পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ডবাজি
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ব্যান্ড কালেক্টিভ নাউন৷ যেমন ‘ব্যান্ড অফ রবার্স'৷ বাংলায় দল৷ যে দল হরিণেরা বাঁধে৷ আমরা বলি একপাল৷ ওরা বলে ‘ফ্লোক' বা ‘হার্ড'৷ আরো অনেক কিছুই বলে৷ কানে আসে৷ চোখে পড়ে৷ আর আমাদের জ্ঞানের পালে বাঘ পড়ে৷ সুন্দরীদের দলকে ওরা বলে ‘বেভি'৷ আমরা দলই বলি৷ আমার গ্রামের নফরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দলের দিন ফাঁকা আছিস রে? সে ঢাক বাজায়৷ ঢোল বাজায়৷ বললো, আমাদের দলের তো সেদিন কাজ আছে! ও ব্যান্ড বলেনি৷ বলতেই পারতো৷ বলাতে কী আসে যায়? আমার ছোটবেলায় একদল একসঙ্গে গান বাজনা করলে তাদের অর্কেস্ট্রা বলতো৷ এখনো অনেক জায়গায়, অনেক গ্রামে আমাদের দেখে, আমাদের সঙ্গে বাজনা দেখে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের অর্কেস্ট্রার নাম কী?
মানুষও হরিণ ও হায়নার মতো বিভিন্ন কাতনে দল বেঁধে আসছে সে দিন থেকে, যে দিন থেকে আপেল বা টক কমলা লেবু খেয়ে বুঝতে পারলাম, ইস আমরা ন্যাংটো! তখনো অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ তৈরি হয়নি৷ শব্দ, অক্ষর তৈরি হয়নি৷ কিন্তু বাঁচার জন্য, যুদ্ধের জন্য, জাহাজ তৈরি করে সমুদ্রে ভাসিয়ে নতুন দেশ খোঁজার জন্য দল তৈরি হয়েছিল৷ একটা পালের গোদা হাতির মতো কলম্বাস বা কুক দল বেঁধেছিল৷
আমি ছোটবেলা থেকে দেখছি কীর্তনের দল৷ আবার একসঙ্গে একযোগে গান গাইলে সে দলকে কয়্যার বলতে শুনেছি, দেখেছি৷ পাড়ায় আমাদের ক্লাব ব্যান্ড ছিল৷ বাঁশি, কেডল বাজিয়ে হেঁটে হেঁটে শোভাযাত্রার জন্য তৈরি দল৷ ব্যাগপাইপার বাজিয়ে দল বেঁধে বাজনা বাজানো পুলিশ ব্যান্ড৷ এখনো বউবাজারে ট্রাম্পেট, ট্রম্বোন, বিগ ড্রাম বাজিয়ে ঝকমকে পোশাকের ব্যান্ড একজিস্ট করে৷ তাসার ব্যান্ডও আছে৷ এ পৃথিবীতে কে প্রথম রক করেছিল৷ কে প্রথম ব্যান্ড গড়েছিল, তাকে খুঁজে নিয়ে নোবেল দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই৷
অনেকের মতো আমিও দল বাঁধতে গেছি৷ আমার ক্ষেত্রে দল বাঁধার প্রথম কারণ আমি খুব ভালোভাবে জানি৷ অপারগতা৷ আমি গান শিখেছি ঝিঁঝি পোকাদের ইস্কুলে৷ ছোটবেলায় শোনা যে কোনো গান আমি নির্ভুল সুরে গাইতে পারতাম না৷ খোরাক হতাম আশপাশের লোকের কাছে৷ আমার একটা নিজের সুর বেরিয়ে আসতো৷ ফলত বাড়িতে কেউ থাকলে চান ঘরেও গান গাইতে সাহস পেতাম না৷ কিন্তু চাই বা না চাই, রেডিও আর বাঙালির বারো মাসে তেত্রিশটা পার্বণে আর পুজো প্যান্ডেলগুলোতে চোং থেকে ভেসে আসা গান আমি শুনতে বাধ্য হয়েছি৷ কোনো সিলেকশন আমার মস্তিষ্ক করেনি৷ যা এসেছে কানে, বাসের হর্ন বা পাড়ার মোড়ে বাওয়ালে খিস্তি কানে এসেছে৷ শুনেছি আর আর আমার অ্যাপটিটিউড অনুযায়ী মনে থেকেছে৷ আর সুস্থ স্বাভাবিক একটা মানুষের মতোই