প্রতিবন্ধতাজয়ীদের আন্তর্জাতিক উৎসব
শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও তারা প্রত্যেকে জীবনজয়ী। ঢাকায় হয়ে গেল তাদের আন্তর্জাতিক শিল্প উৎসব। ঢাকা থিয়েটার ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের এ আয়োজন সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন ছবিঘরে...
নেপথ্যে সুন্দরম
বাংলাদেশের আট বিভাগীয় শহরের ৯টি ও কলকাতার ১টি মিলিয়ে ১০টি নাটক মঞ্চস্থ হয় দু দিনের এ উৎসবে। সবক’টিতে অভিনয় করেছেন প্রতিবন্ধীরাই। তাদের নিয়ে গড়া ঢাকা থিয়েটারের অঙ্গসংগঠন ‘সুন্দরম’ প্রযোজনা করেছে এগুলো। এই মানুষরা সরল এবং সুন্দর, তাই তাদের নাম সুন্দরম রেখেছে ঢাকা থিয়েটার। ছবিতে সিলেটের শিল্পীদের পরিবেশনায় ‘সঙ্গতি’ নাটকের একটি দৃশ্য।
বিনামূল্যে টিকিট
ঢাকার সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ২৬ ও ২৭ এপ্রিল উৎসবে নাট্য প্রদর্শনী ছাড়াও ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল আলোচনা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। সবই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। কেবল নাটক উপভোগের জন্য নাম নিবন্ধন করে বিনামূল্যে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়েছে।
দেশ-বিদেশের দর্শক
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিল্প উৎসবে দুই দিনেই দর্শক উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোররাও শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালায় এসে সব আয়োজন উপভোগ করেছে। বিদেশি অতিথিরাও শিল্পীদের সৃজনশীলতা ও প্রাণোচ্ছলতায় মুগ্ধ হয়েছেন।
প্রতিবন্ধীদের মনে রাখার আহ্বান
উৎসব উদ্বোধন করেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি সমাজের সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের কথা মনে রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন,, ‘‘ব্যক্তিপর্যায়ে ঘরবাড়ি ও কর্মক্ষেত্র তৈরির বেলায় প্রতিবন্ধীদের কথা মনে রাখতে হবে। তাদের সমাজের মূলধারায় আনতে শিক্ষা, ক্রীড়া, আইনসহ সবক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে। সাভারে ৪৪৭ কোটি ব্যয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে।’’
সমবেত জাতীয় সংগীত
উদ্বোধনী আয়োজনে শিল্পী-অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে উপস্থিতদের সবাই। উৎসব আয়োজনে সহযোগিতা করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
তাওহিদ ও অন্যদের শিল্পকর্ম
উৎসবের প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবন্ধীদের অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প ও শিল্পকর্ম। বেশিরভাগ চিত্রকর্ম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন আর্টসে ডিগ্রিধারী তাওহিদ আল আশিক শ্রাবণের আঁকা। বাক-প্রতিবন্ধী তাওহিদ সব সময শিল্পের ডুবে থাকেন।
শঙ্করদের কথা
পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের বাসিন্দা শঙ্কর ধর দেড় বছর বয়সে জ্বর হওয়ার পর হাঁটার শক্তি হারান। তবে দমে যাননি। ধীরে ধীরে ভাস্কর হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। উৎসবে তার দুটি শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে। এর একটি বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের, অন্যটি ৩০ বছর আগে ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারির।
বেটোফেনের চিঠি এবং ...
