'প্রায় রণক্ষেত্র কী বলছেন, মণিপুর তো যুদ্ধক্ষেত্রই'
১০ আগস্ট ২০২৩মৈরাঙে যে জায়গায় ১৯৪৪ সালে পতাকা তুলছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আইএনএ, সেখান থেকে কিছুটা এগোলেই ত্রাণশিবির। একটা কলেজকে বন্ধ রেখে সেখানে ঠাঁই দেয়া হয়েছে প্রায় নয়শ জনকে। ২০ কিলোমিটার দূরে চূড়াচাঁদপুরে সহিংসতায় তাদের বাড়ি পুড়ে গেছে। সেইসঙ্গে পুড়েছে যথাসর্বস্ব। সেই ত্রাণশিবিরে দেখা প্রৌঢ় মৈরাঙথে মুহিজোর সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ''বাড়ির সঙ্গে সবকিছু পুড়েছে। হাতে একটা পয়সা নেই। এখন রাতে ঘুমাতে পারি না। রাত দুটো, তিনটেয় উঠে পড়ি। মাথায় আগুন জ্বলতে থাকে। আমি অস্ত্র চাই। অস্ত্র পেলেই আমিও ওদের মারব। দরকার হলে মরব। এভাবে আর থাকতে পারছি না।'' কান্নার দাপটে পরের কথাগুলো আর শোনা গেল না।
এই মেইতেই প্রৌঢ় ছিলেন চূড়াচাঁদপুরে, কুকিদের এলাকায়। এখন তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিতে চান।
মোরেতে কুকি নারীর কথা
ঠিক একই ইচ্ছের কথা শুনলাম মোরেতে। মোরে হলো ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের ছোট শহর। কুকিদের এলাকা। সেখানেই দেখা আনচিনের সঙ্গে।
আনচিন কুকি নারী সংগঠনের নেত্রী। অত্যন্ত প্রভাবশালী। মোরেতেও একাধিক ত্রাণশিবির আছে। মেইতেই এলাকা থেকে পালিয়ে আসা কুকিরা সেখানে আছেন। তাদেরও ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
সেই ত্রাণশিবিরের কাছেই সংগঠনের অফিসে বসে আনচিন বলছিলেন, ''আমার ইচ্ছে করে বন্দুক হাতে তুলে নিই। তারপর যা হওয়ার হবে। আর এভাবে পারছি না।''
শুধু বন্দুক, রাইফেলের রাজ্যে
মৈরাঙথে ও আনচিন বন্দুক হাতে তুলে নেয়ার কথা বলেছেন, আর বাস্তব হলো একদিকে মেইতেই এবং অন্যদিকে কুকি যুবকরা হাতে তুলে নিয়েছেন বন্দুক। আপনি যে কোনো অত্যাধুনিক রাইফেলের নাম করুন, সেটা মণিপুরে দেখতে পাবেন। একে৪৬, একে৪৭, একে সিরিজের বাকি রাইফেল, তার সঙ্গে মর্টার. বোমা কী নেই দুই তরফের হাতে।
সেদিন সকাল থেকেই উত্তেজনা তুঙ্গে। কারণ, কুকিরা ঘোষণা করেছিল, সংঘর্ষে মৃত মানুষদের তারা বিতর্কিত এলাকায় গিয়ে কবর দেবে। আর মেইতেইরা জানিয়েছিল, তারা কিছুতেই এই কাজ করতে দেবে না। কুকিরা নিজেদের এলাকায় গিয়ে কবর দিক। কিন্তু বিতর্কিত এলাকায় নয়।
মণিপুরে মেইতেইরা প্রধাণত থাকেন উপত্যকায়। আর কুকিরা পাহাড়ে। এই সংঘাতের আগে পাহাড়ে কুকিদের সঙ্গে কিছু মেইতেইও থাকতেন। কুকিরাও থাকতেন উপত্যকায়। কিন্তু ৩ মে-র পর উপত্যকায় কুকিদের এবং পাহাড়ে মেইতেইদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দুই তরফের সহিংসতার শিকার বাস্তুহীন মানুষরা এখন ত্রাণশিবিরে।
সেদিন চূড়াচাঁদপুর যাওয়ার পথে তুরবুংয়ে র কাছে ব্যারিকেড করে রেখেছিল আসাম রাইফেলস। সেই ব্যারিকেডের একদিকে ছিল কুকিরা, অন্যদিকে মেইতেইরা। ইম্ফল থেকে ওই তুরবুং যাওয়ার রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার পরপরই গাছের ডাল ফেলে রাখা হয়েছিল। তার পিছনে ছিলেন মেয়েরা। তারা কোনো সেনার ট্রাক, জিপ বা তাদের কাছে সন্দেহজনক গাড়ি যেতে দেবেন না। সাংবাদিকদের গাড়ি যেতে দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু তার আগে দেখে নেয়া হচ্ছিল, সাংবাদিকরাই গাড়িতে আছেন কি না।
তুরবুংয়ের কাছে যেখানে ব্যারিকেড করে রাখা হয়েছিল, সেখানে পৌঁছে দেখি, সামনে শুধু মেয়েরা। তারা সেনার মুখোমুখি হয়ে তর্ক করছেন, কেন তাদের আগে যেতে দেয়া হবে না। আগে সেই বিতর্কিত জমি, যেখানে পাহাড় শুরু হচ্ছে, উপত্যকা শেষ হচ্ছে। যে জমি দাবি করছেন দু-পক্ষই। দু-পক্ষের মনোভাব একই। বিনা যুদ্ধে এক চুল জমিও তারা ছাড়বেন না।
