সিলের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সংবাদপত্র এবং সংবাদসংস্থাগুলোর সার্কুলেশন এবং আয়ের উপর একটি নির্দিষ্ট কমিশন এসব দেশের প্রেস কাউন্সিলগুলো পেয়ে থাকে৷ এটিই তাদের মূল আর্থিক উৎস৷ পাশাপাশি সরকারি অনুদানও পেয়ে থাকে৷ কিন্তু বাংলাদেশে সরকারই যেহেতু কাউন্সিলের একমাত্র আর্থিক উৎস তাই সরকারি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে কাজ করতে হয়৷ কারণ অর্থশাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী, কোনো বিনিয়োগই শর্তমুক্ত নয়৷ যার পরিণাম হলো প্রেস কাউন্সিল তার মূল দুটি উদ্দেশ্যের জন্য কখনই কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি৷ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের সংবাদপত্র, সংবাদসংস্থা ও এসব প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য কাজ করবে এই কাউন্সিল৷ কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোনো উদাহরণ আমাদের সামনে নেই যখন কোনো বাহ্যিক শক্তি বাংলাদেশের কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে তখন প্রেস কাউন্সিল কোনো ভূমিকা রেখেছে৷

বাংলাদেশের গণমাধ্যম শিল্প ও এর বাজার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে বলা যায়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণকারী বাহ্যিক শক্তিগুলো হলো মূলত সরকার, সরকারী সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও বিজ্ঞাপন প্রদানকারী কোম্পানিগুলো৷ এদের মধ্যে গত কয়েক দশকে সরকার ও সরকারী সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরনের আইনের অপপ্রয়োগ, সরকারী ও বেসরকারি বিজ্ঞাপনে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছে৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থায় একটি বিষয় এখন ওপেন সিক্রেট – সরকার ও সরকারি সংস্থাগুলোর চাপে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে সেলফ-সেন্সরশিপ এখন নিত্যদিনের চর্চিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷ ওয়ান ইলেভেনের পর যখন একটি গোয়েন্দা সংস্থার ফরমায়েশকৃত তথ্য দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুটি সংবাদপত্রে অবাধে প্রকাশিত হয়েছিল তখন প্রেস কাউন্সিল যেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি, সংবাদপত্র দুটিকে মৃদু ভৎসনা বা তিরষ্কার পর্যন্ত করেনি, তেমনি এখন যখন সরকারী সংস্থাগুলোর চাপে সেই পত্রিকা দুটির স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ তখনও প্রেস কাউন্সিল নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে৷ দেশে গণমাধ্যমের সাথে সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালার সংখ্যা ৫৫ ছাড়িয়ে গেছে৷ অথচ তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ২০১১ ছাড়া অন্য সবগুলো আইন ও নীতিমালা কোনো না কোনোভাবে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে৷ কিন্তু প্রেস কাউন্সিল কখনই এসব আইন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, সরকারকে বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে কোনো কৈফিয়ত তলব করেনি৷ এখানে প্রেস কাউন্সিল মূলত নিধিরাম সর্দার, সরকার হলো আসল সর্দার৷

উপরন্তু সরকার চেষ্টা করছে প্রেস কাউন্সিলকে সেলফ-রেগুরেটরি প্রতিষ্ঠান থেকে সংবিধিবদ্ধ একটি সংস্থা হিসেবে পরিণত করে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আরেকটি আইনি সংস্থার পালক যোগ করতে৷ ২০২২ সালের ২০ জুন মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছিল, প্রেস কাউন্সিল (সংশোধিত) আইনটি মন্ত্রিপরিষদের পাঠানো হয়েছিল যেখানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘন, জনসম্প্রীতি বিনষ্ট ও অপসাংবাদিকতার দায়ে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছিল৷ মন্ত্রিপরিষদ এ বিধানটি বাতিল করলেও খসড়ার ১২ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের দায়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব রাখা হয়েছে৷ এডিটরস কাউন্সিলের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম, দেশের সম্পাদক, সাংবাদিক এমনকি কাউন্সিলের সদস্যরাও এমন প্রস্তাবের বিষয়ে জানতেন না৷ বিশ্বের সফল প্রেস কাউন্সিলগুলোর একটিরও উদাহরণ দেখানো যাবে না যেখানে প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিক কিংবা সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক বা শারীরিক দণ্ড দেয়ার ক্ষমতা রাখে৷ বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিল আইনটি ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের আদলে তৈরি করা৷ ভারতীয় প্রেস কাউন্সিল কোনো সম্পাদক বা কর্মরত সাংবাদিকের পেশাগত অসদাচরণের জন্য তাদেরকে সতর্ক বা তাদের নিন্দা করতে পারে, কেন্তু কোনো আর্থিক জরিমানা বা কারাদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা সংস্থাটির নেই৷

সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত৷ কারণ সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের চোখ ও কান৷ এক্ষেত্রে নৈতিকতা হলো প্রাথমিক অত্যাবশ্যকীয় শর্ত, যা ছাড়া সংবাদমাধ্যম অর্থহীন৷ কিন্তু নৈতিকতা পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা লাগে, যা তাদের পেশাগত নিরাপত্তার নির্ভরতা দেয়৷ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি রাজনৈতিক অধিকার৷ মানুষের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারের অনেকগুলো উপাদানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা৷ গণমাধ্যমের নৈতিকতা ও স্বাধীনতা – দুটোই বহুদিনের চর্চার বিষয়, হঠাৎ করে একদিনে এ দুটোর ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে উঠে না৷ বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের ধারণা হলো তারা সংবাদ তৈরি করে ও প্রকাশ করে৷ কিন্তু একটি নৈতিক গণমাধ্যম সংবাদ সংগ্রহ করে, কখনই সংবাদ তৈরি করে না৷ আবার বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ধারণা হলো সরকারের সমালোচনা মানে রাষ্ট্রদ্রোহ করা, নৈতিকতার চরম স্খলন৷ প্রেস কাউন্সিলের অকার্যকারিতার পেছনে শুধু সংস্থাটি বা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলোর ইচ্ছা এককভাবে দায়ী নয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোরও দায় কম নয়৷ ৫০ বছরের বেশি বয়সী গণমাধ্যম শিল্পের অংশীদারগণ স্ব-নিয়ন্ত্রণী সংস্থাটিকে অকেজোই দেখতে চেয়েছে৷ একে শক্তিশালী করার জন্য কখনই তেমন কোনো উচ্চবাচ্য বাংলাদেশের সাংবাদিক ও তাদের সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে শোনা যায়নি৷ চীনা একটি প্রবাদ আছে – অন্ধকারকে অভিশাপ দেওয়া থেকে একটি প্রদীপ জ্বালানো ভাল৷ এর অর্থ হলো কোনো সমস্যা সম্পর্ককে অভিযোগ না জানিয়ে সমস্যাটির সমাধানে সচেষ্ট হওয়া উচিত৷ শুধু সরকারী নিয়ন্ত্রণের মুখোমুখি হলেই বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে সুরহা করার জন্য কিংবা প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার জন্য অনেক কলাম, মন্তব্য ও সংবাদ প্রকাশিত হয়৷ এভাবে নিজেদের দূরাবস্থার সময়ই শুধু প্রেস কাউন্সিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে অবস্থা বাংলা প্রবাদের মতই থাকবে- ‘আছে গরু না পায় হালে, দুঃখ না ছাড়ে কোন কালে'৷ 

লেখকঃ শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