পশ্চিমবঙ্গে শুভবুদ্ধিরই জয়
৩০ মার্চ ২০১৮খবরটা ২৪ ঘণ্টা ধরে ঘুরপাক খেয়েছে ইন্টারনেটে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, হোয়াটসঅ্যাপে৷ অনেকে বিশ্বাস করেছেন, অনেকে করেননি৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা গেল, খবরটা সত্যি৷ আসানসোলের এক মসজিদের ইমামের ছোট ছেলেকে অপহরণ করেছিল একদল দুষ্কৃতি, যাদের উদ্দেশ্য ছিল দাঙ্গা বাধানো৷ রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে হাঙ্গামায় আগে থেকেই অশান্ত আসানসোলে আরও ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার মতোই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যখন ওই ১৬ বছরের কিশোরের কুপিয়ে খুন করা দেহ পাওয়া যায়৷ তার জানাযায় জড়ো হয়েছিল বেশ কয়েক হাজার মুসলিম৷ সমস্ত উত্তেজনায় জল ঢেলে দেন ওই সন্তানহারা পিতা, মওলানা ইমদাদুল রশিদি৷ তিনি বলেন, এই মৃত্যুর শোধ তুলতে গিয়ে একটি ঘরেও যেন আগুন না লাগে, একটি দোকানও যেন ভাঙচুর না হয়, কারও গায়ে যেন হাত না পড়ে, আর একটি মৃত্যুও যেন না হয়৷ ইমামসাহেব বলেন, ‘‘‘আমার সন্তানের আয়ু ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই আল্লাহই তাকে তুলে নিয়েছেন৷ আর যারা তাকে হত্যা করলো, আখেরি কেয়ামতের দিন আল্লাই তাদের বিচার করবেন, সাজা দেবেন৷ কাজেই আমি আল্লাহর ওপরেই সব ছেড়ে দিয়েছি!'' মওলানা রশিদি এরপর জমায়েত মুসলিমদের জানান, এই কথার যদি কোনও অন্যথা হয়, তবে তিনি মসজিদের ইমামতি ত্যাগ করে আসানসোল ছেড়েই চলে যাবেন৷
দাঙ্গার সত্যি-মিথ্যে খবর নয়, এখন এই মহত্ব, এই মানবিকতার খবরই সবাই প্রচার করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক, লেখক, প্রাবন্ধিক শামিম আহমেদ নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘‘এই খবর আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ুক৷ সবাই জানুক, দাঙ্গাবাজরা শেষ কথা বলে না৷'' শামিম ডয়চে ভেলেকে জানালেন, আসানসোলের বাসিন্দা, প্রখ্যাত লেখিকা জয়া মিত্রর সঙ্গে তাঁর এই বিষয়টি নিয়ে কথা হয়৷ জয়া মিত্র তাঁকে বলেছেন, এখন আসানসোলের পরিস্থিতি অশান্ত বলে তিনি বাইরে বেরোতে পারছেন না৷ কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক হলে তিনি নিজে যাবেন ওই ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করে, তাঁকে অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসতে৷
সোমবার রামনবমীর শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে যে হাঙ্গামার শুরু, শুক্রবারও সেই উত্তেজনা বহাল আছে৷ শহরের অনেক জায়গা থমথমে, শুনশান৷ কিছু জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি আছে৷ যান চলাচল বন্ধ৷ ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ রাখা হয়েছে প্রশাসনিক নির্দেশে, যাতে গুজব, উত্তেজনা না ছড়াতে পারে৷ কিন্তু তার পরেও নানাভাবে খবর আসছে দাঙ্গা বেধে যাওয়ার আর খুন-জখমের৷
কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে বুঝে ওঠা দায়৷ ডয়চে ভেলেকে জানালেন আসানসোলের বাসিন্দা, পেশায় একটি এফএম রেডিও চ্যানেলের আরজে অর্পিতা চক্রবর্তী৷ তাঁর ক্ষোভ, আদতে এটি বিজেপি এবং তৃণমূলের লড়াই, যার মাঝে পড়ে দুর্ভোগ হচ্ছে সাধারণ মানুষের৷ এবং এত কিছু ঘটার পরেও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা উত্তেজনা বাড়াতে চেষ্টার কসুর রাখছেন না৷
শুক্রবারই উত্তেজনাপ্রবণ এলাকায় যেতে গিয়ে পুলিশের বাধা পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়৷ অর্পিতা চক্রবর্তী বলছেন, আসানসোলের মানুষ হিসেবে তাঁদের অনেক প্রত্যাশা ছিল বাবুলের কাছে৷ কিন্তু কার্যত কিছুই করতে পারেননি বাবুল৷ একটি বন্ধ কারখানাও খোলাতে পারেননি, একটি লোককেও চাকরি দিতে পারেননি৷ এমনকি পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজও কোনোটাই শেষ হয়নি৷ অন্যদিকে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আসানসোলের ক্ষোভ, শহরে ভিন রাজ্য থেকে আসা বিহারী মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, সরকার দেখেও দেখছে না৷ মমতা ব্যানার্জি মুসলিম তোষণ করছেন, এই উদ্বেগের জায়গা থেকেই হয়ত সাধারণ মানুষ বিজেপির দিকে ঝুঁকছে৷ একটা সামাজিক বিভাজন তৈরি হচ্ছে৷
সম্ভবত এই কারণেই আসানসোলে দাঙ্গা বাধানোর ছক৷ ব্যর্থতা ঢাকার এর থেকে বড় কৌশল যে আর হয় না, সেটা বরং বারবারই প্রমাণিত৷