একটু পরেই সেনাবাহিনীর তৈরি করা ব্যারিকেড তুলে নিয়ে পালাতে শুরু করলেন নারীরা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ব্যারিকেড আর থাকলো না। মুখোমুখি সেনা ও নারীরা। তারপরেই শুরু হলো কাঁদানে গ্যাস ছোড়া। শুরু হলো ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের ডেকে আনা হলো। তার আগে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত গিয়ে আহতদের নিয়ে পৌঁছে দিল চিকিৎসাকেন্দ্রে।
এরপরের দৃশ্য হলিউডি ছবিকেও হার মানাবে।
একের পর এক জিপসি বা গাড়ি যাচ্ছে। তাতে পাথরের মতো কঠোর মুখ করে বসে আছে পাঁচ থেকে ছয়জন যুবক। প্রত্যেকের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র। পরনে কম্যান্ডো পোশাক। বুলেট প্রুফ জ্য়াকেট। মাথায় টুপি। তারা গাড়ির থাকে হাত বার করে থামস আপ দেখাচ্ছেন। দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। তারা হাততালি দিয়ে, থামস আপ দেখিয়ে উৎসাহিত করছেন ওই যোদ্ধাদের।
একটা দুটো নয়, একের পর এক গাড়ি যেতে শুরু করলো এভাবে। তার মধ্যে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত যুবকরা। যত গাড়ি যাচ্ছে, ততই উল্লাস বাড়ছে চারপাশে। প্রথমে কিছুক্ষণ গোণার চেষ্টা করেছিলাম। পরে তা ছেড়ে দিলাম।
একবারের জন্যও ভাববেন না, এটা একদিকের ছবি। মেইতেই ও কুকি এলাকার ছবিটা একই। দুই তরফের যুবকরা হাতে শুধু অস্ত্র তুলে নেয়নি, তারা রীতিমতো প্রশিক্ষিত ও প্রস্তুত। দেকে মনে হয়, লড়াইয়ের কৌশল তাদের করায়ত্ত।
এ কোন রণক্ষেত্র!
এরকম ছবি যে ভারতে দেখতে হবে তা ছিল কল্পনার অতীত। আমরা তো শুনেছি, বহুবার রিপোর্ট করেছি, সীমান্তে সেনা ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বাংকার থাকে। কিন্তু একটি রাজ্যের দুই জনগোষ্ঠী একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গ হিসাবে বিভিন্ন জায়গায় বাংকার করে রেখেছে, সেখানে অস্ত্র হাতে তারা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত, এমন ছবি দেখতে হবে ভাবিনি।
দুই পক্ষের হাতে আছে স্নাইপার রাইফেল। স্নাইপার হলো দূরপাল্লার রাইফেল, যা দিয়ে নিখুঁতভাবে অনেক দূরে থাকা লক্ষ্যে আঘাত করা যায়। দুই তরফেই যুবকদের স্নাইপার রাইফেলের দূরবীনে চোখ রেখে নিশানা করতে দেখেছি। বস্তুত, যেদিন তুরবুংয়ের কাছে এই ঘটনা ঘটলো, সেদিন বারবার শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে দেখা হচ্ছিল, অন্য পক্ষ স্নাইপার রাইফেল নিয়ে তাক করছে কিনা। একটা জায়গায় পাশে মাঠ ছিল। তার কিছুটা দূরে পাহাড়া। সেই পাহাড়ে বাঙ্কার আছে বলে মনে করছিলেন অন্য পক্ষ, এমনকী নিরাপত্তা বাহিনীও। তুরবুংয়ের সীমানা থেকে পিছনে গাড়ির দিকে আসছি। তখন মাঠ পেরনোর সময় হঠাৎ হাত ধরে টান মারলেন একজন। বললেন, এখনই মাথা নিচু করে বসে পড়ুন একটা গাড়ির আড়ালে। ওদিক থেকে স্নাইপারে গুলি চলতে পারে। একটু পরে তিনি পাঠিয়ে দিলেন অন্য পাশে। বললেন মাঠ দিয়ে যেতে হবে। সেই চরম কাদাভরা মাঠের পাশে উঁচু আলের পিছনে প্রচুর মানুষ অপেক্ষমান।
ইম্ফল ফেরার পথে এক উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। দেখা হওয়ার পর তাঁকে বলা হলো, ''ওখানে তো প্রায় রণক্ষেত্রের পরিস্থিতি।'' তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ''কী বলছেন। যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি মানে? ওটা তো যুদ্ধক্ষেত্রই।''
এই মণিপুরের অবস্থা সত্যিই বড় ভয়ংকর, বড় চিন্তার।
(দ্বিতীয় পর্ব আগামিকাল)