প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্যে ছাত্ররা
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন ফাঁস এখন সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে৷ সাম্প্রতিক কালে এই রোগ যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে৷ এবারের এসএসসি পরীক্ষার যতগুলো পরীক্ষা হয়েছে তার সবগুলোরই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এই প্রশ্ন এখন ১০০-২০০ টাকায়ও পাওয়া যায়৷
র্যাব-পুলিশ প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে৷ শিক্ষকসহ অপরাধীদের অনেকেই ধরা পড়েছে৷ ধরা পড়েছে ছাত্ররাও৷ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভালো শিক্ষার্থীরা৷ তাদের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন বিষয়টি নিয়ে৷
তেমনই এক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ ঐ অভিভাবকের নাম শেখ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলে কিছুদিন আগে মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়েছে৷ সেখানেও প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে৷ সে পাশ করেছে, কিন্তু কোথাও চান্স পায়নি৷ অথচ নটরডেম কলেজ থেকে সে ৯২ শতাংশ নম্বর পেয়ে এইচএসসি পাশ করেছে৷ এখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে৷''
তাঁর মেয়ে ভিকারুন্নিসা স্কুলে পড়েন৷ তাঁর ক্ষেত্রেও একই ধরনের শঙ্কায় ভুগছেন তিনি৷ তিনি মনে করেন, প্রশ্ন ফাঁসের সূত্র ধরে খুব সহজেই এর হোতাদের ধরে ফেলা যায়৷
এদিকে, প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নাটোরের লালপুরের ১০ শিক্ষার্থী, ফরিদপুরে চার শিক্ষক, চট্টগ্রামে ১৯ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীর বাবা, গাজীপুরে শিক্ষকসহ সারাদেশে শতাধিক মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন৷
এসএসসি পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র বেচাবিক্রির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উত্তর বিভাগ ১৬ জনকে ও র্যাব-২ এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে৷ গ্রেপ্তার হওয়া ২১ জনের মধ্যে ১৭ জন ছাত্র৷
এদের মধ্যে নবম শ্রেণির ছাত্র থেকে শুরু করে চিকিৎসাবিদ্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াও রয়েছেন৷ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে অসংখ্য গ্রুপ তৈরি হয়েছে৷
পুলিশ জানিয়েছে, এরা কেউ পেশাদার অপরাধী নন৷ লোভে পড়ে এই পথে এসেছেন৷ ছাত্ররাও ‘প্রশ্ন ফাঁসকে' অপরাধ হিসেবে মনে করছেন না৷
র্যাব-২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার উজ জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, তারা এ পর্যন্ত যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছেন, তারা সবাই বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ তারা ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের' বিক্রেতা৷
তারা নিজেরা ফেসবুক কেন্দ্রিক একটি গ্রুপ থেকে প্রশ্ন কিনে এক থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করছিলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ইন্টারনেটে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বেচাকেনার জন্য ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে কয়েক হাজার গ্রুপ খোলা হয়েছে৷ এ গ্রুপগুলোর অ্যাডমিন খুঁজতে সময় লাগছে৷ এসব ঘেঁটে ফাঁসের উৎসে যাওয়ার চেষ্টা চলছে৷''
তবে তিনি স্বীকার করেন যে এখনো মূল হোতাদের কাছে পৌঁছানো যায়নি৷ তাদের বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে র্যাব৷
এদিকে, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্ত করতে একটি বিচার বিভাগীয় এবং একটি প্রশাসনিক কমিটি গঠন করেছেন হাইকোর্ট৷ ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় কমিটিতে থাকবেন নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট, আইন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন করে ডেপুটি সেক্রেটারি৷
অপরদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কমিটিতে থাকবেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সোহেল রহমান, মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কম্পিউটার সোসাইটির একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সিআইডির ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা৷
গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন৷ রিটের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া৷
ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, বিচার বিভাগীয় কমিটির কাজ হবে কারা জড়িত এবং কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে কার কার মাধ্যমে, কোন মাধ্যমে ফাঁস হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করবে এবং সেটার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকলে সেটা বা কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সে বিষয়ে পরামর্শ দেবে৷ প্রশ্নফাঁস কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, পাবলিক পরীক্ষায় ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে, কী পদ্ধতি অনুসরণ করলে এটা হবে না, সে বিষয়ে পরামর্শ দেবে প্রশাসনিক কমিটি৷
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পানি দূষিত হলে যেমন সবখানে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি প্রশ্ন ফাঁসটাও সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এরা রোধ করা না গেলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে৷ বিশেষ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও কিছু টাকা উপার্জনের পথ হিসেবে এই চক্রের হয়ে কাজ করছে৷ এমনকি কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার যুবকরা এই অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে৷''
ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি, এমসিকিউ পদ্ধতি বাতিল করতে হবে৷ এটা প্রশ্ন ফাঁস করার জন্য খুবই ভালো৷ সহজেই এর উত্তর সরবরাহ করা যায়৷''
তিনি মনে করেন, শিক্ষা পদ্ধতিতে পরীক্ষাকেন্দ্রিক হওয়ায় সমস্যাটা এমন আকার ধারণ করেছে৷ শিক্ষাদানের চেয়ে পরীক্ষা পাস বা ভালো নম্বর তোলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷
‘‘আমাদের সবার নজর এখন পরীক্ষা নিয়ে, এই পরীক্ষার হল থেকে নজর সরিয়ে ক্লাস রুমে নিতে হবে৷ শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতি আকৃষ্ট করা গেলে প্রশ্ন ফাঁস এমতিতেই রোধ হয়ে যাবে৷'' বলছিলেন ড. চৌধুরী৷
‘‘এর জন্য ভালো শিক্ষকও যেমন দরকার, শিক্ষকদের নানান সুবিধাও দিতে হবে৷''
আপনি কি ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে একমত? মন্তব্য করুন নিচের ঘরে৷