পানির মাছ পানিতে, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগে
২৫ জানুয়ারি ২০২৪দলীয় আনুগত্য, সাংবিধানিক অধিকার এবং ‘পানির মাছ পানিতেই স্বচ্ছন্দ'- এই তিন কারণে সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন তারা৷
আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকতে চান৷ তারা চান আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে অন্তর্ভুক্ত হতে৷ রবিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াতে তাদের এই ‘মনের কথা: তুলে ধরবেন তারা৷
সংরক্ষিত নারী আসনের ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই মেনে নেবেন বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন৷
৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের মধ্যে দুই-একজন এই চিন্তার বাইরে আছেন৷ তারা অবশ্য আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন৷ এরকম সংসদ সদস্য আছেন তিন জন৷ তারা হলেন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সৈয়দ এ কে এম একরামুজ্জামান সুখন৷ তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ছিলেন৷ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তাকে বহিস্কার করা হয়৷ সিলেট-৫ আসনের মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলি৷ তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন৷ আর লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত৷ তিনি টাঙ্গাইল-৪ আসনে বিজয়ী হয়েছেন৷
সিলেট-৫ আসনের নির্দলীয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলি বলেন, ‘‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দাওয়াত দিয়েছেন, অবশই যাবো৷ তার কথা শুনবো তিনি কী বলেন৷ আমার দিক থেকে কোনো কথা বলার নেই৷ তবে আমি তো আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না৷ তাই স্বতন্ত্রই থাকতে চাই৷ স্বতন্ত্র থাকাই ভালো মনে করছি৷”
স্বতন্ত্রদের কোটায় সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে কোনো চিন্তা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলে, ‘‘এটা নিয়ে আমাদের স্বতন্ত্রদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি ৷ আর প্রকৃত অর্থে স্বতন্ত্র তো মাত্র তিন জন৷ আমরা কী পাবো? বাকি সবাই তো আওয়ামী লীগ৷”
‘আমরা আওয়ামী লীগ’
টাঙ্গাইল-৫ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন৷ তিনি একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হলেও এবার মনোনয়ন না পেয়ে ‘স্বতন্ত্র' হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হন৷ তার কথা, "আমাদের কোথায় রাখবেন সে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী দেবেন৷ আমরা তো আওয়ামী লীগের পদে আছি৷ মনোনয়ন পাইনি, কিন্তু তার অনুমতি নিয়েই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি৷ এখন আমরা সবাই দলেই ফিরতে চাই৷ আমরা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে থাকতে চাই৷”
তিনি বলেন, "নির্বাচনকে সফল করতে ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে আমরা সহযোগিতা করেছি৷ তার রাজনৈতিক চিন্তা অসাধারণ৷ তিনিই আমাদের আস্থার জায়গা৷”
তিনি জানান, আওয়ামী লীগের যারা স্বতন্ত্র হিসেবে পাস করেছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগেই থাককে চান, কারো ভিন্ন চিন্তা আছে বলে তার জানা নেই৷
বরিশাল-৪ আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা পংকজ নাথ বলেন, "আমরা তো আওয়ামী লীগের অনুমোদিত স্বতন্ত্র৷ আমি নিজে চাই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে থাকতে৷ আমার মতো আর সবাইও তাই চায়৷ ৬২ জনের মধ্যে স্বতন্ত্র তো আসলে তিন জন৷ বাকি সবাই তো আওয়ামী লীগ৷ এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা ভালো মনে করেন আমরা সেভাবেই কাজ করবো৷
‘পানির মাছ পানিতেই থাকতে চাই’
আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র এমপিরা কয়েকটি কারণে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সঙ্গে থাকতে চান৷ প্রথমত, তারা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হলেও তাদের মধ্যে মাত্র দুই জনের দলের কোনো পদ নেই৷ বাকিদের সবাই থানা,জেলা বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন৷ ওই দুইজন আওয়ামী পরিবারের হলেও দলের পদে নেই৷ তারা হলেন পিরোজপুর-৩ আসনে জয়ী শামীম শাহনেওয়াজ৷ তার ভাই মঠবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুর রহমান মনোনয়ন পেয়েছিলেন৷ জাতীয় পার্টিকে আসন ছাড়ায় নৌকা হারান৷ শামীম শাহনেওয়াজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি হয়েছেন৷ আর জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার কারণে গাইবান্ধা-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আফরোজা বারী প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় তার মেয়ে আবদুল্লাহ নাহিদ নিগার স্বতন্ত্র প্রার্থী হন৷ আফরোজা বারী সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি৷ নাহিদ নিগারের দলে কোনো পদ নেই৷
যারা পদ আছেন, তারা স্বতন্ত্র এমপি হওয়ার পর দলে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে এখন আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে থাকতে চান৷ তা না হলে স্থানীয় রাজনীতিতে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারেন৷ আর আওয়ামী লীগের এমপি হলে বরাদ্দ, এলাকার উন্নয়ন, প্রভাব- এইসব বিষয়ে এগিয়ে থাকবেন৷ এছাড়া সামনে যদি মন্ত্রিসভার আকার বড় হয়, সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান এবং সরকারের বিভিন্ন ব্যাংক, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যানসহ নানা সুযোগ এখনো অপেক্ষা করছে৷ ‘আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র'রা এসব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবেই থাকতে চান৷
মাদারীপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোসাম্মাত তাহমিনা বেগমের কথা, "আমি আওয়ামী লীগে ছিলাম, আওয়ামী লীগেই থাকতে চাই৷ এটাই প্রধানমন্ত্রীকে রবিবার বলবো৷ বিশেষ কারণে জনগণের দাবির মুখে স্বতন্ত্র হয়েছি৷ জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে এমপি করেছে৷”
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, "যদি আওয়ামী লীগে না নেয় তাহলে স্বতন্ত্র থাকবো৷ বিরোধী দলে যাবো না৷ কেউ যেতে চাইলে তারা যাক, আমি যেতে পারি না৷”
এদিকে ঢাকা-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে জেতা আওয়ামী লীগ নেতা ড. আওলাদ হোসেন বলেন, "আমি হলাম আপদমস্তক আওয়ামী লীগ৷ কিসের স্বতন্ত্র? আমি তো আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে যেতে চাই৷ আমি পানির মাছ পানিতে থাকতে চাই৷ এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছি৷”
নারী আসন ও বিরোধী দল
সংসদে সরাসরি ৩০০ আসনে নির্বাচনের পর এখন ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন হবে৷ সংসদ সদস্যদের ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধান থাকলেও ওইভাবে ভোটে নির্বাচিত করার নজির নেই৷ সমঝোতার ভিত্তিতেই নারী সংসদ সদস্য কারা কতজন পাবেন তা নির্ধারিত হয় এবং সেইভাবে ৫০টি আসনে ৫০ জনই প্রার্থী হন এবং সবাই পাস করেন৷ সেই হিসাবে ছয় জন সংসদ সদস্যের বিপরীতে একজন নারী সংসদ সদস্য হন৷ সেই হিসেবে স্বতন্ত্ররা ১০ জন নারী সংসদ সদস্য পাবেন৷ কিন্তু এ ব্যাপারে স্বতন্ত্ররা নিজেদের মধ্যে কোনো আলাপ-আলোচনা এখনো করেননি৷ এ ব্যাপারে মাদারীপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোসা. তাহমিনা বেগম বলেন, "রবিবারে দেখি প্রধানমন্ত্রী কী করেন৷ তিনি যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেভাবেই হবে৷ আমরা স্বতন্ত্ররা এটা নিয়ে আলোচনা করিনি৷ ”
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ড. আওলাদ হোসেন বলেন, "আমাদের যদি আওয়ামী লীগে নিয়ে নেয়, তাহলে তো আর কোনো কথা নেই৷ তখন প্রধানমন্ত্রীই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন৷ আর আমাদের আলাদা রাখলেও তিনি নিশ্চয়ই একটা দিক নির্দেশনা দেবেন৷ আমরা সেভাবেই কাজ করবো৷”
তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু এমপি বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত যা তথ্য রয়েছে তাতে স্বতন্ত্রদের স্বতন্ত্রই রাখা হতে পারে৷ নারী আসন তারা যে কয়টা পান তাদের সেই কয়টা দেয়া হবে৷ তারা সমঝোতা করে ঠিক করবেন কাদের নারী সংসদ সদস্য বানাবেন৷ আর তারা সঝোতায় আসতে না পারলে নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা দিকনির্দেশনা দেবেন৷” তার কথা, ‘‘রবিবারের বৈঠকে স্বতন্ত্রদের ডাকার কারণ হলো সংসদে তাদের অবস্থান কী হবে, তাদের নারী কোটার সংসদ সদস্য- এসব বিষয়ে আলোচনা করা৷ প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা শুনে সব ঠিক করে দেবেন৷” তিনি আরো বলেন, "আমি যা জানি, তা হলো, জাতীয় পার্টিই সংসদে বিরোধী দল হবে৷”
আর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, ‘‘এখন একটি আশঙ্কা আছে যে, স্বতন্ত্র ছয় জন এমপি মিলে একজন নারী সংসদ সদস্য ঠিক করলে তা অর্থের বিনিময়েও হতে পারে৷ তাহলে তো সেটা অন্যরকম হয়ে গেল৷ আর সরাসরি ভোটে গেলে তো যাদের সংসদ সদস্য বেশি তারা সব পাবে৷ আমরা মনে হয় সব দিক রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্রদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করবেন৷ স্বতন্ত্রদের কাছ থেকে ‘পাওয়ার' নিয়ে পরে তিনি তাদের কোটার নারী এমপি ঠিক করে দিতে পারেন৷ কারণ, স্বতন্ত্ররা ছয় জন ছয় জন করে সমঝোতা করে ১০ জন নারী সংসদ সদস্য ঠিক করতে পারবেন বলে মনে হয় না৷”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "স্বতন্ত্রদের প্রধানমন্ত্রী চাইলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলে নিতে পারেন৷ কারণ, তারা তো সবাই আওয়ামী লীগের পদে আছেন৷ আবার বিরোধী দলেও বসাতে পারেন, স্বতন্ত্রও রাখতে পারেন৷ আইনে কোনো বাধা নেই৷ পুরোটাই এখন প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিষয়৷
এদিকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, "আমরা মনে করি, আমরাই বিরোধী দল৷ কিন্তু সেটা তো স্পিকারের এখতিয়ার৷ তিনি এখনো আমাদের বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দেননি৷ কাউকেই দেননি৷ যদিও আমাদের বিরোধী দল হওয়ার আনঅফিসিয়ালি ইঙ্গিত আছে৷ রবিবারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বতন্ত্রদের বৈঠকের পর বোঝা যাবে কারা সংসদে বিরোধী দল হবে৷ আসলে এটা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে৷”
আগামী ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকা হয়েছে৷ অধিবেশন শুরুর আগেই বিরোধী দল ঠিক হওয়ার কথা৷ আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলের সরকারি গেজেট প্রকাশের পর ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷ গত ৯ জানুয়ারি নির্বাচনে বিজয়ীদের গেজেট প্রকাশিত হওয়ায় আগামী ৮ এপ্রিলের মধ্যে এ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে৷