শ্রবণশক্তি হারানো সত্ত্বেও কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন বেটোফেন। তার অনুপ্রেরণাদায়ক চিঠি ও জীবনের টুকরো তথ্য সাজিয়ে রাখা হয় উৎসবে। পাশেই ছিল বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নার্গিস পলির আঁকা চিত্রকর্ম। নার্গিসের চিত্রকর্মের বিষয় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। নীচের অংশে দৃষ্টিহীনরা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ পড়তে পারেন। চিত্রকর্মটির নীচে রাখা স্পিকারে ১৯৭১-এর কথা শোনার সুযোগও ছিল।
ব্রেইল প্লেটে নিজের নাম
জাতীয় নাট্যশালার লবিতে উৎসবের দুই দিন নির্দিষ্ট সময়ে দর্শনার্থীরা নিজের নাম ব্রেইল প্লেটে লিখিয়ে নিতে পেরেছেন। সানন্দে কাজটি করেছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাহিদ হাসান।
চলচ্চিত্র প্রদর্শনী
জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে ছিল প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তি ও আলোচনার ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র। প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের তালিকায় ছিল প্রয়াত অভিনেতা, পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘বিহঙ্গ’, তরুণ নির্মাতা শুভাশিস সিনহার ‘আলো আমার আলো’, আবিদ সরকার সোহাগের ‘সংস অব সানফ্লাওয়ার’ এবং এডওয়ার্ড লাভলেসের ‘নেম মি লওয়ান্ড’।
প্যানেল আলোচনা
উৎসবে প্যানেল আলোচনায় তিনটি বিষয়ে আলোকপাত করা– অন্তর্ভুক্তি ও বৈচিত্র্যের জন্য ‘শিল্পে প্রতিবন্ধীদের প্রতিনিধিত্ব’, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমান অংশগ্রহণের জন্য ‘প্রবেশযোগ্য শিল্পের জন্য প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ’ এবং প্রতিবন্ধী শিল্পীদের অবদানকে সমর্থন দিতে টেকসই তহবিলের জন্য ‘প্রতিবন্ধী শিল্পের জন্য অর্থায়ন অন্তর্ভুক্তি’।
বাঁশ ও ছনের তৈরি স্টল
শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত মাঠে বাঁশ ও ছন দিয়ে স্টল তৈরি করা হয়। এগুলোতে সেবা দিয়েছে প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সংস্থা ও উন্নয়ন সংস্থা। এরমধ্যে ছিল ইউএনডিপি, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি, বরিশাল অটিস্টিক অ্যান্ড বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুল, স্পর্শ ফাউন্ডেশন, সাইটসেভার্স প্রভৃতি।
তাদের তৈরি পণ্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন্স ডিজঅর্ডার বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী যত্নের দোকান স্টলে প্রতিবন্ধীদের তৈরি পণ্য বিক্রি করছেন। তাদের একজন বিজয়া দেবনাথ ডয়চে ভেলেকে জানান, তারা কাঁচামাল সরবরাহ করে এসব পণ্য বানিয়ে আনেন। সেগুলো বিক্রি করে পাওয়া অর্থ প্রতিবন্ধীদের দেওয়া হয়।
ডিয়ার প্রকল্পের অংশ
ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অংশীদারত্বে ডিয়ার (ডিজঅ্যাবিলিটি আর্টস রি-ডিফাইনিং এমপাওয়ারমেন্ট) প্রকল্পের অংশ হিসেবে উৎসবটি হয়েছে। দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিল্পকলার মধ্যে সম্পর্ক তৈরির লক্ষ্যে ২০১৩ সালে এটি শুরু হয়। তাদের প্রত্যাশা, প্রকল্পটির মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সামাজিক ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে এবং সামাজিকভাবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।
‘৫০ লাখ প্রতিবন্ধীকে আমরা অদৃশ্য করে রেখেছি’
মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার ভাবতে খারাপ লাগে, ৫০ লাখ প্রতিবন্ধীকে আমরা অদৃশ্য করে রেখেছি। এটা হতে পারে না। আমরা এই পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা করছি। আট বিভাগে আটটি সুন্দরম গড়েছি। এভাবে ৭০টি জেলায় প্রতিবন্ধীদের নাট্যসংগঠন তৈরি ইচ্ছে আছে আমাদের।’’
দুই দেশের মঞ্চনাটক
উৎসবে আরও মঞ্চায়ন হয়েছে ঢাকার ‘নৈঃশব্দে ৭১’ ও ‘কেন্দ্র বরাবর সুড়ঙ্গটির নাম পৃথিবী’, চট্টগ্রামের ‘স্বপ্নকাহন’, রংপুরের ‘ত্রিবেণী’, রাজশাহীর ‘পিতৃগণ’, ময়মনসিংহের ‘কাজলরেখা’, খুলনার ‘অতঃপর করিম বাওয়ালী’, বরিশালের ‘সার্কাস সার্কাস’ এবং কলকাতার জানা সংস্কৃতির ‘ওয়েস্টল্যান্ড- আ জার্নি’।