সেগুলোর কিছু অংশ, সেটা অপভ্রংশ হলেও আমার মস্তিষ্কে থেকে গেছে৷ বিঁধে গেছে৷ আবার কিছু বিস্মৃতিতে চলে গেছে৷ এর যে মিশেলটুকু থেকে যেতো, সেটা আমার মতো করে আমার কাছেই থেকে গেছে৷ আর যেহেতু যথার্থ শিক্ষা আমার ছিল না, আর আমি তো পেশাদার হতে চাইনি, ফলে ওই ছেঁড়া ছেঁড়া সুর ছেঁড়া ছেঁড়া কথাই থেকে গিয়েছে৷ কোনো গানেরই ঠিকঠাক লিরিক বা সুর গাইতে পারতাম না৷ চেষ্টাও ছিল না৷ ঠিক এই কারণে আমি যেদিন বুঝতে পারলাম যে, আমি গান রান্না করতে পারি, আমি দল বাঁধতে চেয়েছিলাম৷ সঙ্গে আরো কয়েকজন, যারা গান গাইতে পারে৷ বাজনা বাজাতে পারে৷ আমি কম্পোজ করব৷ ঠিক এভাবেই একে অপরের ক্ষমতার ওপর ভরসা করে কীর্তন থেকে শুরু করে আজকের বাংলার আজকের পৃথিবীর সমস্ত দল গড়ে উঠেছে৷
মানুষ সব সময় তো একা থাকতে চায় না৷ কিন্তু এক বাঙালি চুপচাপ, দুই বাঙালি শান্ত, তিন বাঙালি সিভিল ওয়ার, চার বাঙালি ওয়ার্ল্ড ওয়ার৷ এই কথাটাও খুব মিথ্যে নয়৷ তার জন্য অনেকে একাই একটা দল গড়তে বাধ্য হয়েছে৷ আমি ১৯৮৪ সাল থেকে চেষ্টা করেছি দল বাঁধার৷ নামও রেখেছিলাম দলের— দমকল৷ কিন্তু সে দল বাঁধা যখন বিভিন্ন কারণে সম্ভব হলো না, তখন আমি ভাড়াটে দল জোগাড় করতে শুরু করলাম৷ পেশাদার মিউজিশিয়ান বা হবু পেশাদার মিউজিশিয়ানদের সাহায্য নিয়ে নিজের গান বোঝানো সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গে কী সাংঘাতিক, সেটা আজকে বোঝা সম্ভব নয়৷ তখন যুগটাই হলো, কণ্ঠির৷ অন্য কারও গলায় গান গাওয়ার৷ বাংলা গানের ব্যান্ড তৈরিতে এত ‘আমি, আমি, আমার, আমার' করার কিছু কারণ আর না, চ্যারিটি বাড়ি থেকে হয়৷ আর অ্যাটলিস্ট আমি আমার অভিজ্ঞতাটুকু নিখাদ বলতে পারলে বাংলা গানে দল বাঁধা নিয়ে যাঁরা জানতে আগ্রহী তারা কিছু নিখাদ ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা জানতে পারবে, এই আর কী৷ আমি যে সময়টা বলছি, সে সময় কিন্তু আমার মতোই বাকিরা, যাঁরা অন্যভাবে গান গাইতে চাইছেন বা তৈরি করতে চাইছেন, তাঁরা সবাই আমার মতোই আন্ডারগ্রাউন্ডে৷
পৃথিবীটা ছোট হয়নি তখনো৷ পাড়া ছিল৷ রোয়াক ছিল৷ ড্রয়িংরুমের ভেতরে বোকাবাক্সের মতো ছোট হয়নি৷ এখন পৃথিবী তালুর থেকেও ছোট৷ কিন্তু তখন আমার মনে আছে, বড়পিসির শ্বশুরবাড়ি নাকতলা যেতে গেলে আমাদের জোড়াবাগানের বাড়িতে সাজো সাজো রব পড়ে যেতো৷ তা এই নাকতলাতেই গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলে একটা লোক অন্তহীন দলবাঁধার যে চেষ্টা করছে, সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না৷ বাকিদের কথা তো বাদই দিলাম৷ যাঁদের রেকর্ড পাওয়া যায়, তাঁরাই গান গাইছে জানতাম৷ যাঁদের গান রেডিওতে শুনি, তাঁরাই গায়ক৷ এটাই বুঝতাম৷ উত্তরে বসে দক্ষিণের খবর জানা হয়ে ওঠেনি৷ সত্তর বলতে সলিল বুঝেছি৷ গৌতম বুঝিনি৷ জানতামই না তো বুঝব কী?
