প্রধানমন্ত্রীর এ সফর কি সীমান্তে হত্যা কমাতে পারবে?
৫ সেপ্টেম্বর ২০২২গত জুলাইয়ে সীমান্ত সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনি বিএসএফ-এর মহাপরিচাক পঙ্কজ কুমার সিং। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘‘সীমান্ত এলাকায় সব গুলির ঘটনাই রাতে ঘটে এবং যেসব হতাহতের ঘটনা ঘটে তারা সবাই অপরাধী।”
জুলাইয়ে ( ১৭-২১ জুলাই) ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ-এর মধ্যে পাঁচদিনের সীমান্ত সম্মেলন হয়। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনি বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ তখন বলেছিলেন, ‘‘বৈঠকে বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে জোর দিয়েছে।বিএসএফ এ নিয়ে একযোগে কাজ করতে রাজি।”
তবে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রত্যাশা এবং অঙ্গীকার নতুন নয়। দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ভারত এই প্রতিশ্রুতি অনেক দিন ধরেই দিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
ওই সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা ছাড়াও চোরাচালান, মাদক চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ, সীমান্ত অপরাধ, সীমান্ত অপরাধের তথ্য বিনিময়সহ অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
সীমান্ত হত্যা কি কমেছে?
ওই বৈঠকের পর আগষ্টে, অর্থাৎ গত মাসেও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ২৪ আগস্ট পঞ্চগড়ের অমরখানা সীমান্তে আবদুস সালাম নামে এক বাংলাদেশিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৩১ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিংনগর সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে ভেদু নামে একজন নিহত হন।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেব অনুযায়ী, জুলাই পর্যন্ত চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে সীমান্তে বিএসএফ আট জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ছয় জনকে। এই সময়ে আহত হয়েছেন চার জন। সাত জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে সীমান্তে হত্যা করা হয় মোট ১৯ জন বাংলাদেশিকে। এর মধ্যে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে হত্যা করা হয় ৪৯ জনকে। তাদের মধ্যে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ৪২ জন। ২০১৯ সালে মোট ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়। গুলি করে হত্যা করা হয় ৩৭ জনকে। ২০১৮ সালে মোট হত্যা করা হয় ১৪ জনকে। সেই বছর গুলিতে প্রাণ গিয়েছিল আট জনের। এর আগে ২০১৭ সালে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়।
২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত পাঁচ বছর সাত মাসে সীমান্তে মোট ১৫৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই সময়ে আহত হয়েছেন ১৩৭ জন, অপহৃত হয়েছেন ১১৯ জন।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৯০ ভাগকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সীমান্তে মারণাস্ত্র ( লেথাল উইপন) ব্যবহার না করার কথা।
ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের( মাসুম) সচিব কিরীটি রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, " ২০১০ সালে মনমোহন সিং-এর সময় থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সীমান্ত হত্যা কমছে না। ভারতের সাথে পাবিস্তান, নেপাল, ভুটান সীমান্তে হত্যাকাণ্ড হয় না। শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই হচ্ছে। ভারত সরকার কথা দিয়ে কথা রাখছে না। বিএসএফ কথা শুনছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ সরকারের এটা নিয়ে আপত্তি নেই সেরকমভাবে। ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছে না।”
তার কথা, ‘‘দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট থেকে, অন্ততপক্ষে দেড়-দুই হাজার মাইল দূর থেকে চোরাচালনের পণ্য যায়। ডিসি, এসপি, থানার ওসির সামনে দিয়ে যায়। তারা সবাই ভাগ পায় তাই এগুলো চলে। এদের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা জড়িত। তারাও ভাগ পায়। আর দু-একটি ছেলে যে গরুর লেজ নিয়ে বোরোচ্ছে তারা গুলি খায়। যেরকমভাবে নারী পাচার হয়, সেরকমভাবে গরু পাচারও হয়।”
তিনি বলেন, "গুলি করে তখনই মারে যখন ভাগ পায় না বা পাশের যে লোকটি ভাগ পায়নি সে গুলি করে। ফেলানিকে গুলি করে যখন হত্যা করা হলো তখন অন্য জায়গায় টাকার বিনিময়ে মানুষ পাচার করা হচ্ছিল। ফেলানির বাবাকেও পাচার করা হলো। কিন্তু ফেলানিকে গুলি করা হলো। বিএএসএফ যদি না যুক্ত থাকে, তাহলে পাচার হয় না। এটা একটা করাপ্ট ফোর্সে পরিণত হয়েছে। বিজিবিও চোরাচালানে যুক্ত হয়ে গেছে।”
বাংলাদেশ ‘ওয়াক ওভার' দিয়েছে?
ভারত থেকে বাংলাদেশে বলতে গেলে গরু পাচার এখন শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ‘‘চোরাচলানের কথা যদি বলা হয় তাহলে এটা অনেক গভীরের বিষয়। এর রুট তো অনেক ভিতরে। ভারতের সেখান থেকে যদি চোরাচালান বন্ধ না করা হয় তাহলে তো হবে না। আসলে শুধু চোরচালানি নয়, যখন ভাগ বাটোয়ারার সমস্যা হয়, তখন ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে তারা হত্যা করে। এই যে সীমান্ত হত্যা হচ্ছে, এটা আইনকে পাশ কাটিয়ে হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যাদেরকে অপরাধী বলা হচ্ছে, আদালতে প্রমাণের আগে তাদের অপরাধী বলার সুযোগ নেই। অপরাধী বলে কাউকে হত্যা করাও চরম বেআইনি।”
তার কথা, ‘‘বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ এমন লোকজনকে নিয়োগ করে যারা বাংলাভাষী নয়। আবার ভারতের যেসব সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে, যেমন পাকিস্তান সীমান্ত, সেখান থেকে ফোর্স এনে আমাদের সীমান্তে দেয়া হয়। এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে।”
তার মতে, ‘‘ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। আর আমাদের দিক থেকে এই হত্যা বন্ধে ভারতকে যে ধরনের চাপ দেয়া দরকার, যে কৌশল করা দরকার, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেভাবে বিষয়টি তুলে ধরা দরকার, তা করছি না। আমরা ভারতকে ওয়াক ওভার দিয়ে দিয়েছি।”