ন্যায্য প্রতিবাদ, তবে দুর্ভোগে রোগীরা
২৪ আগস্ট ২০২৪আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের পর থেকে দুই সপ্তাহ কর্মবিরতিতে জুনিয়র চিকিৎসকরা। জরুরি বিভাগ খোলা থাকলেও বাকি পরিষেবা বিপর্যস্ত। সুপ্রিম কোর্টের অনুরোধে অন্যান্য রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা কাজে ফিরেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জুনিয়র চিকিৎসকরা এখনই কাজে যোগ দিতে রাজি নন।
রোগীদের ভোগান্তি
রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের উপরঅধিকাংশ নিম্নবিত্ত মানুষ নির্ভর করেন। সেই পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন তারা।
শনিবার সকালে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চেনাভিড় চোখে পড়ল না। মূল প্রবেশদ্বারের কাছেই জুনিয়র চিকিৎসকরা ধর্না মঞ্চে বসে রয়েছেন। সামনে অধাসেনা ও পুলিশের পাহারা। রোগীদের ভিড় অনেকটাই পাতলা। কয়েকটি বিভাগে সিনিয়র চিকিৎসকরা রোগী দেখছেন। যদিও তা চাহিদার তুলনায় অনেকটাই কম।
দত্তপুকুর থেকে আরজি করে এসেছিলেন বিকাশ ঘোষ। সঙ্গে বৃদ্ধ বাবা। বলেন, "এর আগের দিন এসে ফিরে গিয়েছি। আজ অপেক্ষা করছি। দেখি বাবাকে ডাক্তার দেখাতে পারি কি না। এখানকার ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়েছিলেন। একমাস পরে আসতে বলেছিলেন।"
অস্থিরোগ বিভাগের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বেলগাছিয়ার শ্রাবণী হালদার। তিনিও বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। বলেন, "সাত দিন ধরে বাবা ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন। শুধু পেইনকিলার খাইয়ে আর কতদিন চালাব। আজ ডাক্তার দেখাতে এসেছি। দেখি কী হয়!"
আরজি কর সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাধারণভাবে বহির্বিভাগ ও আপৎকালীন পরিষেবা বিভাগে রোজ মোট হাজার পাঁচেক রোগী আসেন এই হাসপাতালে। এখন সেই সংখ্যা অনেকটাই কমছে।শুক্রবার বহির্বিভাগে এক হাজার ১০০-র বেশি রোগী দেখা হয়েছে। জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করলেও সিনিয়ররা সামাল দিচ্ছেন।
অন্যত্র একই ছবি
আরজি কর হাসপাতাল চলতি আন্দোলনের মূল কেন্দ্র।কলকাতার অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের ছবিটাও খুব একটা আলাদা নয়। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল, এসএসকেএম, মেডিক্যাল কলেজ, শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালেও কমবেশি একই অভিজ্ঞতা হচ্ছে রোগী ও তার পরিবারের।
এই হাসপাতালগুলোতে পরিষেবা সুষ্ঠুভাবে চালানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকে আবাসিক পড়ুয়া চিকিৎসকদের। এদের সংখ্যা হাজার দশেক। এরা পুরোপুরি কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ায় রোগীরা দুর্ভোগে পড়েছেন।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে অন্য সময়ের মতো ভিড় নেই। আউটডোর চালু থাকলেও রোগীর সংখ্যা কম। আবার কম সংখ্যক রোগীকে পরিষেবা পেতেও দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
গুরুতর অসুস্থ কণিকা দত্তকে পার্ক সার্কাস থেকে এনেছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। আউটডোরে চিকিৎসককে তারা দেখালেও সমস্যার সমাধান হয়নি। মৌ দত্ত বলেন, "এখানকার ডাক্তারবাবু বললেন, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। এখানে কী হবে আমরা জানি না। এখন ন্যাশনাল মেডিক্যালে যাচ্ছি।"
প্রতিবাদ মঞ্চে উপস্থিত এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী, ডা. অনিন্দ্য মণ্ডল ডিডাব্লিউকে বলেন, "রোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো কমেছে। মানুষ যে আমাদের আন্দোলন সমর্থন করছেন, সেটা রোগীর অনুপস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে। আমাদের প্রশাসনের তরফে রেসিডেন্ট ডাক্তারদের দিয়ে একটা বড় অংশের কাজ করানো হয়। তারা কেউ কাজ করছেন না।"
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন রহিমা বিবি। আউটডোরের কাছেই বসেছিলেন খবরের কাগজ পেতে। বললেন, "কালকে একবার এসে ফিরে গিয়েছি। ছেলেটার বমি হয়েই যাচ্ছে। আজ বলেছে ডাক্তার দেখানো যাবে। তাই বসে আছি। বাইরে ডাক্তারের ফি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।"
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন ডা. অর্ণব তালুকদার ডিডাব্লিউকে বলেন, "রোগীরা কম আসছেন। এখন আমাদের হাসপাতালে আগের তুলনায় রোগীর সংখ্যা ৪০ শতাংশ কম। আমরা ২৫০ জন ইন্টার্ন কোনোভাবেই ডিউটিতে যাচ্ছি না। সিনিয়র ডাক্তাররাই সব কাজ করছেন।"
এভাবেই কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য প্রতিবাদ ও গরিব রোগীদের অসহায়তা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যেসব হাসপাতাল রোগীর ভিড়ে রোজ উপচে পড়ত, তারা কোথায় যাচ্ছেন? বেসরকারি হাসপাতালে যেতে না পারলে তারা কি থাকছেন বিনা চিকিৎসায়?
নিরাপত্তা ও পরিষেবা
সুপ্রিম কোর্টের অনুরোধ মেনে এই রাজ্যের চিকিৎসকরা এখনো কাজে যোগ দিতে প্রস্তুত নন। তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনে অপরাধীদের বিচার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার দাবি তুলে তারা কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দেশজুড়ে রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য তৈরি হয়েছে অল ইন্ডিয়া জয়েন্ট অ্যাকশন ফোরাম। এর সর্বভারতীয় সমন্বয়ক ডা. নীলাঞ্জন দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা শুধু চিকিৎসক নয়, আপামর জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাই তারাও পথে নেমেছেন। এই দাবি পূরণের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন চাই।"
রাজ্য সরকার জুনিয়র চিকিৎসকদের বিভিন্ন দাবি পূরণ করেছে। সর্বোচ্চ আদালত আশ্বাস দিয়েছে, আন্দোলনের যুক্ত থাকার জন্য কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। এটাকে যথেষ্ট বলে মনে করছেন না আন্দোলনরত চিকিৎসকরা।
আন্দোলনকারীরা প্রশ্ন তুলছেন, চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পর এতদিন কেটে গেলেও কেন আর কোনো গ্রেপ্তারি হল না? আরজি কর ছাড়া অন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা এখনো কেন হয়নি?
ডা. দত্ত বলেন, "সরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসক বা পরিকাঠামোর যে ঘাটতি রয়েছে, সেটা নিয়ে কোনো সরকার ভাবে না। জনগণের স্বাস্থ্যের দাবিতেও এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আন্দোলন বন্ধ করার প্রশ্নই নেই।"
এসব ন্যায়সঙ্গত প্রশ্নের ফাঁসে আটকে রয়েছে রোগী পরিষেবার ভবিষ্যৎ। সিবিআই তদন্ত, অপরাধীদের গ্রেপ্তারি ও বিচার, সবকিছুর পরিণতি খুব দ্রুত হবে বলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত মানুষজন মনে করছেন না। ফলে রোগীদের ভোগান্তি অচিরেই শেষ হবে, এই আশা কম।