বাবা অরুণ মজুমদার নাট্যকার ছিলেন৷ কবিও ছিলেন৷ আবার ক্রিকেটারও৷ উত্তর কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় তখন সন্ধের পর বাবুদের ঠাকুরবাড়িগুলোতে বসে যেতো নাটকের দলেরা৷ মহড়ার জন্য৷ আমাদের পাড়াতেই, মানে যে অংশটুকুকে নিজের এলাকা বলে বুঝতাম, আহিরিটোলা, নিমতলা, মথুর শীল গার্ডেন লেনের গলিঘুঁজিগুলোতেই কমপক্ষে পাঁচ-ছ'টা দল ছিল৷ যারা রীতিমতো দাপুটে অভিনেতা সমৃদ্ধ নাটকের দল৷ পাড়ার কাছেই ট্রাম লাইনের ওপারটায় যাত্রাপাড়া৷ দলে দলে ভর্তি৷ হাওয়াইন গিটার সমেত কঙ্গো বঙ্গো অ্যাকোর্ডিয়ান নিয়ে অর্কেস্ট্রা দেখেছি৷ কিন্তু গানের দল চোখে পড়েনি৷ অর্কেস্ট্রা, ‘এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়' বাজাতো৷ সার্কাসে শুনেছি হিন্দি গানের সুর বাজাচ্ছে মিউজিশিয়ানের দল৷ কিন্তু গানের দল বলতে সাদা শাড়ি লাল পাড় আর পাঞ্জাবি পরা ‘ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী' বা রফি-হেমন্ত-মান্না-কিশোরের গলায় গান গাওয়া গায়কদের তখন রীতিমতো রমরমা৷
কলেজে ওঠার পর দু'চারটে দল দেখলাম, যারা আবার ইংরিজি গানের কভার করা দল৷ তারা আবার বাংলা গানটাকে ঠিক গানই মনে করতো না৷ একবার এরকম একটা দলের কাছে গেছিলাম৷ আমার তো বিদেশি এই ফরম্যাটটা স্মার্ট লাগতো৷ তা ভেবেছিলাম যদি এরা আমার গানের সঙ্গে বাজায়, তাহলে ভালো হয়৷ এটা চুরাশির কথা৷ সে দলের চশমা পরা ড্রামার বাংলা গানের সাথে বাজাতে হবে শুনে এমন ভাবে তাকিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড, বুঝে গিয়েছিলাম বাংলা গান এদের কাছে পাত্তা পাবে না৷ সে ড্রামার তার নিজস্ব প্র্যাকটিসে ডুবে থেকে বুঝিয়ে দিয়েছিল আমার সাথে এই দলের কোনো আত্মীয়তা সম্ভব নয়৷ ওরা বাংলা গান বলতে আলাদা কিছু একটা বুঝতো বোধহয়৷
ওদের কি-বোর্ডিস্ট আমার গানের কর্ড খুঁজতে খুঁজতে আমার গানের কথা শুনে বলেছিল, না রে ভাই, আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ এই গান শুনলে পাবলিক মারবে৷ পুলিশে ধরবে৷ অথচ ওরা কি সচ্ছন্দে ‘অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল' গেয়েছে৷ ওদের পুলিশ ধরেনি৷
গৌতমদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল পূজা স্টুডিওতে৷ একটা গান শোনাতে বলতেই গিটারটা টেনে নিয়ে টিউন দেখে নিয়ে ঝরাম করে একটা স্ট্রাম করলেন৷ তারপর শোনালেন ‘ক্যাফে ক্যাফে'৷ এটা নব্বই৷ তখন ওনার এবং মহীনের ঘোড়াগুলির নাম শুনে ফেলেছি৷ এলপিটা কিনে ফেলেছি৷ আর গৌতমদাকে জিজ্ঞেসও করে ফেলেছিলাম, আচ্ছা, তোমরা এত আগে কী করে টাকা পেলে অন্য ধরনের গানগুলো রেকর্ড করার? খুব সিরিয়াসলি আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কেন? ফরেন মানি?'' আমি তো ছিটকে গেছি৷ বলে কি লোকটা? বাংলাগানে বিদেশি টাকা? গৌতমদা আরো নিরুত্তাপ হয়ে বললেন, ‘‘হুমম, কাবুলিওয়ালা৷'' কাবুল তো বিদেশই বটে! হেসেছিলাম৷ আর ভেবেছিলাম, কি অসম্ভব দৃঢ়তার সঙ্গে একটা দারুণ যন্ত্রণার সঙ্গে মজা মিশিয়ে দিতে পারে এ মানুষটা৷
এর মধ্যে হাতে এসেছে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের একটা ক্যাসেট৷ ‘অন ইওর কথা, অন ইওর গান'৷ যদ্দূর মনে পড়ছে স্টুডিওর নাম লেখা ছিল ‘সিং টু লাইভ'৷ চমকে ছিলাম৷ অন্যধরনের গানের স্বাদ পেয়ে৷ তারও অনেক পর, অন্তত বছর দু'য়েক পর ওনার অ্যালবাম বেরোলো ‘তোমাকে চাই'৷ তারপর নচিকেতা, অঞ্জন৷ আমার ভাগ্যেও লাইক ছিঁড়ল৷ আরো কয়েকজনের গান শুনলাম৷ পল্লব, কাজি কামাল, তপন সিনহা আর অবশ্যই প্রতুলদা৷ আরো অনেক গায়কের অ্যালবামও বেরিয়েছিল৷ এই সময়টায় অনেকের মাথাতেই নতুন পোকা নড়চর করছিল৷ অনেকেই অন্য ধরনের গান বাঁধার চেষ্টা করছিল৷ এই সময়টাই আমাদের ওপর ভর করে গাইয়েছে, লিখিয়েছে অন্য ধরনের গান৷
কেউ কেউ জনপ্রিয় হয়েছে, কেউ টোকে গেছে৷ কেউ কেউ হারিয়ে গেছে৷ কিন্তু বাংলা গানের হঠাৎ একটা বাঁক নেওয়াটা যাঁরা কেবলমাত্র জনপ্রিয় হয়েছে, তাদের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল বলে মনে করেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই৷ অনেকে ছিল সে যুদ্ধের সৈনিক৷ সব সৈনিক বাঁচে না৷ কিন্তু যুদ্ধটা জেতা হয়৷ ঠিক সেভাবেই বাংলা গান বাঁক নিলো অনেকের চেষ্টায়৷ বিভিন্ন স্তরে৷ শুরু হলো মানুষের একটা বিশ্বাস যে, নিজের কথা নিজের মতো করে সুর করে বলা যায়৷ আমার মনের কথা কাউকে লিখে দিতে হয় না৷ অন্যের মনের কথা অনিচ্ছেতেও না গাইলে হয়৷ একজন শিল্পী তার মনের কথা নিজের মতো করে নিজের ভঙ্গিতে বলতে পারে, এ বিশ্বাস তৈরি হলো কয়েকজনের সাফল্যে৷
প্রেজেনটেশনও আলাদা৷ স্ট্রাইকিংলি আলাদা৷ একেকজন একেকরকম৷ এবং একজন নয়, অনেকে৷ এটাই নব্বইয়ের গানের হাওয়া বদল৷ যে বদলে তৈরি হলো একটা কৌতূহল৷ বাঙালি ব্যাক টু ব্যাক কিছু কম্পোজার পেলো৷ যাদের বাংলা সিনেমা ধরতে পারলো না৷ আমাদের গান-বাজনা বুঝতে বাংলা সিনেমার আরো ২০ বছর সময় লেগে গেল৷ প্রসেন, কিংশুকের মতো, অনুপমের মতো লিরিসিস্ট বা সুরকারকে অ্যাকসেপ্ট করতে৷ কিন্তু মানুষ তাদের জাপটে ধরল৷ আর