1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘পুলিশ সাংবাদিকতা করতে চাইলে তা আত্মঘাতী হবে’

সমীর কুমার দে ঢাকা
১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর একটা নিউজ পোর্টাল চালু করেছে৷ এই পোর্টালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, এখানে পুলিশরাও সাংবাদিকতা করবে৷ আসলেই কি পুলিশের পক্ষে সাংবাদিকতা করা সম্ভব?

https://p.dw.com/p/40A4E
ছবি: news.police.gov.bd

আর সাংবাদিকতা কী এমন কোন পেশা যে কেউ চাইলেই করতে পারেন? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান৷ 

ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর একটা নিউজ পোর্টাল চালু করেছে, এটা আপনি কীভাবে দেখেন?

অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান : এটা আমি পত্রিকায় দেখেছি৷ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ তো বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান৷ তারা নিজেদের কার্যক্রম জনগণকে জানানোর জন্য প্রোমোশনাল এক্টিভিটিজ হিসেবে বা পাবলিককে সম্পৃক্ত করার জন্য হয়তো এটা করেছে৷ এটাকে আমি ভালো উদ্যোগ হিসেবে দেখি৷ যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের কাজকর্ম জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারে সেখান থেকে অনেক কিছু জানা যাবে৷ এটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখি৷

বর্তমানে ডিএমপি নিউজ নামে একটি অনলাইন পোর্টাল চালু আছে৷ এখন পুলিশ সদর দপ্তর আরেকটি নিউজ পোর্টাল চালু করল৷ বিষয়টি কতোটা দরকারি?

এই দুইটা পোর্টালে তাদের কার্যক্রম জনগনকে জানানোতে আমি কোন অসুবিধা দেখি না৷ কিন্তু সম্প্রতি এই পোর্টালটা উদ্বোধন করতে গিয়ে তারা বলেছে, পুলিশও সাংবাদিকতা করবে৷ এমন একটা খবর দেখেছি৷ এই খবরটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ আসলে পুলিশের তো আর সাংবাদিকতা করার কথা না৷ সাংবাদিকতা সাংবাদিকদেরই করার কথা৷ এই জায়গাটাতেই জনগণের কাছে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে৷ প্রশ্ন উঠাটা তো স্বাভাবিক৷ কারণ পুলিশ যদি সাংবাদিকতা শুরু করে তাহলে সাংবাদিকতা বলে তো আর কিছু থাকবে না৷ পুলিশী সাংবাদিকতা বলে এমন কিছু আছে তা তো আমার মনে হয় না৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে তারা অপরাধীদের ধরবে, আমাদের কাজকর্মকে সহায়তা করবে, বিচারিক কার্যক্রমে সহায়তা করবে এটাই তো তাদের কাজ৷ জনগণের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় তারা কাজ করবে৷ তারা সাংবাদিকতা করবেন বলে যে কথাটা তারা বলেছেন সেখানে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আপত্তির একটা সুযোগ আছে৷ সাংবাদিকতার কাঠামো, ভাষা এগুলো পুলিশের থাকার কথা না৷ তারা তো তাদের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা৷

পুলিশ যদি সাংবাদিকতা শুরু করে তাহলে সাংবাদিকতা বলেতো আর কিছু থাকবে না: ড. গোলাম রহমান

পুলিশ সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়লে পুলিশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে? তাদের মনোযোগ কী মূল কাজ থেকে সরে যেতে পারে?

এটা আসলে ডিপেন্ড করে৷ আসলেই কী পুলিশ সাংবাদিকতা করবে, না করতে চায়? বা এটাই তারা বুঝিয়েছে কি-না৷ আমার মনে হয়, এই জায়গাটা খুব পরিষ্কার না৷ তারা আবেগতাড়িত হয়ে কথাটা বলেছে কি-না? সার্ভিস রুল হিসেবে তাদের তো সাংবাদিকতা করার কথা না৷ তারা সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করবেন৷ এটা হওয়া উচিৎ৷ এখন সেই তথ্য দেওয়া বা তাদের ওয়েব পোর্টালে খবরাখবর দেওয়া, এটাকেই কী তারা আলাদা ডায়মেনশন দিয়ে সাংবাদিকতার কথা বলল কি-না এই জিনিসটা এখনও আমার কাছে বোধগম্য না৷ আমার মনে হয়, তারা যদি রিয়েলি সাংবাদিকতা করতে চায় তাহলে এটা খুব আত্মঘাতি হবে৷ সুইসাইডাল হবে৷

পুলিশের এই ধরনের সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হওয়া কী সাংবাদিকতার উপর কোন প্রভাব পড়বে?

সাংবাদিকতার উপর তেমন কিছু প্রভাব পড়বে না৷ তবে এটা পুলিশের আলাদা একটা কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে৷ এটা তারা অতিউৎসাহ দেখিয়ে কাজটা করছে৷ তারা তো আর দুনিয়ার বা সারা দেশের সব খবরাখবর নিয়ে কাজ করবে না৷ সুতরাং সাংবাদিকতার উপর কী প্রভাব পড়বে? বরং তারা যে খবর পরিবেশন করতে চায় সেটা তাদের উপর কেন্দ্রীভূত হয়ে গেলে সাংবাদিকেরা দায়িত্ব পালনে অবহেলাও করতে পারে৷ বিশেষ করে পুলিশ বিট হিসেবে যখন এটা কভার করা হয়৷ যখন সাংবাদিকেরা পুলিশের এক্টিভিটিজকে উপস্থাপন করবে তখন সেই জায়গাটাতে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে৷ এটার সম্ভাবনা থেকে যায়৷ এটা আসলে পুলিশের দিক থেকে উল্টো হবে৷

পুলিশের যে সব সদস্য এই পোর্টালের সঙ্গে যুক্ত তাদের অনেকেরই তো সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা বা পড়াশোনা নেই৷ ফলে সাংবাদিকতার নীতি আদর্শ কতটা তাদের পক্ষে মেনে চলা সম্ভব?

