পশ্চিমবঙ্গের নতুন জেলা কালিম্পং
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭প্রায় পাঁচ মাস আগেই ঘোষণা ছিল যে দার্জিলিং জেলায় এক সাব-ডিভিশন হিসেবে থাকা কালিম্পংকে আলাদা জেলার মর্যাদা দেওয়া হবে৷ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে, দার্জিলিংয়ের লেপচা জনজাতির মানুষদের জন্য আলাদা পর্ষদ গঠনের ঘোষণার সময়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই আশ্বাস দিয়ে এসেছিলেন৷ জানিয়েছিলেন, কালিম্পং অঞ্চলের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য রাজ্য সরকার আলাদা অর্থ বরাদ্দ করবে৷ রাস্তাঘাট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে এখানে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা আছে সরকারের৷
মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে আবার পাহাড়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ কালিম্পংকে আলাদা জেলার স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ঘোষণা করলেন ২২০ কোটি টাকার এক সড়ক প্রকল্পের কথা, যা প্রাচীন সিল্ক রুট ধরে কালিম্পংকে সিকিমের সঙ্গে সংযুক্ত করবে৷ কালিম্পংয়ের জলকষ্ট মেটাতে ৫০ কোটি টাকার এক জল সরবরাহ প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করলেন৷ জানালেন, কালিম্পংয়ে পর্যটনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৫টি উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করেছে সরকার৷ উদ্দেশ্য, কালিম্পংয়ের উন্নয়ন, স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থান৷ আপাতত লাভা এবং গরুবাথান, এই দুটি জায়গায় দুটি নতুন থানা চালু হচ্ছে৷ ভবিষ্যতে আরও ৮টি নতুন থানা হবে৷ কালিম্পংয়ের নতুন জেলাশাসক হলেন ডঃ বিশ্বনাথ, পুলিশ সুপার অজিত সিং যাদব৷ এঁরা দু'জনেই কালিম্পংয়ের মেলা গ্রাউন্ডের মঞ্চে বুধবার উপস্থিত ছিলেন৷ তাঁদের সঙ্গে মানুষের পরিচয় করিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য আর কালিম্পংয়ের মানুষকে দূরে কোথাও যেতে হবে না৷
'৮০–র দশকে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের ধাত্রীভূমি ছিল যে কালিম্পং, সেখানকার মানুষদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন— উন্নয়নে পাশে থাকুন৷ আন্দোলন আর অশান্তির আগুন নয়, উন্নয়নের প্রদীপ জ্বালান৷ এই প্রসঙ্গে পাহাড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এবং বিজেপিকে একহাত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷জিএনএলএফ, অর্থাৎ গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও তার নেতা সুবাস ঘিসিং একসময় আলাদা গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাড়ে যে আন্দোলন ছড়িয়েছিলেন, তাকেই এখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নতুন নেতা বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা৷
বিজেপি বরাবরই এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে৷ পাহাড়ে একটিমাত্র যে সাংসদ পদ, সেটি সেই বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই বিজেপির দখলে৷ পাহাড়ে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও সাংসদ, বিধায়ক নেই৷ সব ক্ষমতা ছাড়া আছে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, বা জিটিএ-র হাতে৷ মমতা ব্যানার্জি এদিন প্রশ্ন তোলেন, তাও কেন কোনও উন্নয়ন হয় না পাহাড়ে?
তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বস্তুত যেটা করলেন, তা উন্নয়নের স্বার্থে, বা প্রশাসনিক সুবিধার জন্য নয়৷ কালিম্পংকে আলাদা জেলা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আদ্যন্ত রাজনৈতিক, বলছেন পর্যবেক্ষকরা৷ গোর্খাল্যান্ড, বা অন্য কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি না মানতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মমতা চেয়েছিলেন বিমল গুরুংকে বাগে আনার৷ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার লক্ষ্যে জিটিএ তৈরি করে দেওয়া, বা পুরনো অপরাধের মামলার ভয় দেখিয়ে পাহাড়ে অশান্তি আটকে রাখা, এ সবই ছিল সেই চেষ্টার অন্তর্গত৷ কিন্তু যখন দেখা গেল বিমল গুরুং বা তাঁর মোর্চা গোর্খাল্যান্ডের পুরনো দাবি, বা পাহাড়ে লোক খেপানোর রাজনীতি ছেড়ে নড়ছে না, মমতা কালিম্পং এবং দার্জিলিংয়ের অন্যত্র বসবাসকারী লেপচা জনগোষ্ঠীর লোকজনের আলাদা করে দিলেন৷ কালিম্পংকে আলাদা জেলা করে দিয়ে কার্যত দু'ভাগে ভাগ করে দিলেন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে৷ এর আগেই জনমুক্তি মোর্চা ছেড়ে বেরিয়ে এসে নতুন দল গড়েছেন কালিম্পংয়ের নেতা হরকা বাহাদুর ছেত্রী৷ তিনিই প্রথম কালিম্পংকে আলাদা জেলা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷ হরকাও এদিন কালিম্পংয়ের মেলা ময়দানের মাঠে বসে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর পাশে৷ বোঝা গেল, পাহাড়ে আসন্ন পুর নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে নতুন জোট হবে হরকা বাহাদুরের জন আন্দোলন পার্টির৷
এবার থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি পশ্চিমবঙ্গে ‘কালিম্পং দিবস' হিসেবে পালিত হবে বলে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ পাহাড় জুড়ে তখন আতসবাজি ফাটছে!