এখান থেকেই আরও একটা মোচড় নিলো বাংলা গান৷ আরো একটু বড় হলো বাংলা গানের বাজারটা৷ মহীনের ঘোড়াগুলিকে মানুষ চিনতে চাইলো৷ সত্তরের একটা চেষ্টা আশির লড়াইয়ে জিতে নব্বইয়ে এসে এস্টাব্লিশ করলো৷ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গানের দোকানে আছড়ে পড়লো পরশপাথর, অভিলাষা, ক্যাকটাস, ফসিলস, চন্দ্রবিন্দু৷ এবং অবশ্যই আবার নতুন করে মহীনের ঘোড়াগুলি৷ মাঝে কিছুটা সময় শুধু গেছিল পুরনো গান ঠিক ঠাক রেকর্ডিংয়ে শোনার আগ্রহ৷ পুরনো গানও নতুন করে শুনতে শুরু করলো বাঙালি শ্রোতারা৷ আর ক্যাসেট নামক এই ভীষণ সস্তা মধ্যবিত্ত নাগালের মধ্যে থাকা মাধ্যমের সাহায্যে সাংঘাতিকভাবে বাংলা গান বিভিন্ন ফর্মে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ এর কাছাকাছি সংখ্যা অনুযায়ী কোনো বুম আমার জ্ঞানত বাংলা গানে হয়নি৷
প্রতুলদা একা উঠলেন মঞ্চে৷ একা গাইলেন, একা তুড়ি দিলেন৷ অন্য এক নাটকীয় পারফর্ম্যান্স৷ সে হিসেবে এই ভারতে এভাবে পারফর্ম কেউ করেছে বলে আমার চোখে পড়েনি৷ সুমনবাবু একা উঠলেন মঞ্চে৷ একা বাজালেন কি-বোর্ডস৷ নচি উঠলো হারমোনিয়াম সামনে রেখে, কাঁধে কালো ব্যাগ৷ সংগত বলতে একটি তবলা আর একটা গিটার৷ অঞ্জন দত্ত মঞ্চে সঙ্গে নিলেন নীলকে৷ দু'টো অ্যাকুয়াস্টিক গিটার আর গানের নাটকে বুঁদ হয়ে গেল অডিয়েন্স৷ মঞ্চে বাজনার অনুষঙ্গ হয়ে উঠলো অন্যরকম৷ মানুষ কথা খেলো বেশি করে৷ গিললো বললে ঠিক হয়৷
এঁদের মধ্যে আমার অভিজ্ঞতা এবং বয়স কম হওয়ায় আর মিউজিকাল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ কম থাকায়, আমি নানারকম চেষ্টা করতে লাগলাম৷ শুরু করেছিলাম অ্যাকুয়াস্টিক ড্রামস, বেস এবং লিড গিটার আর কি-বোর্ডস নিয়ে৷ তারপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাপে লাইভ প্রেজেনটেশনে কখনো এসেছে অক্টোপ্যাড, কখনো ল্যাটিন পারকাশন৷ কখনো আবার অ্যাকুয়াস্টিক ফ্লুট৷ কখনো ভায়োলিন৷ থিতু হতে পারছিলাম না৷ এর মধ্যে তিনবার অন্য সমস্যায় পড়লাম৷ শোয়ের দিন ব্যান্ডের কেউ কেউ অনুপস্থিত থেকে আমায় বিপদে ফেলার চেষ্টা করলো৷ সেই লিস্টে বড় বড় নাম আবার উঠতি নাম, সবই ছিল৷ এমনকি সম্পূর্ণ অচেনা নামও৷ কেউ বাদ যায়নি৷ একজন গায়কের সঙ্গে মিউজিশিয়ানদের অর্থনৈতিক কারণে বিরোধের জের হিসেবে৷ কে ঠিক, কে ভুল সে বিচার আমার করা অনুচিত৷ তবে ওই একটা বিপদ সামলে উঠে আমি আরো পরিণত হলাম৷ ব্যান্ড বা দল বাঁধা আর সেটাকে ধরে রাখা এক জিনিস নয়৷ বিশেষ করে একজন শিল্পী যে নিজের চেষ্টায় নাম