1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পাবলিক বাস মানেই আতঙ্ক, বাড়ছে বডি শেমিং

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৬ মার্চ ২০২২

বাংলাদেশে তরুণীদের যৌন নির্যাতন ও হয়রানি বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বডি শেমিং৷ এই কারণে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে৷  এর শুরু পরিবার থেকে হলেও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই নেতিবাচক প্রবণতা প্রবল৷

https://p.dw.com/p/485J4
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবিছবি: DW/M. R. Rahman

আঁচল ফাউন্ডেশন নামে তরুণদের একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের জারিপে এই তথ্য উঠে এসেছে৷ এক হাজার ১৪ জন শিক্ষিত তরুণীর মধ্যে তাদের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে শতকরা ৬৯.৯২ তরুণী বডি শেমিং-এর শিকার হয়েছেন৷ ৩৭.২৪ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন তাদের শরীরের আকৃতি ,গঠন এবং অবয়ব নিয়ে তাদের আত্মীয়রাই কথায় ও ইঙ্গিতে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন৷ বন্ধুবান্ধবের কাছে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ৷ এমনকি নিজ পরিবার থেকে বডি শেমিং-এর শিকার বলে জানিয়েছেন ১৪.২৫ শতাংশ৷ পথচারীর মাধ্যমে শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে ১১.৮৫ শতাংশ তরুণীর৷

জরিপে শতকরা ৬৫.৫৮ ভাগ তরুণী নানা  ধরনের যৌন হয়ারানির শিকার হন বলে জানিয়েছেন৷ এর মধ্যে পাবলিক বাসে ৪৫.২৭ ভাগ যৌন হয়রানির শিকার হন৷ বাস ও বাসস্ট্যান্ডে মিলিয়ে শিকার হন ৮৪.১০ ভাগ৷

ঘরের বাইরে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হন ৬৪.৯২ ভাগ তরুণী৷ এই তরুণীদের বড় একটি অংশ শৈশবেও যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন৷ তাদের সংখ্যা শতকরা ৩৮.৮৬ ভাগ৷

অনলাইনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিগ্রহের শিকার হন ৪৩.৮৯ শতাংশ তরুণী৷ এর মধ্যে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, ছবি, বডি শেমিং অন্যতম৷

সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণীরা জরিপে অংশ নেন৷ অংশগ্রহণকারী তরুণীদের ভেতর অবিবাহিত ৮৮.১৭ শতাংশ ও বিবাহিত ১০.৯৫ শতাংশ এবং বাকিরা সংসার করছেন না৷ 

দেখতে সুন্দর এমন মেয়েরাও হয়রানির শিকার হন: সাবেরা নায়ার (ছদ্ম নাম)

নেতিবাচক অভিজ্ঞতার শিকার কয়েকজন

সাবেরা নায়ার (ছদ্ম নাম) জানান, তার বডি শেমিং-এর নেতিবাচক অভিজ্ঞতা শুরু হয় শৈশব থেকেই৷ তার পরিবারেই এটা শুরু হয়৷ তার গায়ের রঙ আর স্থুলতা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের চিন্তা আর উদ্বেগ তাকে বিপর্যস্ত করে৷ এর পর কেউ কেউ তাকে ‘মোটু' ডাকতে শুরু করেন৷ তিনি জানান, ‘‘যতই আমি বড় হতে থাকি আশপাশের লোকজনও একই ধরনের কথা বলতে শুরু করেন৷ আর প্রাপ্ত বয়স্ত হওয়ার পর আমরা বিয়ে নিয়ে আমার চেয়ে অন্যদের চিন্তা বেড়ে যায়৷ শুনতে থাকি কালো মেয়ের বিয়ে হয় না৷ তারপর আবার মোটা৷''

আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে তো তিনি এখন নিজের ছবি দেয়া বন্ধই করে দিয়েছেন৷ ছবি দিলে কেউ কৌতুক করত আবার কেউবা নানা বাজে মন্তব্য করত৷  তিনি বলেন, ‘‘এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, অন্যদের  ক্ষেত্রেও হয়৷ দেখতে সুন্দর এমন মেয়েরাও হয়রানির শিকার হন৷''

এই তরুণী আসলে হরমোন জনিত কারণে স্থুল৷ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েও প্রতিকার পাননি৷ তার কথা, ‘‘আমার রোগের কথা কি আমাকে জনে জনে বলতে হবে? সবাই আমার মোটা শরীর আর গায়ের রঙ নিয়ে কেন কথা বলেন? আমি কি আয়নার আমাকে দেখি না?''

