‘মোদী শাড়ি', ‘মমতা শাড়ি' কেনার ধুম
৬ এপ্রিল ২০১৯পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন৷ এই নির্বাচন শুধুই দিল্লির ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, ভারতবাসীর অন্যতম পার্বণও বটে৷ দোল-দীপাবলি-ঈদ-বড়দিন প্রতি বছর আসে, কিন্তু দেশ জুড়ে এত বড় ভোট উৎসব আসে পাঁচ বছর অন্তর৷ সেই উৎসব ঘিরে মেতে উঠেছে মানুষ৷ তার ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে সর্বত্র৷ বাদ যাচ্ছে না পোশাকও৷ বাজারে এসে গিয়েছে নতুন ডিজাইনের শাড়ি৷ তাতে থাকছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রতীক৷ শাড়িতে শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর হাসিমুখ৷ কলকাতার নিউ মার্কেটের দোকানে এমনই ডিজিটাল প্রিন্টের শাড়ি মিলছে৷ দোকানের বাইরে কাঁচের শোকেসে থরে থরে সাজানো রয়েছে ভোটের শাড়ি৷
প্রতিটি শাড়িই সুন্দরভাবে ডিজাইন করা৷ বিজেপির পদ্ম, কংগ্রেসের হাত ও তৃণমূলের ঘাসফুল প্রতীক দেখা যাচ্ছে৷ কোথাও বড় মাপের প্রতীক, কোথাও ছোট ছোট অসংখ্য প্রতীকে আঁচল ভরে দেওয়া হয়েছে৷ কমিউনিস্টদের কাস্তে-হাতুড়িও বাদ নেই৷ বামপন্থি শিবিরে সেই অর্থে কোনও সর্বময় নেতা-নেত্রী নেই, তাই তাদের শাড়ি সেজে উঠেছে শুধু প্রতীকে৷ প্রতি শাড়িতে নির্দিষ্ট দলের রং'কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ কংগ্রেস ও তৃণমূলের ক্ষেত্রে যা সবুজ, বিজেপির ক্ষেত্রে গেরুয়া, বামেদের বেলায় আবার লাল৷
নবীন ইসরানির শাড়ি বিপণী নিউ মার্কেটে আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে৷ তাঁর দোকানে শাড়ি কিনতে এসে মহিলারা বিস্মিত হচ্ছেন ভোটের শাড়ি দেখে৷ এটা কি বিপণনের কৌশল? নবীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন উৎসবে থিমের শাড়ির পসরা রাখি৷ দোল, দীপাবলি, পয়লা বৈশাখে সেই পার্বণের সঙ্গে মানানসই শাড়ির চাহিদা থাকে৷ সেভাবেই নির্বাচনের মরসুমে ভোটের শাড়ি রেখেছি৷ আমার দোকান ৯ বছরের পুরনো৷ ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের সময়ও এই ধরনের শাড়ি তুলেছিলাম৷''
নির্বাচনের প্রচারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দেখা যায়, প্রিয় প্রতীকে ছাপানো শাড়ি বা টি-শার্ট পরে মিছিলে হাঁটছেন৷ কারও মুখে থাকে পছন্দের নেতার মুখোশ কিংবা মাথায় লাল-গেরুয়া-সবুজ টুপি৷ ডিজাইনার শাড়ির জন্য অবশ্য মোদী-মমতার ভক্তদের একটু বেশি টাকাই খরচ করতে হচ্ছে৷ একেকটি শাড়ির দাম রাখা হয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় ১,২৩০ টাকা৷ তবু শাড়ির চাহিদা রয়েছে৷ মানুষ এসে খোঁজ করছে৷ ক্রেতারা হঠাৎ দেখে কিনেও নিচ্ছেন৷
সল্টলেকের বাসিন্দা মধুঋতা সরকারকে একটি দোকানে পাওয়া গেল৷ তিনি বললেন, ‘‘শাড়িগুলো খুব সুন্দর৷ কাপড়, ছাপা দুই-ই ভালো৷ দামটা একটু বেশির দিকে৷ তবে বেশ চমক আছে বলতেই হবে''
গড়িয়ার সমর্পিতা মজুমদার চৈত্র সেলের বাজার করতে এসেছিলেন৷ ভোটের শাড়ি পছন্দ হলেও তিনি দোটানায় পড়েছেন৷ মোক্ষম প্রশ্ন ছুঁড়ে তিনি বললেন, ‘‘বুথে গিয়ে সবার অলক্ষ্যে ভোটযন্ত্রের বোতাম টিপতে হয়৷ কারো বোঝার উপায় থাকে না, ভোটটা কাকে দিলাম৷ কিন্তু, এখানে যে শাড়িটা কিনব, সেটা দেখে অন্য দলের সমর্থকরা আমার দিকে আড়চোখে তাকাবে না?''
কলকাতার ব্যবসায়ীরা আপাতত এই সমস্যার কোনও সমাধান দিতে পারছেন না৷ তাঁরা বলছেন, এক-একটি দলের প্রতীক ও নেতার ছবির থিমে শাড়ি এসেছে৷ কিন্তু, যত মত তত পথ মার্কা শাড়ি আসেনি যেখানে এক আঁচলে সব দলের প্রতীক মিলবে, মিলবে এক ডিজাইনে মোদী-মমতা-রাহুলের ছবি৷ তা নাই বা হলো, যিনি যে দলের সমর্থক, সেই নেতার ছবি দেয়া শাড়ি কিনে ফেলতেই পারেন! এখানে উৎসব উদ্যাপনটাই বড় ব্যাপার৷
ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটের সময় যেমন মানুষ মেতে ওঠে, ভোটে তেমনটা দেখা যায়৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে এত বড় উৎসব শুরু হচ্ছে, পোশাক ছাড়া সেই উৎসব পালন করা যায় নাকি? তাই নতুন শাড়ি বাজারে আসছে৷ আমি মোদীজির শাড়িই বেশি দেখেছি৷ এটা একটা স্টাইল স্টেটমেন্ট৷ নাগালের মধ্যে দাম থাকলে সবাই কিনবেন, পরবেন৷ গণতন্ত্রের এই মহোৎসবে সামিল হওয়াটাই আসল৷''
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপি কখনই তেমন উল্লেখযোগ্য শক্তি ছিল না৷ স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার এখানে বিজেপি বড় শক্তি হিসেবে উঠে আসছে, এমনটাই মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের৷ তৃণমূল তাদের শক্তি ধরে রাখতে মরিয়া৷ দেশের অন্য প্রান্তে মোদী জ্যাকেট নিয়ে যে আগ্রহ দেখা গিয়েছিল, এই রাজ্যে শাড়ির বিক্রি দেখে জনপ্রিয়তার গ্রাফ বোঝা যেতেই পারে৷ নবীন বলেন, ‘‘মোদী-মমতার শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে৷ বাকিদের চাহিদা তুলনায় কম৷ তবে আমাদের বিক্রির কোনো টার্গেট নেই৷ এখানে ব্যবসা কতটা হলো, সেটা বড় ব্যাপার নয়৷''
ক্রেতা থেকে বিক্রেতা, সবার কাছেই এটা সত্যিই সেলিব্রেশন৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে শ্রেষ্ঠ উৎসবের উদযাপন, যেখানে সামিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কোটি কোটি ভারতবাসী৷