এবং দাম তৈরি করেছে মানুষের কাছে, একজন সোলো আর্টিস্ট হিসেবে, তাঁর পক্ষে একটা দল বেঁধে থাকা একই অনুপাতে বাজার থেকে অর্থ নেওয়া এবং তা ভাগ করে দেওয়া বেশ ডিফিকাল্ট৷ মেনে নেওয়া যায় না৷ আমার আমিটা এক কথা বলে, ওদের আমিগুলো বলে অন্য কথা৷ একটা দল ধরে রাখতে গেলে এইসব আমিগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে ‘আমরা' হতে হয়৷ কিন্তু সেটা ভীষণই ডিফিকাল্ট৷ যে সমস্ত মিউজিশিয়ান আমার সঙ্গে বাজানোর পর নিজেরা দল খুলেছে, তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে৷ জুতোটা যে পরে থাকে, সেই আসলে বোঝে কোথায় খোঁচা মারছে ফোসকাটা৷
তর্ক চলতে লাগল৷ বারে বারে আমার দল ভাঙলো এবং গড়লো৷ এই মুহূর্তে হিসেব করলে আমার সঙ্গে কেবল চশমা পরা বেস গিটারিস্টই বাজিয়েছে আট-ন'জন৷ ড্রামার, কি-বোর্ডিস্টের সংখ্যাও নেহাত কম নয়৷ বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে শর্টটার্ম কাজ করতে এসে অনেক দল ভেঙেছে৷ বদলেছে বিশ্ব জুড়ে৷ কিন্তু দল বেঁধে গান-বাজনা করার এই ইচ্ছেটা মরে যায়নি৷ যায়ও না৷ এখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন প্রান্তে ঝকঝকে ছেলেরা দল বেঁধে তাদের মতো করে গান গাইতে চাইছে৷ আজকের ইন্টারনেটের দুনিয়া তাদের সাহস আরো বারিয়ে দিয়েছে৷ বিভিন্ন রকমের কাজ হচ্ছে এই বঙ্গদেশ জুড়ে৷ আলোচনা হচ্ছে, ঝগড়া হচ্ছে, তক্কো হচ্ছে, দলের আবার দল হচ্ছে৷ বাজার বাড়ছে৷ বড় হচ্ছে৷ সবসময় তা টের পাওয়া যাচ্ছে না হয়তো৷ হয়তো অনেকের মনে হচ্ছে তাদের কেকের সাইজ ছোট হয়ে যাচ্ছে৷ আমার তা মনে হয় না৷ আমার ধারণা, পশ্চিমবঙ্গের গানবাজনা অন্য যে কোনো দেশের মতোই সময়কে ঝেলছে৷ সব দেশেই কেউ কেউ আছে যারা মনে করে, বাজার যা চায় সেটা দেবো৷ আর কেউ কেউ ভাবে, আমরা যা দেবো সেটা বাজার নেবে৷ এ ভাবনারা পাশাপাশি থাকবে৷ যতদিন পৃথিবী থাকবে৷ যেদিন পৃথিবী ধ্বংস হবে, যদি আদৌ হয়, হলে নিশ্চয়ই একটা বিস্ফোরণ হবে৷ একটা দারুণ শব্দে কেঁপে উঠবে এ বসুন্ধরার প্রস্তরপিঠ৷ পেট, বুক৷ খোন্দল হয়ে ধরিত্রীর বুকে আবার একটা জরায়ু তৈরি হবে ভবিষ্যতের কোনো প্রাণীর গর্ভ হিসেবে৷ আগুন আর ধোঁয়ার গোল্লা হয়ত আকাশ ছোঁবে৷ কিন্তু সেই নিদারুণ ধ্বংসের শব্দেও কিন্তু নতুন সৃষ্টির শব্দ শোনা যাবে৷ আমরা হয়ত থাকবে না শোনার জন্য৷ কিন্তু মিউজিক থেকে যাবে৷ যেমন ছিলই এ পৃথিবীতে৷ আমরা থাকার আগেও৷
এই লেখা সম্পর্কে মতামত লিখতে পারেন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