এই কাজটা তাদের করার কথা না বা করতে পারার কথাও না৷ যেহেতু সাংবাদিকতা একটা আলাদা পেশা৷ এটার জন্য যথেষ্ট শিক্ষা নিতে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং এটার কাজ মূল্যায়ন সবকিছুই আলাদা৷ পুলিশের এ ব্যাপারে সফল হওয়ার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না৷ 

পুলিশের এই ধরনের উদ্যোগে কী সাংবাদিকদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়বে?

বাড়তেও পারে৷ দূরত্ব বাড়তে পারে এই কারণে যে, সাংবাদিকেরা সাংবাদিকদের কাজ করে৷ পুলিশের কাজকেও সাংবাদিকরা উপস্থাপন করে৷ এখন পুলিশ যদি মনে করে, তাদের কাজটা তারা নিজেরাই করবে তাহলে সাংবাদিকরা তাদের একটু অবহেলা করেতেই পারে৷ সেক্ষেত্রে তাদের যে ওয়ার্কিং রিলেশন বা মিউচ্যুয়াল রিলেশন সেটা হয়ত কমে যেতে পারে৷

সাংবাদিকতা কি এমন পেশা, যে কেউ চাইলেই এটা করতে পারেন?

আমাদের দেশে সাংবাদিকতা করতে গেলে একটা ডিসিপ্লিনের মধ্য দিয়ে আসতে হবে৷ ডিসিপ্লিনের মধ্য দিয়ে এটাকে গ্রহণ করতে হবে৷ এখন সাংবাদিকতা যদি কেউ ব্যক্তি পর্যায়ে করতে চান তাহলে তিনি ফ্রিল্যান্স হিসেবে করতে পারেন৷ এখানে ফ্রিল্যান্সের সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেশি নেই৷ কোন কোন ক্ষেত্রে লেখালেখি করা যায়৷ সেটা কেউ কেউ করে থাকেন৷ এই লেখালেখি থেকে কিছু আয় রোজগারও করতে পারেন৷ কিন্তু এটাকে পেশা হিসেবে ব্যতিক্রমীভাবে নিয়ে যে কেউ করতে পারবে না৷ এটা সম্ভব না৷ সুতারাং কেউ যদি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা করতে চান তাহলে তাকে কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই করতে হবে৷ সোশ্যাল মিডিয়াতে আজকে যে কাজটা হচ্ছে, সেটাকে তো আমরা প্রতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা বলছি না৷ তাদের প্রফেশনাল সাংবাদিক হিসেবেও তো আমরা বিবেচনা করছি না৷ বিষয়টা বুঝতে হবে এইভাবে৷

পুলিশ কী নিজেদের অনিয়মের খবর তাদের নিউজ পোর্টালে তুলে ধরতে পারবে? এটা কী নিজেদের স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য, না-কি অন্য কোন উদ্দেশ্যে?

এখন এখানে পুলিশ কী তাদের গুণগান গাইবে না-কি সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরবে, সেটা দেখতে হবে৷ নিশ্চয় তারা তাদের লুপহোলস তুলে ধরবে না৷ এখানে তারা তাদের ইতিবাচক কার্যক্রমকে তুলে ধরবে৷ একপেশে হবে এই পরিবেশনাটা৷ এটা সাংবাদিকতা হবে না৷ সাংবাদিকতা হচ্ছে নির্মোহ একটা পেশা৷ এখানে ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলতে হবে৷ সাংবাদিকতা আমাদের এটা শেখায়৷ কিন্তু পুলিশ যদি সাংবাদিকতা করতে চায় তাহলে তারা যে তথ্য দেবে সেটা বায়াস্ড ইনফরমেশন হবে৷ এই বায়াস্ড তথ্য দিয়ে ইতিবাচক সাংবাদিকতা হতে পারে না৷

পুলিশ যদি তাদের সাফল্যের খবর প্রকাশ করার জন্যই এই পোর্টাল করে থাকে তাহলে তো তাদের ওয়েবসাইট আছে, এমনকি প্রকাশনাও আছে? পোর্টাল করার দরকার হলো কেন?

আমার মনে হয়, অতি উৎসাহ থেকেই কাজটা তারা করেছেন৷ তারা মনে করেছেন, তাদের খবরগুলো নিজেদের পোর্টালে দিলেই হলো৷ আমার মনে হয়, জিনিসটা সুইসাইডাল হবে, আত্মঘাতি হবে৷ মিডিয়া থেকে তারা যে সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে থাকে, তাদের খবরগুলো যেভাবে প্রকাশ করা হয়, তাদের কোন ব্যর্থতা থাকলেও সেটাও প্রচার করা হয়, এই সুবিধাটা তারা আর পাবে না৷ ফলে সাংবাদিকতার কাজটা করা তাদের পক্ষে সম্ভব না, উচিৎও হবে না৷