পার্থের মন্তব্যে জল্পনা, চার শিক্ষক জেলে
৮ আগস্ট ২০২৩এক বছরের বেশি সময় নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জেলবন্দি পশ্চিমবঙ্গের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলের সাবেক মহাসচিব পার্থকে দল পদ থেকে সরিয়ে দিলেও তিনি বার বার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন। নিজেকে নির্দোষও বলেও দাবি করেছেন। সেই পার্থের মুখে ভিন্ন সুর ধরা পড়েছে।
সোমবার পার্থ আলিপুরের বিশেষ সিবিআই আদালতে নিজেই সওয়াল করেন। নিয়োগের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন তিনি। বলেন, দপ্তরের প্রধান সচিব বিষয়টি রাজ্যের মুখ্যসচিবকে জানান। মুখ্যসচিবের কাছ থেকে বিষয়টি যায় মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে।
শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকাকে নির্দোষ দেখাতে এই সওয়াল করলেও পার্থ বলেছেন, ''মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশকর্তা নন, নিয়োগকর্তাও নন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আমার আনুগত্য ছিল, আছে ও থাকবে।''
যদিও বিরোধীদের ব্যাখ্যা, আদতে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরকেই কৌশলে দায়ী বলতে চেয়েছেন পার্থ। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ''আমরা অনেকবার বলেছি, মাথাদের ধরতে পারছে না কেন্দ্রীয় সংস্থা। সাবেক মন্ত্রী সেই মাথার দিকে আঙুল তুলেছেন।''
বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ''মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম যৌথ দায়িত্বের কথা বলেছিলেন। এই দুর্নীতির ক্ষেত্রেও তাই। একসময়ের মন্ত্রী তার সর্বোচ্চ নেতৃত্বের দিকে দায় ঠেলে দিয়েছেন।''
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ জানিয়েছেন, ''দল ও সরকারের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে,, তাতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে মনোভাব স্পষ্ট। তার মন্তব্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।''
হাজতে 'অযোগ্য' শিক্ষকরা
পার্থের মন্তব্যে যেদিন রাজনীতি সরগরম, সেদিন প্রথমবার চার শিক্ষক জেলে গেলেন এই দুর্নীতির মামলায়। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা টাইগার হোসেন, সিমার হোসেন, জাহিরুদ্দিন শেখ ও সৌগত মণ্ডলের নাম রয়েছে সিবিআই চার্জশিটে। তারা সোমবার আলিপুর বিশেষ সিবিআই আদালতে আগাম জামিনের আবেদন জানান। বিচারক তাদের আদালত থেকে সরাসরি ১৪ দিনের জন্য জেল হেফাজতে পাঠান।
বিচারক বলেন, "চাকরির বিনিময়ে তাপস মণ্ডলকে এরাই টাকা দেন। সেই চাকরি ভোগও করেছেন তারা। তাদের জন্য বর্তমানে পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা জেলবন্দি।”
সিবিআই সূত্রের খবর, বেসরকারি কলেজ সংগঠনের মাথা তাপস মণ্ডলকে এই শিক্ষকেরা ২৩ লক্ষ টাকা দেন নিয়োগের জন্য। জেলবন্দি সাবেক তৃণমূল যুবনেতা কুন্তল ঘোষের মাধ্যমে এই টাকা তাপসের কাছে পৌঁছয়।
সিবিআই আগামীকাল বাঁকুড়ার সাত জন প্রাথমিক শিক্ষককে তলব করেছে। নিয়োগ সংক্রান্ত নথি নিয়ে তাদের হাজিরা দিতে হবে কলকাতার নিজাম প্যালেসে।
শিক্ষক সমাজের ভাবমূর্তি
দুর্নীতি মামলায় নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কের গ্রেপ্তার হয়েছেন। জেলে রয়েছেন নিয়োগকারী সংস্থার সাবেক উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। এই প্রথমবার ‘অযোগ্য' শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করা হল।
ওএমআর শিটে কারচুপি থেকে সাদা খাতা জমা দেয়া, নানা অভিযোগ উঠে এসেছে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে। সন্দেহের ঘেরাটোপে রয়েছেন অনেক কর্মরত শিক্ষক। এবার তাদের গ্রেপ্তারি গোটা শিক্ষক সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''এরা শিক্ষক সমাজের কলঙ্ক। তবে এদের দিয়ে সব শিক্ষককে বিচার করা যাবে না। নিচুতলায় একদল সুযোগসন্ধানী থাকবে। তাদের দুর্নীতির সুযোগ করে দিচ্ছে কারা?''