নিয়মিত পাবলিক বাসে চড়ে অফিসে যান সোহানা খান (ছদ্মনাম)৷ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগে কাজ করেন৷ তাকে মিরপুর থেকে মতিঝিলে যেতে হয় অফিস করতে ৷ অফিস থেকে ট্রান্সপোর্ট সুবিধাও দেয় হয় না৷ তিনি জানান, ‘‘বাসা থেকে বের হওয়ার পরই শুরু হয়  নানা কটূক্তি এবং ইঙ্গিতপূর্ণ কথা৷ এরপর শুরু হয় বাসস্ট্যান্ডে৷ আর বাসে ওঠার সময় আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করার প্রবণতা আছে অনেকের মধ্যেই ৷ বাসের হেলপাররা তার মধ্যে অন্যতম৷''

তার কথা, ‘‘এখন এগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে ৷ চেষ্টা করি যতদূর সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে৷ প্রতিবাদ করেও কাজ হয়না৷ অনেকেই আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নেন৷ তাদের কথা, পাবলিক বাসে চড়লে তো একটু আধটু এরকম হবেই৷ গায়ে হাত লাগবে৷ সেটা পছন্দ না হলে প্রাইভেট কারে চড়ো না৷''

আগে বডি শেমিংকে মানুষ তেমন গুরুত্ব দিতো না: তানসেন রোজ

প্রতিকার কী?

আচঁল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, "আমরা জরিপে দেখেছি আপত্তিকর স্পর্শ এবং বডি শেমিং-এর বিষয়টি এখন অনেক বেড়ে গেছে৷  আগে বডি শেমিংকে মানুষ তেমন গুরুত্ব দিতো না৷ কিন্তু এখন এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷”

অন্য ধরনের যৌন হয়রানিও কমেনি৷ বিশেষ করে গণপরিবহন এখন তরুণীদের জন্য একটা আতঙ্কের জায়গায় পরিণত হয়েছে৷ শনিবারও শাহবাগ এলাকায় এক তরুণী যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বলে জানান তিনি৷

তিনি বলেন, ‘‘আমরা বডি শেমিং-এর ব্যাপারে আইনের প্রস্তাব করেছি৷ অন্যান্য যৌন হয়রানির ব্যাপারে আইন থাকলে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পান না বা প্রতিকারের জন্য যান না৷ এর পেছনে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রধানত দায়ী৷ আর মামলা করলে অনেক সময় উল্টো অভিযোগকারীকেই হয়রানির শিকার হতে হয়৷”

শনিবার জরিপের রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ‘‘নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে, সচেতনতার পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত মানসিক সমর্থন করতে হবে এবং বুঝাতে হবে যে জীবন এতো মূল্যহীন নয়৷ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষা প্রাধান্য দিতে হবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবাইকে সচেতন হতে হবে৷ সর্বোপরি নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে৷''

আগে প্রয়োজন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান

সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুরঞ্জনা সাহা বলেন, ‘‘ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি আস্থার প্রতীক হলেও সামাজিক অশুভ প্রয়োগ ও ব্যক্তিগত দায়িত্বহীনতার  কারণে অনেক নারীর কাছে এখন তা এক আতঙ্কের নাম৷''

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বডি শেমিং-এর কারণে সম্প্রতি একটি মেয়ে আত্মহত্যাও করেছে৷ ঢাকার একটি স্কুল শারীরিক গঠনের  করণে কয়েকজনকে ভর্তি করাতে অস্বীকৃতিও জানিয়েছিলো৷ এটা আসলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ শুধু শারীরিক গঠন নয়, গায়ের রঙ, চেহারার  কারণেও হয়রানির শিকার হতে হয়৷  আর রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন তো বলেই দিচ্ছে গায়ের রঙ কালো হলে মেয়েদের জীবন ব্যর্থ৷”

তিনি বলেন," অন্যান্য যৌন হয়রানির ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকলেও বডি শেমিং-এর বিষয়ে আইন স্পষ্ট নয়৷ তবে আদালতে যাওয়া যেতে পারে৷ আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসলেও তা খুবই ধীর গতিতে৷ আগে প্রয়োজন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন৷”

২০১৯ সালের ছবিঘর