এই 'মাথাদের' কেন ধরা হচ্ছে না, প্রশ্ন উঠছে। অ্যাডভান্স সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেস-এর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক চন্দন মাইতি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''হাজার হাজার শিক্ষককে এভাবে গ্রেপ্তার করবে? জমি-জায়গা বেচে টাকা যাদের দেয়া হল, সেই টাকা যারা লোপাট করল, তাদের উঁচুতলার মাথাদের ইডি-সিবিআই সেভাবে ট্র্যাক করেনি। কেউ কেউ জামিনে ছাড়া পেতে শুরু করেছেন।''
বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হান্ডা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''শিক্ষকদে মান-মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার জন্য সরকার পরিকল্পনা করে নেমেছে। শিক্ষক সমাজ সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। এর প্রতিকারে আন্দোলনে নামা ছাড়া উপায় নেই।''
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''যে শিক্ষকরা অবৈধভাবে চাকরি পেয়েছেন, তাদের শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু যারা তাদের কাছ থেকে টাকা নিল, সেই টাকা উদ্ধার করে ওই শিক্ষক বা চাকরিপ্রার্থীদের ফেরাতে হবে। সেটা কেউ হজম করে ফেলবে, তা যেন না হয়।''
প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন
শিক্ষকরা যখন অবৈধ ভাবে চাকরি পাওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তখন প্রশ্ন উঠছে প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে। প্রশিক্ষণ না থাকলে ক্লাস নেয়া কি নিয়মবিরুদ্ধ নয়? এই সওয়াল করছেন চাকরি বঞ্চিতেরা।
২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণরা ২০২০ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চাকরি পেয়েছেন। তাঁরা এখন কর্মরত। নিয়োগের পর চাকরিপ্রার্থীদের ব্রিজ কোর্স করার কথা থাকলেও তা সম্পন্ন করেননি প্রায় ছ'হাজার চাকরিপ্রার্থী। এজন্য তারা 'বি' ক্যাটাগরির বেতন পেয়ে থাকেন। এদের নিয়োগ নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। অপ্রশিক্ষিতরা কীভাবে চাকরি করছেন? এই প্রশ্ন তুলে শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিলের দাবি করা হয়েছে মামলায়।
মামলাকারীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রাথমিক পর্ষদের রিপোর্ট তলব করেছেন। ১৮ অগাস্ট এই সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা দেবে বোর্ড। পরবর্তী শুনানি ২১ আগস্ট। সোমবার রাজ্যের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি, বক্তব্য পেশ করবে সেই দিন।
জামিনে প্রশ্ন ইডিকে
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় প্রথম জামিন পেলেন তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের স্ত্রী শতরূপা। একাধিকবার তলবের পর গত বছরের ১১ অক্টোবর ইডি'র হাতে গ্রেপ্তার হন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সাবেক সভাপতি মানিক। তারপর স্ত্রী ও ছেলে সৌভিককেও গ্রেপ্তার করা হয়।
সোমবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ শর্তসাপেক্ষে জামিন দেন শতরূপাকে। একইসঙ্গে ইডি'র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিচারপতি বলেন, ''শতরূপা ভট্টাচার্য কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন এমন প্রমাণ ইডি'র কাছে নেই। তিনি পালিয়ে যেতে পারেন এবং নথি বিকৃত করতে পারেন এই মর্মে আশঙ্কাও প্রকাশ করেনি ইডি।''
হাইকোর্টের নির্দেশে ৫০ হাজার টাকার দুটি বন্ডে জামিন পান শতরূপা। পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে তাকে। করতে হবে তদন্তে সহযোগিতাও। রাজ্যের বাইরে যাওয়ার আগে বিশেষ আদালতকে জানাতে হবে।